মৃত স্মৃতির কঙ্কালে…. 

সুমি সাহা, ইংরেজ বাজার, মালদা

##
…কেননা রক্তকণিকায় মেশা এই অভ্যেসটা সনাতন; তাই ভাঙা অধ্যায়ের কোণঠাসা শরীরের চিরধরা অঙ্গপেশীও, রোজকার গাণিতিক নিয়ম সেদিন রাতেও ভাঙল না, চিত্রায়িত ছবিটা নিয়ে, শেষবার তাঁর সাথে দেখা হবার। অবশেষে বোধ করলাম, মুখ গোঁজা বালিশটার জলডুবি হয়েছে, আমার বিচ্ছিন্ন ভালবাসার মতই। বাঁচবার উপকরণ রূপে জল জীবন হলেও, এক্ষেত্রে পানীয় হিসেবে তা অ-গ্রহণীয়। কারণ জলটি নিজস্ব। বাসি চোখের রংহীন জলের ক্রমাগত যাওয়া – আসা শুকনো সাদা রেখা এঁকেছে সারা গালময়। তাই তা উপেক্ষাই করলাম থামানোর জন্য। কাছে তখন কেউই নেই নিমগ্ন দর্শক শ্রোতা বা সাক্ষীর দূত হিসেবে। কেবল একাকী ঘরের নতুন পুরোনো আসবাব, কিছু আদিম স্মৃতি আর স্নায়ুপীড়ায় উত্তেজিত হওয়া আমি ছাড়া। প্রতিদিন যেন  সুখের অবসরপ্রাপ্ত শরীরে যন্ত্রণার সাগ্রহে সম্ভাষণ, হবিষ্যি গেলার মত।

সরীসৃপকে অনুকরণ করার প্রাচীন অভ্যেস প্রায়শই ছিল চৌব্বিশ পেরোলেও। তাই দু’পায়ে ভর দিয়ে চলার অভ্যেসটা ক্ষণিকের জন্য স্থগিত রেখে, হামাগুড়ির প্রচেষ্টায় খাটের নিচে পড়ে থাকা আধমরা খাতাটা তুললাম অনেক কষ্টে। সময়টা রাতভোর বারোটা ছ’ টার মাঝামাঝি বললে ভুলই হবে। তখন ঘড়ির ছোট মাঝারি কাঁটাটা পেরিয়েও গেছে কিছুটা। যায় হোক, আলগা কব্জির কলম – দুমরানো খাতা আর রচনা সাহিত্যে ডুব দেওয়া এক অচেনা আমি, তখন আমার সাথে। এই অসহায়ত্বের আমিতে বরাবরই এক নতুন আমির বসবাস শুরু হয়, মাঝ রাতের সহবাসে। যে আমিতে কোনো মিথ্যার জন্ম মৃত্যু – সন্মানের দর কষাকষি – বোধহীন মূল্যবোধ নেই। আছে শুধু সত্যানুসন্ধানের আ-মরণ এক একা একা লড়াই। এ লড়াই হল সে লড়াই, যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো বিরোধী সৈন্যের কুটিলতা – পক্ষপাতিত্ব – হানা – বিদ্বেষ নেই। এ লড়াই রোজকার আমির সাথে ভিতরের এক অচেনা আমির লড়াই। হারিয়ে যাওয়া আমিকে বারবার হারিয়েও নতুন আবিষ্কারের লড়াই।

হঠাৎ নিস্তব্ধতার মাঝে স্তব্ধতার ভাঙন। আমার দমবন্ধ হওয়া শ্বাস, চেষ্টা করেও থেমে থাকতে পারল না। উর্ধ্বশ্বাসে আমি চাদর চাপা শরীর আর শেকল দরজা খুলে দেখি, প্রায় মেঘে মোড়া ভোরের মাঝে চেনা আকাশটা বৃষ্টির সাম্রাজ্য বিস্তার করে প্রকৃতিকে লালন করছে, যেমন একসময় তিনিও আমায়…
ঘুমচোখে বৃষ্টির জল দিতে ইচ্ছে হল, এমনটা হল না। তবে কতক্ষণ!
চোখ অ-বাসি হতেই, বুকের বাম পাশটায় যেন পরমাণুর বিস্ফোরণ ঘটল, একই সাথে লক্ষাধিক।

“তুমি? এসেছ? আমি জানতাম। দীর্ঘ সময়ব্যাপী কয়েকটা বছর…
ত… ত… তবে!!!”

চোখে শুধু অক্ষরহীন শব্দ। এক বোবা চাহনি।

আমার অনবরত ঘামতে থাকা শরীরে তখন শিহরণের বংশবিস্তার। আমি দ্বিতীয় প্রশ্নের প্রজনন না করেই হুড়মুড়িয়ে আমার জিজ্ঞাসু মুখটা গুঁজে দিলাম তার অসুস্থ বুকে, স্নেহালিঙ্গন করার অনুকরণে। মুহূর্তে  গুমড়ানো আমিতে বহু দিনের না পাওয়া এক, শান্তির প্রাপ্তি। যেনো ফাঁকা বুকটায় নিঃসঙ্গতার উপলক্ষ ভেদ। এতদিনে।

জটাজাল দৈত্যর ধোঁয়াশাবৃত চেহারার দূর আকাশকে অন্ধকার বেদীতে রূপান্তরিত করা – মেঘ হুংকার – ব্যস্ত রাস্তায় ভিড়ের চলাচল, এসব তখন প্রকৃতি বর্ণনায় ছিল না। কেবল এক যুক্তিহীন নীরবতা পালন প্রকৃতির আমায় নিয়ে। আমি তাঁকে নিয়ে। নিজ মুখটা ধীরে ধীরে তাঁর স্যাঁতসেঁতে বুক থেকে সরিয়ে আনতেই নিষ্পাপ ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে দিতে দেরি করল না, আমার নিঃস্ব কপালকে। “আমার অনিপুণ ধৈর্য্য – দীর্ঘদিনের তপস্যা এতদিন তো এই ছোঁয়ারই অপেক্ষা করছিল”, নিজেকেই বললাম চুপচাপে। ভুলোমনে আবৃত্তি করলাম, “আজ দিনটি যেন কি!” ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের পরিচালনায় জানতে পারলাম – আজ তো ছুটি বার। ইংরেজী সপ্তম মাসেরও শেষ যাত্রা। 2011.

“2011???
হ্যাঁ, সত্যিই তো। আজ Last July of 2011. এই দিনই তো তোমার আমার শেষ বুক আঁকড়ে ধরা ছিল। শেষ কপাল গালে ঠোঁট ছোঁয়ানো ছিল। ছিল তোমায় তোমার তৈরী করা জায়গায়, না যেতে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। ছিল আমার পাগল প্রলাপ। ছিল একখান অভিযোগের কাঁপতে থাকা আঙুল, তোমার তুলসী চন্দন শরীরের দিকে। ছিল চিৎকার। ছিল গলা পাশে শিরা ফাটানো কান্না। ছিল হতাশা। ছিল অপলক দৃষ্টিতে সব, সব শুধু শেষ হতে দেখা। ছিল; অশান্ত চোখজল বওয়া। সবটাই ছিল সেদিন। শুধু ছিলে না তুমি। ছিল না তোমার কথা রাখা। ছিল না নতুন কথা দেওয়া। তোমার ভগবানের কাছে বন্ধক দিয়েছিলে হাজারো প্রতিশ্রুতিদের, তুমি। তোমার সামনে ওরা তোমার শেষ হতে থাকা পরিবারকে বলেছিলো কত্তও কি! তুমি শুনেও শুনলে না আর। ধার করা ঘুমেই রয়ে গেলে তুমি।”

বোধশক্তির বোধন হতে না হতেই, আবেগের উপনিষদ পাঠ করতে শুরু করলাম, আবার। জোর চিৎকার করে বললাম —–
” তুমি জানো! আমার তৃষ্ণার্ত মন অভিযোগ ত্যাগ করে, কিছুকাল আগে পর্যন্ত এই একটাই আশাতে ঘর বানিয়েছিল, যে, কবে তোমায় একবার – অন্তত একবার চোখের দেখাটা দেখতে পাব। তোমার ব্যস্ততার সারাদিনে না হোক, অন্তত রাতেই না হয় একবার! কবে আমার গা ভাসিয়ে দেবো, তোমার শূন্য কোল জুড়ে! কবে তুমি কপাল গালময়, শুধু সেই পরিত্যক্ত চুমু আবার আগের মত এঁকে দিয়ে বলবে, ‘তুইই আমার সব মনা!’ কবে আবার সেই পাতপাড়ে বসে এঁটো খাবারের এক গ্রাস তুলে বলবে, ‘তোরা খেলেই আমার খাওয়া রে!’  কবে শুনব, তোমার অস্পষ্ট স্বরকম্পনে আমার না শোনা সেই ডাকনামটা! কবে অসুস্থ তোমার শরীরকে রোদমাখা জলে তৈলস্নান করাব! কবে তোমার বিদায়মুখী পায়ে মাথা রেখে, নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করে পুনর্বার বলব — শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করবে তুমি!”

তখনো নিষ্কম্প মুখে নিশাচর এক হাসি। কেবল অকলুষিত চোখ দুটো নিরুত্তরে বলে গেল, নিগূঢ় কিছু অর্থভরা শব্দ।

দ্বিতীয়বার বললাম, খানিক উত্তেজিত হয়েই
” আমার স্বপ্নকল্পনার বাইরে গিয়েও জানা ছিল না, আমায় একান্তই একা করে তুমিও চলে যাবে কোনো একদিন, তোমার অঙ্কুরিত গন্তব্যে, আমার সাথে বিদায়শেষ দেখাটাও না করে – না কথোপকথনের শুরু সমাপ্তি করে – তোমার পীত শীর্ণ দেহ একবারও ছুঁতে না দিয়ে, ওই দূর নিরভ্র আকাশে ছায়াপথ রূপে তুমি….!
এরকম তো কথা ছিল না কোনও…

তুমি না থাকবার কারণে স্বার্থবাদী জগতের অকৃতজ্ঞ মানুষগুলো আজ উপভোগ করতে চায়, আমার ক্ষতের জীবনযুদ্ধটা। আত্মহননের কান্নাটা। ওরা আমার জীবনটা পায়ে পিষে আমায় নিষ্প্রাণ জড়পিন্ডে পরিণত করার অভিপ্রায়ে দিন কাটায়। ওরা – ওরা – আজও… ”

হঠাৎ, ন’টার কফির কাপটা প্রতিবন্ধী ঘুমটাকে তাড়া দিল। চোখের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ হতেই গত রাতের আধমরা খাতাটি। তার উদ্বোধনও হয়নি। কখন যে চোখ দুটো নিয়ম মেনে ছেঁড়া ঘুমের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলেছিল। অজান্তেই। বাইরে তখনো কালো মেঘের মলাট। ক্যালেন্ডারের মাঝে আমার হিজিবিজি করে দাগিয়ে রাখা, রাহুগ্ৰস্ত 2018-র 31st July। বিংশ শতাব্দীর বাড়ির মার্বেল মেঝেতে সহস্র সহস্র অপরিচিত পরিচিতদের আনাগোনা। আজ সাত বছরের death anniversary যে, বাবার!!!

তবে কি পুরোটাই স্বপ্ন?
মনগড়া এক সত্য মিথ্যার রহস্য?
সবটাই কি অপেক্ষা আর জিজ্ঞাসার কানামাছি খেলা?
তবে আমার সহস্র অভিমানী অভিযোগগুলো!
ওদের ভগবানেরও কি ভুল হয় বিচার করতে!!!

দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণাকে ঢোঁক গিলে আমার বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তরা কম চেষ্টা করেনি তোমার উপস্থিতি আর স্থায়ী নেই, সেই কঠিন ভাগ অঙ্কের ভাগশেষটাকে মেনে নিতে, কিন্তু…! কিন্তু আজও….

তবে হ্যাঁ, হ্যাঁ বাবা, এখন আমি আর তোমার সেই আদুরে সতেরোর মেয়েটি নই। আমার মধ্যে আছে হাজার হাজার চব্বিশের মেয়ে, যারা বাবাহীন সকাল সন্ধ্যায় আবেগ লুকিয়ে আগুন হতে জানে। কান্নায় হাসতে জানে। আহ্লাদকে বিসর্জন দিয়ে দায়িত্বকে বীজমন্ত্র করতে জানে। যারা হিসেবী হয়ে প্রয়োজন অপ্রয়োজনের দরদাম করতে জানে। তবে সম্পর্কের দর কষাকষি জানে না করতে বাবা। আমি, আমরা হেলাফেলা করার মতো হলেও, অভিযোগ অনুযোগ না করে কর্তব্যভার সাগ্রহে গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখি। আমাদের কষ্ট গ্রহণে সামর্থ আছে বাবা। এখন মধ্যবিত্ত আমিদের ভালোবাসা চাওয়ার কোনো অনুরোধ নেই, কারোরই কাছে। বাবা ডাক থেকে চিরবঞ্চিত হয়ে, প্রতিটা সময় আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, বাবাদের দায়কর্তব্যের বোঝার ভার আসলেই কতটা ভারী!

ভাবতে ভাবতে মৃত্যুহীন আশাগুলো আবারও রয়ে গেল, কষ্টের আতুড়ঘরে, বাবার কেবল স্মৃতি গুলো নিয়ে। আবারও সেই একাকীত্বতার অনুশাসনপর্ব! সেই একই ভাবে মর্মান্তিক আত্মহননে হেরে হেরে গিয়ে আবারও বেঁচে ওঠা! আবারও সেই ভাঙা অনিচ্ছুক হাসিকেই, সংকল্পে বহন করা, মরচে ধরা কঙ্কালে!!!

One thought on “মৃত স্মৃতির কঙ্কালে…. 

  • July 15, 2018 at 6:39 am
    Permalink

    Punorai Vabie tule anek kichu; Daityo, Somporko, Valobasa, bastab ke onyo bahbe chinte sekhai ei lekha. Khub Sundor.

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 5 =