মগ্ন সৈকতে নিঝুম নির্জনতায় তাজপুর

 গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, হৃদয়পুর, উত্তর ২৪ পরগনা ##

“আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে……….”

দর্শনমাত্রই আমার সমস্ত অন্তর যেন গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল — এমনই স্থান মাহাত্ম্য! সমুদ্র, সবুজ, বেলাভূমি, নির্জনতা সবাই মিলেমিশে কত ভালোবাসা, যত্নেই না ফুটিয়ে তুলেছে এমন সীমাহীন সুন্দরের এই স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি। দুচোখের মুগ্ধতায়, আপ্লুত চেতনা যেমনখুশি ভাবনার নিবিড় গভীরে ডুব দেয়। আহা!

 চঞ্চল, মুখর জীবনের একরোখা প্রবাহ যেন থমকে গেছে এখানে। নিশ্চুপ একেবারে ব্যস্ত সময়ের অনর্গল টিকটিক। রুটিরুজির অনিবার্য তাগিদে ঘন্টা-মিনিটের অঙ্ককশা প্রতিনিয়ত ছুটেচলার স্নায়ুচাপের পীড়ন আজো আমাদের সঙ্গ নেবার ছাড়পত্র পায়নি এখানে। শতেক সমস্যা, উদ্বেগ কিংবা হাজারো এলোমেলো দিশাহীন ভাবনায় বিক্ষুব্ধ অনুভব যেন নিঝুম তৃপ্তির সহস্রধারায় অবগাহন করে হারিয়ে যায় বিভোর হরষে। চারপাশের টানটান নির্জনতার কি অদ্ভুত মাদকতা ! কেমন যেন একটা ঝিমঝিম মৃদু উত্তেজনা তিরতির তিরতির করে ছড়িয়ে পড়ে শোণিতধারায়। চেয়ে থাকার কি অপার সুখ !

সামনে সীমাহীন কলেবরে প্রাগৈতিহাসিক সমুদ্র। ঢেউয়ের পর ঢেউ নিয়ে নিরন্তর আপন খেয়ালে খেলে চলেছে মহাকালের সাথে । মাটির পৃথিবীর সাথেও তার এতটুকু কম নয় নাড়ির টান। যেন যুগযুগান্তরের আত্মার  সম্পর্ক ! তাইতো মুহুর্মুহু তরঙ্গ চুম্বনে ভরিয়ে তুলছে তাকে অবিরাম। সাগর ছুঁয়ে ওই যে সাগরবেলা ……..ধু-ধু, যতদূর চোখ যায় …….সেখানে যেদিকে তাকাও স্বর্ণাভ ঝলকে নেশা ধরে চোখে । দূরে আদিগন্ত ঝাউবন রোমাঞ্চিত দামাল বাতাসে। যেন সবুজ হিন্দোল নীল আকাশের পাতায়-পাতায় লিখে চলে এক নিটোল প্রেমের কবিতা।

অনাবিল শান্ত নির্জনতার অখণ্ড পটভূমিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় সব কিছু যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়। ভিড়-চলকানো  পাথুরে শহর কলকাতা বুঝি আলোকবর্ষ দূরে ! যদিও ভুল ভাঙবে অচিরেই।

আলোকবর্ষের দূরত্বটা আসলে কল্পনার সাথে বাস্তবের। কলকাতা থেকে তাজপুরের দূরত্ব মাত্র একশ সত্তর  কিলোমিটার। ঘন্টা চারেকের মধ্যে দিব্যি পৌঁছে যাওয়া যায়। দীঘা-কলকাতা রুটে বালিসাই নেমে বাঁ দিকে পথ চলে গিয়েছে সোজা তাজপুর সৈকতে। মোটরভ্যানে বা টোটোয় সওয়ার হলে বড় জোর পনেরো মিনিট। রেলপথে আসলে নামতে হবে রামনগর স্টেশনে। সেখান থেকে মোটরভ্যানে বা ভাড়াগাড়িতে আর কতটুকুই বা পথ তাজপুর ! দীঘার ভিড়ভাট্টায় হেঁদিয়ে উঠলে স্বাদবদলাতে এখানে খোলামেলায় কয়েক দণ্ড চক্কর মেরে গেলে খারাপ লাগবেনা । দীঘা থেকে তাজপুর মাত্র পনেরো কিলোমিটার । শঙ্করপুর এবং মন্দারমনির মাঝামাঝি তাজপুর । তাই তিনটি স্থানকে একযাত্রায় সামিল করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ । গাড়ি মিলে যাবে দীঘাতেই । সময় বিশেষে পর্যটকদের রমরমা সমাগমে  দীঘা সরগরম হয়ে উঠলে, ভাড়াটা একটু চড়ে বসতে পারে । কিন্ত ভড়কালে চলবে না ।  মাথা ঠান্ডা রেখে দামাদামি করে একটা রফায় আসতে হবে —– উপায় কী ?

 যদিও এবার দীঘায় এসে  আচমকা সটান  তাজপুরে চলে আসাটা নিছকই আমার খেপা-খেয়ালের পাকেচক্রে যে ঘটেছে বলা যেতেই পারে ।  সেই দিনটাও দীঘায় কাটিয়ে পরেরদিনই বাড়ি ফেরার কথা ছিল। কিন্ত সেদিন ঠিক যখন দিন আর দুপুরের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা বেশ জমে উঠেছে,  দীঘার দূরদিগন্তে সমুদ্র-ভেজা আকাশটাতে হঠাৎ করে যেন টের পেলাম শুধুই কানে শোনা অদেখা তাজপুরের অদৃশ্য হাতছানি । আর তর সইল না । একটা গাড়িও জুটিয়ে ফেললাম । তারপর তল্পিতল্পা গুটিয়ে একরাত আশা নিয়ে রওনা দিলাম সোজা তাজপুরে ।

তাজপুরে পৌঁছে মর্মেমর্মে টের পেলাম আমার “এই উঠলো বাই তো কটক যাই” সিদ্ধান্ত মোটেই হঠকারিতা নয় : সাগরগীতের মূর্ছনা, বিজন সৈকত, মনউদাস  করা ঝাউবনের দেদার সবুজ, সর্বোপরি চারপাশের নিষ্কলুষ শান্ত পরিবেশ যেন মনের আঁচল টেনে ধরে বায়না ধরে, একটা নরম ‘মন কেমন করা’ আবেশ ছড়িয়ে দেয় বেবাক মনের আঁনাচে-কাঁনাচে পর্যন্ত । তখন কোনো দ্বিধা-ধন্দ-কিন্তুর বালাই  না রেখে মন শিশুর মত আব্দার করে বসবেই, চল না থেকে যাই এখানে দু-একটা দিন । থেকে যাওয়া যেতেই পারে অবলীলায় । ভালো মানের বেশ কিছু হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠেছে কাছেপিঠেই ।  প্রায় সৈকতছুঁয়ে বা একটু দূরে । 

তাজপুর পশ্চিমবঙ্গের ভ্রমণ মানচিত্রে এক নবতম সংযোজন । নবীনতম আকর্ষণ । বাগানের নতুন গাছটিতে সদ্য আসা ফুলটির মতো ! সপ্তাহান্তিক ভ্রমণ যাদের নেশায় কিংবা সময় সুযোগ পেলেই যারা হয় সবান্ধবে নয় সপরিবারে বেরিয়ে পড়েন এখানে-ওখানে কাছেপিঠে কোথাও তাদের অনেকেরই এখনো সেভাবে গোচরে আসেনি নামটা ।  তাজপুর বুঝি তাই আজো সেভাবে জমজমিয়ে ওঠেনি । তবে খুব দ্রুত ভ্রমণপিপাসুদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে স্থানটি । গত কয়েক বছরের মধ্যে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো হোটেল রেসোর্ট । তবু এখনো ভিড়ে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেনি তাজপুর । তাই  উদাস নিসর্গের নিরালা অন্দরে যারা আত্মমগ্নতার নিবিড় গভীরে হারিয়ে গিয়ে অচেনা নিজেকে খুঁজে দেখতে চান, অকপটে বলা যেতেই পারে তাজপুর তাদের কাছে আদর্শ ।

শুধুই কী আপনমনে থাকা, এমন শুনশান ধু-ধু প্রান্তরে মন আরো কত কিছুই না চায় ! একটা বল নিয়ে দলবেঁধে দাপাদাপি করেও অনেকটা সময় অন্যভাবে উপভোগ করা যেতে পারে । না লাগে এতটুকু ক্লান্তি, না পড়ে কখনো এতটুকু উৎসাহে ভাটা । আবার মন চাইলে বল ছেড়ে ঢেউ নিয়ে মেতে উঠতেও মন্দ লাগবেনা । সংযত চঞ্চলতায় ঢেউগুলো যেন বন্ধুর মতো । তাই এখানে সমুদ্র স্নান বড়ই উপভোগ্য ।

বাঙালি আমরা । মাছ খেতে বড্ড ভালোবাসি । আর সামুদ্রিক মাছের স্বাদই আলাদা ! ভাজা করে যদি খাওয়া যায় তো কোনো কথাই নেই । সাধ জাগলে স্বাদ নিতে কোনো বাধা নেই । সমুদ্র থেকে রাশিরাশি মাছ ধরে এনে জেলের দল চরায় মুক্ত করে জাল । ঝকঝকে রোদে চকচকিয়ে ওঠে রকমারি রুপোলি মাছ । কিছুটা সওদা করে আশপাশের কোথাও থেকে ভাজিয়ে নিয়ে মুখে তুললেই রসনার অপার তৃপ্তি ।

জালে কখনো-সখনো মাছের সাথে দু-একটা শঙ্করমাছের ছাঁও ধরা পড়ে অবাঞ্ছিতের মতো । পানপাতার মতো গড়ন । ঈষৎ হলদেটে ধূসর বর্ণ । দেহের থেকে অনেক বড় লেজ । জেলেরা অনাদরে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেয় । কিন্তু মমতাভরে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ান দেখবেন ওদের চোখভরা আকুতিতে মন আপনার কেমন-কেমন করবে । আহারে !

তাজপুর সংশ্লিষ্ট জেলার একটি অন্যতম মৎস্যচাষ কেন্দ্র । ব্যাপ্তি যার প্রায় চোদ্দোশো একর এলাকা জুড়ে । মাছ ধরেই দিন চলে এখানকার অধিকাংশ মানুষের । জীবন-জীবিকার সন্ধানে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা যাদের অকুল দরিয়ায় নিত্য ভেসে চলা তারা কেমন আছে একটু খবর নিতে ভাবলাম যাই একবার ঘুরে আসি কাছের জেলেগ্রামে ।

গুটিগুটি পায়ে পৌঁছে গেলাম । চোখের সামনে ভেসে উঠল সাদামাটা জীবনের একটুকরো অনাড়ম্বর জলছবি । বড়বড় জাল শুকোচ্ছে রোদে । এখানে-ওখানে নানা আকারের জেলেডিঙি । ছাড়িয়ে-ছিটিয়ে মাছধরার হরেক উপকরণ । কঠিন জীবন-সংগ্রামের চিহ্ন যেন সর্বত্র । চারপাশ থেকে আঁশটে গন্ধ নাকে এসে লাগে, তবু ভালোলাগে অনুভব ছুঁয়ে যাওয়া নির্ভীক প্রাণের উত্তাপ ।

তাজপুরে সাগরবেলায় সূর্যাস্তের সাক্ষী হওয়া এক রমণীয় অভিজ্ঞতা । আজীবনের স্মৃতি-সম্পদ । অবাক দেখার মাঝে অবশ করা এমন ভালো লাগার শিহরণ যেন এক অপার্থিব অনুভব । এখানে আরেকটি দর্শনীয় জিনিস  হলো ঝাঁকে-ঝাঁকে লাল-কাঁকড়া আর তাদের অদ্ভুত আচরণ-বিচরণ । দলে-দলে গোটা সৈকত জুড়ে ওরা আছে আপনমনে ।  খুব কাছ থেকে বড় মজা লাগে ওদের লুকোচুরি খেলা দেখতে । তরতর করে এসে হঠাৎ হারিয়ে গেল কোনো গোপন গর্তের আবডালে । খানিক বাদে ভেসে উঠে আবার দৌড় । সূর্যাস্তের সময় ওরা দলবেঁধে ভিড় করে গোটা চরের দখল নিতে । দিবাশেষের রক্তিম আভায় সে এক দেখার মতো দৃশ্য । কুমকুমরাঙা কালচে-লাল গালিচায় কেউ যেন মুড়ে দেয় আদিগন্ত সৈকত ।

নিশিআঁধারে সারাদিনের নিরিবিলি অনুভবে এক অদ্ভুত গা-ছমছম ভালোলাগায় যেন ঝিম লাগে । আমি যখন তাজপুরে তখন শুক্লপক্ষ । অদূরে পূর্ণিমা । সাগর-সৈকত জুড়ে ফুটফুটে জ্যোৎস্না । গুটিগুটি জোয়ার আসছিল সাগরে, নাকি তরঙ্গের ভাঁজেভাঁজে উথালপাতাল রুপোলি যৌবন । রাতের শিহরণ ছড়িয়ে পড়েছিল চরাচরে । সময় গড়াচ্ছিল, আমার যেন হুঁশ নেই ।

পরের দিন পূবাকাশে নতুন ভোরের আঁকিবুকি কাটা শুরু হতেই হাজির হলাম সাগর-কিনারে । কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলের জলবিন্দুগুলোর মত টুপটাপ করে ঝরে পড়ছিল বিগত রাতের শেষ চিহ্নটুকু । সাগর ছুঁয়ে অনেকটা আকাশ নিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হল লাল আবির । লোহিত-বসনা চরাচর জুড়ে শুরু হল নতুন দিনের বন্দনাগীত । পটভূমি যখন প্রস্তুত, চাক্ষুষ করলাম এক অবিশ্বাস্য সূর্য্যদয়ের । ঘোর কাটতে অনেকটা সময় লেগেছিল । যখন কাটল তখন মন খারাপ । এবার ফিরতে হবে । যদিও মন জানে, যা ভাল তা ভাল তার শেষ আছে বলেই ।

অনেক বলা হল তবু সবশেষে বলি একঘেয়েমির বিরক্তি থেকে জমে ওঠা একরাশ ‘ভালো না লাগা’-র প্রাত্যহিকতা থেকে  দু-একদিনের ছুটি নিয়ে নিসর্গ, নির্জনতা, মুগ্ধতা, মগ্নতার সন্ধানে তাজপুরে গিয়ে উপস্থিত হলে, বলা যায়না,  আপনি হয়তো প্রথম দর্শনেই আমার মতো গেয়ে উঠতে পারেন অথবা কবির মতো বলেও উঠতে পারেন ——-

        Ah ! What pleasant visions haunt me

        As I gaze upon the sea !

        All the old romantic legends,

        All my dreams,  come back to me.

                (‘The secret of the sea’  ——–

                    Henry Wadsworth Longfellow)

প্রয়োজনীয় তথ্য :

রেলপথে আসলে খেয়াল রাখতে হবে সব ট্রেন রামনগর স্টেশনে থামেনা । সেক্ষেত্রে দীঘায় নেমে গাড়ি ভাড়া করে তাজপুরে আসতে হবে । তাজপুরে রাত্রিবাসের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঠিকানা —— তাজপুর সবুজ সৈকত (ফোন : ৯৮৩০০৭০০১১) / তাজপুর নেচার ক্যাম্প (ফোন : ৯৮৩১১৬৭৫৩৭) / তাজপুর বিচ রিসোর্ট (৯৮৩০৮১৮৮৫৫) / তাজপুর রেট্রিট (ফোন :৯৮৩০২৭১০৬৪) / লা ম্যাকাও রিসোর্ট (৯৬৭৪৪০৭০০০)

সব ঋতুতেই তাজপুর উপভোগ্য তাই বছরের যেকোনো সময়েই আসা যায় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 1 =