যেখানে দেখিবে ছাই….

বিশ্বদীপ মুখোপাধ্যায়, নবদ্বীপ, নদিয়া

 

                    পর্ব –

অন্যদিনের তুলনায় একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এলো মৃত্যুঞ্জয়। একে তো প্রচন্ড ঠান্ডা,  তায় আবার অল্প – অল্প বৃষ্টি। রোজ সকাল – বিকেল  এদিক – ওদিক ঘুরতে যাওয়া তার অভ্যেস। ইভিনিং ওয়াক করার সাথে – সাথে রাত্রি আহারের ব্যবস্থাও সে করে নেয়। হোটেলের খাবার খেতে খুব একটা পছন্দ সে করে না। তাই কিছু সব্জি কিনে বাড়িতেই রান্না করে সে। কিন্তু আজ সেটা সম্ভব হলো না। বাজার খুব ভালো বসেনি আজ , বৃষ্টির দরুণ। অগত্যা হোটেল থেকেই খাবার প্যাক করে নিয়ে আসতে হলো তাকে।

বাড়িটা দোতলা , কিন্তু ছোট। নিচের তলায় বাড়িওয়ালা থাকেন নিজের অসুস্থ স্ত্রীর সাথে , ওপরে একটি মাত্র ঘরে মৃত্যুঞ্জয়।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠবার সময় নিজের ঘর থেকে বাড়ির মালিক দীনবন্ধু সরকার বেরিয়ে এলেন। বয়স ষাটের ওপর , কিন্তু দেহ এখনও বলিষ্ঠ। তাঁর বয়সের অনুমান লাগানো যেতে পারে মাথার পাকা চুল দেখে। মৃত্যুঞ্জয়কে বললেন – ‘তোমার সাথে কিছু কথা আছে  মৃত্যুঞ্জয়।’

মৃত্যুঞ্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো দীনবন্ধুর দিকে।

‘কী কথা বন্ধু ?’

দীনবন্ধু মৃত্যুঞ্জয় থেকে বয়সে প্রায় পঁচিশ বছরের বড় , কিন্তু তাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের থেকে কিছু কম না। দীনবন্ধু নামটা মৃত্যুঞ্জয়ের বেশ বড় লাগে। তাই সেটাকে ছোট করে  ‘বন্ধু’  বলে সম্বোধন করে সে।

‘আমার ঘরে এসো।’

দীনবন্ধুর সাথে – সাথে মৃত্যুঞ্জয় তার ঘরে ঢুকলো। ঘর বেশ বড় না। আসবাব – পত্র একটু বেশি তাই ঘরটা আরও ছোট মনে হয়ে। ঘরের মাঝে খাট পাতা , তাতে শুয়ে আছেন দীনবন্ধু বাবুর অসুস্থ স্ত্রী। মৃত্যুঞ্জয়কে একটা চেয়ারে বসতে দিয়ে দীনবন্ধু বাবু নিজে খাটে বসলেন। অতঃপর শুরু হল তাদের কথাবার্তা।

‘‘মৃত্যুঞ্জয়, আমি তোমায় কথা দিয়েছিলাম যে তোমার পরিচয় আমি কাউকে দেবো না। কিন্তু আফসোস এটাই যে নিজের কথা আমি রাখতে পারলাম না।’  ঘাড় হেঁট করে দীনবন্ধু সরকার বললেন।

‘মানে!’ চমকে উঠলো মৃত্যুঞ্জয়।

‘আমি বলতে বাধ্য হলাম। যাকে বলেছি , তার হয় তো তোমাকে প্রয়োজন।’

‘আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, বন্ধু।’ মৃত্যুঞ্জয় বলল।

দীনবন্ধুবাবু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন -‘  সুধাকর ঘোষাল আমার পুরনো বন্ধু। দু ‘দিন থেকে তার ছেলে নিখোঁজ। সুধাকরের মেয়ের সাথে আজ সকালে বাজারে দেখা হল। কথা হল বেশ কিছুক্ষণ। রুমি নাম তার, ভালো নাম – তিস্তা ঘোষাল। তার সন্দেহ তার দাদাকে হত্যা করা হয়েছে। প্রমাণের অভাবে কিছু করতে বা বলতে পারছে না সে। পুলিশ কত দূর কি করবে, সেটা জানা নেই। তাই সে নিজেই এই ব্যাপারে তদন্ত করতে চাইছে। কথাটা শুনে ভয়ে আমার তো অবস্থা খারাপ। খুনের তদন্ত যে কতটা কঠিন সেটা জানা আছে আমার। রুমির বয়সই বা কত, যে ও খুনের তদন্ত করবে? তাই বাধ্য হয়ে আমি তোমার কথা ওকে বললাম। খানিক পরে সে আসবে এখানে,  তোমার সাথে দেখা করতে।’

থামলেন দীনবন্ধুবাবু।

‘তার দাদাকে যে খুন করা হয়েছে, এই সন্দেহটা কি করে হল তার?’ মৃত্যুঞ্জয় প্রশ্ন করল।

সাথে – সাথে বাইরে থেকে একজনের মিহি কন্ঠ শোনা গেল।

‘কাকু, আছ কি ?’

দীনবন্ধুবাবু ঘর থেকে বেরলেন। খানিক পর যখন ঘরে ঢুকলেন, তার সাথে ছিল এক যুবতী। বয়স আন্দাজ কুড়ির কাছাকাছি। বেশ ভালোই লম্বা। পরনে জিন্স টপ, সাথে এক ছাতা। মৃত্যুঞ্জয়ের বুঝতে সময় লাগলো না যে এই রুমি ওরফে তিস্তা ঘোষাল।

 

দীনবন্ধুবাবুর অসুস্থ স্ত্রীর কারণে সেখানে বসে কথা বলা সম্ভব ছিল না। তাই সবাই মিলে মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরে একত্র হল। ছোট্টো ঘর। একটা কাঠের আলমারি ছাড়া একটা খাট এবং একটা চেয়ার ঘরে, সাথে ছোট একটা গ্যাস এবং কিছু বাসনপত্র। খাটে দীনবন্ধুবাবু ও তিস্তা বসল, চেয়ারে বসল মৃত্যুঞ্জয়। তিস্তার কিছু বলার আগেই মৃত্যুঞ্জয় তাকে জিজ্ঞেস করলো – ‘আপনার সন্দেহ কি করে হয় যে আপনার দাদাকে খুন করা হয়েছে ?’

শুরুতেই প্রশ্নের ধাক্কা খেয়ে ঈষৎ ঘাবড়ে গেলো তিস্তা। ঢোঁক গিলে একবার দীনবন্ধুবাবুর দিকে তাকালো , পরক্ষণেই মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল – ‘আমার দাদা খুব হাসিখুশি মানুষ। সারা দিন অনবরত কথা বলে যেত আর নিজের আশেপাশের লোকেদের হাসিয়ে যেত। দাদার অন্তর্ধান হওয়ার দু – তিনদিন আগে থেকে সে কেমন চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল। বেশি কথা বলত না, সারাদিন প্রায় গুম হয়ে থাকত।’

‘কারণ জিজ্ঞেস করেন নি ?’

‘করেছিলাম। আমাকে শুধু বলল যে কাজের চাপ আছে।’  তিস্তা বলল।

‘কি কাজ করত আপনার দাদা ?’

‘ব্যাবসা করত। দাদা আর তার একটা বন্ধু নীলকন্ঠদা মিলে একটা ব্যাবসা শুরু করেছিল। কসমেটিক্স- এর দোকান খুলেছিল একটা। দোকানটা খারাপ চলত না।’

‘দোকানটা তার মানে এখন নীলকণ্ঠদার দায়িত্বে ?’  জিজ্ঞেস করল মৃত্যুঞ্জয়।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘ঠিক আছে। এবার নিজের বাড়ির সম্বন্ধে কিছু বলুন। মানে আপনার বাড়িতে কে – কে আছে?’

‘আমাদের বাড়িতে দুটো পরিবার।’ তিস্তা বলতে শুরু করল – ‘আমাদের আর আমার জেঠুর পরিবার। আমাদের পরিবারে আমরা চারজন। বাবা, মা ও আমরা ভাই – বোন। জেঠুর পরিবারে সদস্য সংখ্যা পাঁচ। জেঠু, জেঠিমা তাদের দুই মেয়ে আর এক ছেলে। দুই মেয়ের মধ্যে বড়মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। পাত্র বলতে গেলে ঘরজামাই।’

‘বলতে গেলে মানে ?’

‘মানে , বড়দি নিজের বরকে নিয়ে আলাদা এক ভাড়া বাড়িতে থাকে। সেই বাড়ির ভাড়া আমার জেঠুই দেয়। জামাইবাবু আমাদের দোকানে সেলসম্যানের কাজ করে। আসলে দুজনের লাভ ম্যারেজ। বড়দি জেঠুর খুবই প্রিয় তাই এই বিয়েটা মেনে নিয়েছে।’

‘হুম, বুঝলাম। আগে?’

‘জেঠুর ছোট মেয়ে প্রিয়া আমার থেকে একবছরের বড়। আমার কলেজেই সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। ছেলে সৌভিক অনেক ছোট। ইস্কুলে পড়ে সে। ক্লাস নাইনে।’  কথা শেষ করে তিস্তা থামল। তাকাল মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।

মৃত্যুঞ্জয় দু ‘চোখ বন্ধ করে শুনছিল।

‘কি নাম তোমার জেঠুর ?’

‘সুধাময় ঘোষাল। বড় মেয়ের নাম শ্রাবন্তী, তারপর প্রিয়া। ছেলের নাম সুকান্ত।’

‘তোমার দাদার নাম জানা হল না।’

‘সুপ্রিয় ঘোষাল।’ তিস্তা জবাব দিল।

‘পুলিশে নিশ্চই মিসিং রিপোর্ট লেখানো হয়েছে ?’

‘আজ্ঞে। নীলকন্ঠদাকে পুলিশ থানায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ কি হল জানি না। এখন তো দেখছি ছেড়ে দিয়েছে।’

‘আচ্ছা, তুমি বললে যে তোমার জামাইবাবু তোমাদের দোকানের সেলসম্যান। কিসের দোকান তোমাদের?’

‘শাড়ির দোকান। জয়েন্ট। বাবা আর জেঠুর জয়েন্ট দোকান।’ তিস্তা এখন বেশ অনেকটাই ফ্রি হয়ে গেছে।

‘তোমাদের নিজেদের দোকান থাকতে তোমার দাদা আলাদা দোকান খুললো কেন?’

‘দাদার নিজের পায়ে দাঁড়াবার ইচ্ছে ছিলো। আমাদের শাড়ির দোকানটা অনেক পুরনো। আমার ঠাকুরদার দোকান। ঠাকুরদার পর বাবা ও জেঠু মিলে দোকানটা বড় করেছে। ঈশ্বরের কৃপায় দোকান বেশ ভালোই চলে। আমার দাদার মধ্যে শুরু থেকেই কিছু আলাদা করার ইচ্ছে ছিল। যাকে বলে শূন্য থেকে শীর্ষে যাওয়া, দাদা সেই জিনিসটা পছন্দ করত। তাই সে আলাদা বিজনেস শুরু করেছিল।’

তিস্তার কথা শেষ হওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ ঘাড় হেঁট করে বসে রইল মৃত্যুঞ্জয়, তারপর জিজ্ঞেস করল –  ‘কখন বুঝলে যে তোমার দাদা মিসিং?’

‘এটা এক ছোট জায়গা। তাই বেশি রাত পর্যন্ত দোকান দাদা কোনো দিনই খোলা রাখতো না। আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে দোকান বন্ধ করে সে বাড়ি চলে আসত। সেদিন ফিরল না। নীলকন্ঠদাকে জিজ্ঞেস করা হল। সে নিজের বাড়িতে। আরও কিছু বন্ধু – বান্ধবদের ফোন করা হল, কিন্তু লাভ হল না। দাদার মোবাইল সুইচ অফ বলছিল। রাত বারোটা নাগাদ গিয়ে থানায় রিপোর্ট লেখানো হয়।’

‘শেষ দুটো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা আছে। রাত বাড়ছে, আপনার এবার বাড়ি ফেরা উচিত।’ মৃত্যুঞ্জয় বলল।

তিস্তা নিজের মোবাইলে সময় দেখল। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। বৃষ্টি থেমেছে , কিন্তু আকাশে এখনও ঘন মেঘের বাসা।

‘জিজ্ঞেস করুন।’

‘আপনার জামাই বাবুর নামটা বলুন এবং এটা বলুন যে তিনি আলাদা বাড়ি ভাড়া নিয়ে কেন থাকেন? আপনাদের বাড়িতেই তো থাকতে পারতেন।’

‘আমার বাবার আপত্তি ছিল। বাইরের লোককে বাড়ির অন্দর মহলে ঢোকাতে বাবা নারাজ ছিল।’ তিস্তা বলল।

‘এই নিয়ে তোমার জেঠুর সাথে তোমার বাবার কথা কাটাকাটি হয়নি ?’

‘না।’

‘বেশ। নাম কি মহাশয়ের?

‘বিক্রমপালিত।’

অতঃপর চলে গেল তিস্তা। পুনরায় শুরু হল অল্প – অল্প বৃষ্টি।

অশান্ত ছিল তিস্তার মন। মৃত্যুঞ্জয়ের আসল পরিচয় তাকে দীনবন্ধুবাবু দিয়ে দিয়েছেন। এতো বড় এক আইপিএস অফিসার কি তিস্তার সাহায্য করবে ? সকালে যখন বাজারে দীনবন্ধু সরকারের সাথে তিস্তার দেখা হয়েছিল, তখন তিস্তার সব কথা শুনে তিনি বলেছিলেন -‘এ সব ব্যাপারে একলা এগোনো ঠিক নয় রুমি। কারো সাহায্য তোকে নিতেই হবে।’

‘কার সাহায্য নেব , কাকু ?’

খানিক চিন্তা করে সরকারবাবু বলেছিলেন – ‘আজ সন্ধ্যাতে আমার বাড়ি আসিস। আমার ভাড়াটেকে তুই হয়তো দেখেছিস, মৃত্যুঞ্জয়। এক সময় সে আইপিএস অফিসার ছিল। এখন সে কাজ ছেড়ে দিয়েছে। তার কাজ করার পদ্ধতি সরকারের পছন্দ হয়নি। অনেক বড় – বড় রহস্য সমাধান সে করেছে। তুই যদি চাস, তাহলে তার সাহায্য নিতে পারিস।’

‘সে কি আমাকে সাহায্য করবে ?’

‘আমি বলব তাকে।’

তিস্তার চলে যাওয়ার পর দীনবন্ধু সরকার মৃত্যুঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করলেন – ‘কি ভাবলে মৃত্যুঞ্জয়? সাহায্য করবে রুমিকে ?’

‘সে এখন অবধি যা – যা বলেছে, সেটা যদি সব ঠিক থাকে তাহলে নিশ্চই সাহায্য করবো।’

মৃত্যুঞ্জয় রাত্রি আহারের সরঞ্জাম নিয়ে বসে গেল।

 

পর্ব –

 

পরদিন সকালে মৃত্যুঞ্জয়ের ফোন আসার পর মেজাজটা বেশ ভাল ছিল তিস্তার। মৃত্যুঞ্জয় ফোনে তাকে বলেছিল -‘আমি দেড়’ঘন্টার ভেতরে আপনাদের বাড়ি পৌঁছবো। বাড়ির সকলকে থাকতে বলবেন।’

তার মানে মৃত্যুঞ্জয় তদন্ত করতে রাজি হয়েছে। তিস্তা কথাটা গতরাতেই নিজের বাবাকে জানিয়েছিল। একরাশ বিরক্তির স্বরে সুধাকর ঘোষাল নিজের মেয়েকে বলেছিলেন – ‘দরকারটা কি ছিল ? পুলিশকে তো জানানো হয়েছে। পুলিশ থেকে বেশি ক্ষমতা নিশ্চই এক গোয়েন্দার হবে না।’

‘সে আতিপাতি গোয়েন্দা নয় বাবা। এক প্রাক্তন আইপিএস অফিসার। কলকাতায় সিআইডিতে কাজ করত।’

নিজের মেয়েকে বেশি ঘাঁটালেন না সুধাকর ঘোষাল।

সারারাত বৃষ্টিপাতের পর সকালের আকাশটা বেশ পরিস্কার। রোদ উঠেছে , কিন্তু শীত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়নি। রোজকার মত মর্নিংওয়াক করে এসে মৃত্যুঞ্জয় ভাবলো একবার থানা থেকে ঘুরে আসা যাক। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হল তাকে। এতো সকালে থানাতে বড়বাবু নিশ্চই আসবেন না। পাহাড়ের জায়গায় লোকেদের ঘুম একটু দেরিতেই ভাঙ্গে। তায় যদি পুলিশের লোক হয় , তাহলে তো কথাই নেই। থানায় গিয়ে লাভ নেই , তার থেকে ভাল হয় যদি ঘোষালদের বাড়ি ঘুরে আসা যাক। তার কাছে ছিল তিস্তার মোবাইল নম্বর , ফোন করল তিস্তাকে।

‘ঘোষালভিলা’ যখন পৌঁছাল মৃত্যুঞ্জয়, তখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে আটটা বাজে। সুধাময় ঘোষালের বড় মেয়ে ও জামাই ভিন্নবাড়িতে প্রত্যেকেই ছিল। দোতলাবাড়ি, বেশ বড়। নিচের তলায় সুধাকর ঘোষালের পরিবার থাকে, এবং ওপর তলায় থাকে সুধাময় ঘোষালের পরিবার। প্রত্যেকের সাথে মৃত্যুঞ্জয়ের পরিচয় করাল তিস্তা।

‘আপনার দাদার কি আলাদা কোনও ঘর আছে?’  তিস্তাকে জিজ্ঞেস করল মৃত্যুঞ্জয়।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘ঘরটা কি একবার দেখতে পারি ?’

‘অবশ্যই, অবশ্যই।’ এবার সুধাকর ঘোষাল এগিয়ে এলেন।

ছোটখাটো গোলগাল চেহারা সুধাকরবাবুর। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, খুবই অল্প। দু’ভাইকে দেখতে অনেকটা একই রকম।

সুপ্রিয় ঘোষালের ঘর নিচের তলায়, তালাবন্ধ  ছিল তাতে। চাবি দিয়ে তালা খুললেন সুধাকরবাবু। বেশ বড় ঘর। দেয়ালে এক এলইডি টিভি, মিউজিক সিস্টেম , খাটে দামী বেড কভার পাতা। এক নজর দেখে মনে হয় সুপ্রিয় খুব শৌখিন ছেলে ছিল। মৃত্যুঞ্জয় ভাল করে ঘুরেঘুরে চারিদিকে দেখতে লাগল। একবার শুধু সুধাকরবাবুকে জিজ্ঞেস করল – ‘পুলিশ কি এ ঘরে এসেছিল একবারও ?’

‘না মশাই। এ ঘরে কেন? রিপোর্ট লেখাবার পর থেকে একবারও এই বাড়িতেই তাদের পা পড়েনি। গতকাল দুপুরের দিকে একবার থানায় গিয়েছিলাম। বড়বাবুর সাথে দেখা হল না।’

খাটের নিচে ঝুঁকে দেখলো মৃত্যুঞ্জয়।কাঠের বেশ কিছু বাক্স দেখতে পেল সে। একে – একে সে গুলোকে বার করল।তিস্তা এবং তার খুড়তুতো বোন প্রিয়া সাহায্য করল মৃত্যুঞ্জয়কে।বাক্সগুলোকে খুলতেই মেয়েদের সাজগোজের জিনিস বেরতে লাগল, কসমেটিক্স। লিপস্টিক, নেলপলিশ ইত্যাদি। দু ‘ চারটেলিপিস্টিকওনেলপোলিশনিজেরকাছেরেখেবাকিগুলোবাক্সেভরেবাক্সোগুলোপুনরায়যথাস্থানেরেখেদিলোমৃত্যুঞ্জয়।ঘরের এক কোণাতে ছিল প্লাস্টিকের এক ডাস্টবিন। মৃত্যুঞ্জয় সে দিকে এগোল। ডাস্টবিনের যাবতীয় জিনিস মাটিতে ফেলল সে।কিছু জিনিস নিজের প্যান্টের পকেটে রেখে বাকিগুলো পুনরায় ডাস্টবিনে চালান করল।

‘না, আর কিছু দেখার নেই এই ঘরে। চলুন।’

ঘর থেকে বেরিয়ে সুধাকর ঘোষালকে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করল – ‘সুপ্রিয় কি মাঝে – মাঝে কলকাতা যেত ?’

‘হ্যাঁ , তা যেত বইকি। দোকানের মাল কেনার ব্যাপার ছিল। প্রায়ই যেত কলকাতা।’  সুধাকরবাবু জবাব দিলেন।

‘সুপ্রিয়র দোকানের ঠিকানাটা চাই আমার।’

সুধাকরবাবু মৃত্যুঞ্জয়কে ঠিকানা দিয়ে বললেন – ‘নীলকন্ঠকে সেখানেই পেয়ে যাবেন আপনি।’

‘নীলকন্ঠকে তো পেয়ে যাব কিন্তু বিক্রমবাবুর সাথে দেখা করাটাও যে প্রয়োজন।’

মৃত্যুঞ্জয়ের এই কথায় এবার সুধাময়বাবু এগিয়ে এলেন। বললেন – ‘তার সাথে দেখা করা কি খুব প্রয়োজন?’

‘কেন? আপনার কোনও আপত্তি আছে তাতে?’  মৃত্যুঞ্জয়ের তীক্ষ্ণ প্রশ্ন।

‘না – না, আপত্তি হবে কিসের? দেখা করতেই পারেন। আসলে সে খুব লাজুক স্বভাবের আর কি।’ সুধাময়বাবু বললেন।

‘ছেলেদের লাজুক স্বভাব মানায় না সুধাময়বাবু। সেটা মেয়েদের আভুষণ। বিক্রমবাবুর ঠিকানাটা দেবেন।’

সুপ্রিয় ও নীলকন্ঠের দোকানটা বেশ সাজানো। গ্রাহক ছিল না, নীলকন্ঠ হিসেবের খাতা খুলে কিছু হিসেব মেলাতে ব্যস্ত।

‘আপনার পার্টনার তো নেই। একলা – একলাই হিসেব মেলাচ্ছেন?’

অচেনা কন্ঠস্বর শুনে চমকে ঘাড় উঠিয়ে তাকাল নীলকন্ঠ। খানিক ভ্রুকুটি করে দেখল, তারপর জিজ্ঞেস করল – ‘আপনারপরিচয় ‘

‘বিস্তৃত পরিচয় দেওয়ার মত সময় নেই নীলকন্ঠবাবু। আপনার জন্য এ টুকু জানাই প্রয়োজনীয় যে আমি সিআইডির লোক।’ সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল মৃত্যুঞ্জয়।

সিআইডির নাম শুনে ঈষৎ ঘাবড়ে গেল নীলকন্ঠ। হঠাৎ সিআইডি তার দোকানে! তাহলে কি সুপ্রিয়র বাবা তার ছেলেকে খোঁজার জন্য সিআইডি লাগিয়েছেন? পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নীলকন্ঠ বলল – ‘আপনার এখানে কি প্রয়োজন সেটা বুঝলাম না তো।’

অট্টহাস্য করল মৃত্যুঞ্জয়।

‘আমার এখানে কি প্রয়োজন হতে পারে নীলকন্ঠবাবু? আপনার বন্ধু , আপনার বিজনেস পার্টনার সুপ্রিয় তো নিরুদ্দেশ। যত দিন না সে ফেরত আসে, এই দোকানের আপনি তো মালিক। আর যদি সে ফেরত নাই আসে তাহলে তো আপনি রাজা , মশাই।’

‘আপনি বলতে কি চান?’ ঈষৎ গাম্ভীর্যের স্বরে নীলকন্ঠ প্রশ্ন করল।

‘পঞ্চাশ শতাংশ পুঁজি লাগিয়ে একশো শতাংশের মালিক হওয়াটা খারাপ আইডিয়া নয়।’

মৃত্যুঞ্জয়ের এই কথায় প্রায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল নীলকন্ঠ।

‘আপনি বলতে চান আমি সুপ্রিয়কে খুন করে তার লাশ লুকিয়ে রেখে দিয়েছি?’

‘আমি তো এমন কিছুই বলিনি মশাই। আমি তো এই সবে তদন্ত শুরু করেছি। যখন তদন্ত চলে তখন প্রত্যেককে সন্দেহ করাটা আমার কাজ। এমনকি সন্দেহের লিস্ট থেকে সুপ্রিয় নিজেও বাদ যায়নি।’

এ আবার কেমন বিচিত্র কথা। যার বিষয় তদন্ত চলছে, সে নিজেও সন্দেহের লিস্টে আছে? সত্যি, গোয়েন্দাদের মাথার ঠিক থাকেনা। মুচকি হেসে নীলকন্ঠ বলল – ‘বলুন , কি জানতেচান।’

‘কসমেটিক্সের ব্যবসা করার প্ল্যানটা আপনার ছিল না সুপ্রিয়র?’

‘সুপ্রিয়র। তবে আমি এক কথায় রাজি হয়েছিলাম। আমার এক দূর সম্পর্কের মামা কসমেটিক্সের ব্যবসা করে বড়লোক হয়েছে। আজ তার নিজের বাড়ি, গাড়ি সব আছে, ওই ব্যবসার দৌলতে। তাই যখন সুপ্রিয় প্রস্তাবটা আমার কাছে রাখল, আমি না করতে পারলাম না’

‘ব্যবসাটা কত দিনের?’

‘ প্রায় দু ‘ বছরহলো। ‘

‘ কলকাতা গিয়ে মাল নিয়ে আসেন, না কলকাতা থেকে অর্ডার করে মাল আনান? ‘

‘ প্রত্যেক পনের দিনে একবার করে কলকাতা যাওয়া হয়। সেটা সুপ্রিয় নিজে যেত। ‘

‘ আপনি যেতেন না কেন ? ‘

‘ কলকাতার হোলসেল মার্কেটে সুপ্রিয়র জানাশোনা আছে। তাই সস্তায় মাল পেতাম আমরা। ‘

দোকানের চারপাশে একবার ভাল করে চোখ ঘুরিয়ে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করল – ‘ বিক্রি তো ভালই হয় বলে মনে হচ্ছে। তাই না ? ‘

দু ‘ হাত জোড় করে নীলকন্ঠবলল – ‘ ঈশ্বরের কৃপা। ‘

‘ কার কৃপা সেটা পরে বোঝা যাবে। আচ্ছা, কলকাতা সুপ্রিয় কি একলা যেত? ‘

‘ হ্যাঁ। আর কে যাবে সাথে? নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং মেল ধরত।সেই ট্রেনেই ফিরে আসত। আমি স্টেশনে গিয়ে তাকে রিসিভ করতাম।ফেরার সময় মাল থাকত, তাই যেতাম আর কি। ‘

নীলকন্ঠ শুরুর দিকে যে ঘাবড়ে গিয়েছিল, তার থেকে অনেকটাই সামলে উঠেছিল।

‘ যেদিন সুপ্রিয় নিরুদ্দেশ হয়, সে দিন তার আচরন কেমন ছিল? ‘

খানিক চিন্তা করে নীলকন্ঠ বলল – ‘ তার দু ‘ দিন আগে থেকেই সে কেমন যেন বদলে গিয়েছিল। বেশি কথা বলত না।আমি ভাবলাম শরীর খারাপ হবে হয়তো। জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু মনমাফিক উত্তর পেলাম না। ‘

‘ আপনাদের মাল রাখার জায়গা কোথায়? মানে কলকাতা থেকে মাল এনে রাখেন কোথায় ? ‘

‘ এই দোকানে গোডাউন বলে কিছু নেই। আমার বাড়িতে জায়গার অভাব। তাই সুপ্রিয় নিজের বাড়িতেই রাখত। ‘

‘ দোকান সার্চ করতে পারি কি ? ‘

‘ অবশ্যই পারেন। কিন্তু সার্চ ওয়ারেন্ট লাগবে। ‘

মুচকিহাসলোমৃত্যুঞ্জয়।

‘ ভেরিস্মার্ট। ‘  উঠে দাঁড়াল সে – ‘ এখানকার মত আসি। দরকারে আবার আসব। ‘

দোকান থেকে বেরিয়ে সময় দেখল মৃত্যুঞ্জয়। ধীরে – ধীরে বেলা বাড়ছে। এবার কোন দিকে যাওয়া যেতে পারে?  থানা না বিক্রম পালিতের বাড়ি?

 

পর্ব – ৩

থানায় গেল না মৃত্যুঞ্জয়। থানায় যথা সময় যাওয়া যাবে, এখন গিয়ে লাভ নেই। বিক্রম পালিত এখন নিশ্চই নিজের বাড়িতে হবে না।ঘোষালদের দোকান খোলার সময় হয়ে গেছে, বিক্রম পালিত দোকানের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে হয়তো।তাই এখন সব থেকে ভাল কাজ বাড়ি ফিরে যাওয়া।বাড়ি গিয়ে মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করা যাবে যে আগামী পদক্ষেপ কি নেওয়া যেতে পারে।

বাড়ি গিয়ে অবাক হল মৃত্যুঞ্জয়। সে দেখল দীনবন্ধুবাবুর সাথে তাঁর ঘরে বসে গল্প করছে তিস্তা। মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে উঠে দাঁড়াল সে।লঘু কদমে এগিয়ে এল তার দিকে।

‘ কিছু কথা বলার ছিল আপনার সাথে। এসে দেখলাম আপনি ফেরেন নি। তাই কাকুর সাথে বসে গল্প করছিলাম।’  তিস্তা বলল মৃত্যুঞ্জয়কে।

‘ ওপরে আসুন। ‘ মৃত্যুঞ্জয় দোতলায় নিজের ঘরের দিকে এগোল। পেছন – পেছন তিস্তা।

তিস্তাকে চেয়ারে বসতে দিয়ে নিজে ঘরের একটি মাত্র জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল মৃত্যুঞ্জয়। জানালা খুলে দিল। সূর্যের আলো প্রবেশ করল ঘরে।জ্যাকেটের পকেট থেকে সিগারেটের ডিবে ও লাইটার বার করে একটা সিগারেট ধরিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ বলুন। ‘

‘ সব থেকে আগে তো আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি আপনাকে। আপনি আমায় সাহায্য করছেন,  এটা আমার জন্য বিরাট প্রাপ্তি। আরও একটা কথা আপনাকে বলতে চাই, যেটা কাল বলা হয়নি। ‘

‘ কি কথা ? ‘ সিগারেটে একটা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করল মৃত্যুঞ্জয়।

‘ কিছুদিন আগেকার কথা। ‘ তিস্তা বলতে শুরু করল – ‘ দাদা আর নীলকন্ঠদার মধ্যে চরম অশান্তি হয়েছিল।কি ব্যাপারে, সেটা জানি না।দাদার সাথে একটা দরকারী কাজ ছিল আমার। তাই দাদার দোকানে আমি যাই। গিয়ে দেখি দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলছে। গলার স্বর দুজনেরই উঁচু।আমায় দেখে দুজনেই শান্ত হয়ে গেল। ঘটনার ঠিক দু ‘ দিন পর দাদা কোথাও চলে গেল। আমি ভাবলাম কলকাতা গেছে হয়তো, দোকানের জিনিসপত্র আনতে।দাদা চারদিন পর ফিরল, খালি হাতে। দোকানের জিনিস পত্র দাদা ট্রেন থেকে নেমে সোজা বাড়িতেই নিয়ে আসে। কিন্তু সেবার কোন জিনিস আনে নি।কারণ জিজ্ঞেস করাতে বলল যে সে নাকি জিনিস আনতে যায় নি। কিছু টাকা বাকি ছিল, সেটা পেমেন্ট করতে গিয়েছিল।কিন্তু দাদা সর্বদা ব্যাংকের মাধ্যমেই পেমেন্ট করত। আমার খটকা লেগেছিল ঠিকই, কিন্তু এ বিষয় দাদাকে আর কোনও প্রশ্ন করিনি।’

নিজের কথা শেষ করল তিস্তা।

‘ ঘটনাটা গত কাল যদি জানাতেন তাহলে বেশি ভাল হত।আপনার দাদা কসমেটিক্সের সব জিনিস কলকাতার কোন দোকান থেকে কিনত সেটা কি আপনার জানা আছে? ‘

‘ না। সেই বিষয় কোনো ইনফরমেশন আমার কাছে নেই। ‘

তিস্তার চলে যাওয়ার পর মৃত্যুঞ্জয় অনেকক্ষণ নিজের ঘরে বসে থাকল। নেলপলিশের শিশিগুলো বেশ ভালো করে পরীক্ষণ করল।তারপর একটা ফোন করেসন্ধের অপেক্ষা করতে লাগল।

সন্ধে সাতটা নাগাদ ঘোষালদের দোকান বন্ধ হয়ে যায়। তাই প্রায় সাতটা তিরিশ নাগাদ মৃত্যুঞ্জয় বিক্রম পালিতের বাড়ি পৌঁছাল।দুটো ঘরের একতলা অতি সাধারণ বাড়ি। স্বামী – স্ত্রী একটা ঘরে থাকে, দ্বিতীয়টি বন্ধ থাকে। বেশ পুরুষালী চেহারা বিক্রম পালিতের, সাথে মিশুকে।অবাক লাগলো মৃত্যুঞ্জয়ের। সুধাময় বাবু তো অন্য কথা বলেছিলেন। বিক্রম নাকি লাজুক। এতো বিক্রমের এক অন্য রূপ দেখল মৃত্যুঞ্জয়।সুধাময় ঘোষালের জ্যেষ্ঠা পুত্রী শ্রাবন্তী নিজেও খুব মিশুকে। মৃত্যুঞ্জয়ের আপ্যায়ন বেশ ভালোই হল সেখানে।

মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিয়ে বিক্রম বলল – ‘ আমি ভাবলাম আপনি হয় তো সকালেই আসবেন। তাই দোকানে দেরি করে গেলাম। ‘

মৃত্যুঞ্জয় সেই কথার কোনো জবাব না দিয়ে তাকে প্রশ্ন করল- ‘ সুপ্রিয়র সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? ‘

‘ খুবই ভাল। এমনই তো বেশি দেখা হত না তার সাথে, কিন্তু যখনই দেখা হত হেসে কথা বলত। খুব হাসিমুখী ছেলে, আর তেমনই মেহেনতি। ‘

‘ আপনার বাড়ি কোথায়? ‘ মৃত্যুঞ্জয়ের দ্বিতীয় প্রশ্ন।

‘ কোচবিহারের দিকে। আর যদি পৈতৃক বাড়ি জিজ্ঞেস করেন, সেটা বেলঘরিয়াতে। ‘

‘ বেলঘরিয়া মানে সেই দমদমের পরের স্টেশন?’

‘ আজ্ঞে। আপনি তো জানেন দেখছি। ‘ একগাল হেসে বিক্রম বলল।

‘ কেউ থাকে সেখানে? ‘

‘ থাকে বৈকি। আমার দুই কাকা এবং তাদের পরিবার। ‘

‘ যাতায়াত আছে ? ‘

এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিক্রম বলল – ‘ বহুদিন যাওয়া হয়নি। ছোট বেলায় একবার গিয়েছিলাম, মনে আছে। সেটাই শেষ।আমার বাবা চা বাগানে কাজ পেয়ে চলে আসেন এদিকে। সেই থেকে আমরা উত্তরবঙ্গবাসী হয়ে গেছি। ‘

‘ যাতায়াত নেই কিন্তু যোগাযোগ তো হবে? ‘

‘ হুম, তা আছে। আজকাল ফেসবুক আর হোয়াটস অ্যাপের দৌলতে যোগাযোগ করাটা বিশেষ বড় ব্যাপার না। ‘

ইতিমধ্যই শ্রাবন্তী কিছু জলখাবার নিয়ে এলো। কিছু লুচি ও তরকারি। খাবারের থালাটা মৃত্যুঞ্জয়ের সামনে রেখে নিজে বিক্রমের পাশে গিয়ে বসল।মৃত্যুঞ্জয়ের উদ্দেশে বলল – ‘ আমাদের পরিচয় দার্জিলিং এ। সেখানে ঘুরতে গিয়েছিলাম। প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম। যা হয় আর কি।দার্জিলিং এর চা বাগানের অবস্থা যে খুব ভালো না সেটা হয় তো আপনি জানেন। বিক্রমের রোজগার খুব একটা ভাল হত না সেখানে।আর এদিকে আমি তো প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। বিয়ে করব তো একেই। শেষে আমার জেদের সামনে হার মেনে বাবা নিজের দোকানে কাজ করার প্রস্তাবটা দেয়।তবে থেকে বিক্রম এখানেই আছে। ‘

শ্রাবন্তী বেশ খোলা মনে কথাগুলো বলে গেল।

‘ আপনারা ওই বাড়িতেই তো থাকতে পারতেন?’ প্রশ্ন করল মৃত্যুঞ্জয়।

ঈষৎ বিষন্ন হয়ে গেল শ্রাবন্তীর মুখ।

‘ পারতাম। কিন্তু আমার কাকার আপত্তি ছিল।কাকা শুরু থেকেই এই বিয়ের বিরুদ্ধে। ‘

যে ঘরে তারা বসেছিল, সেই ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার পথ। দরজায় তালা।

‘ ওই ঘরটা কি বন্ধ থাকে? ‘ জিজ্ঞেস করল মৃত্যুঞ্জয়।

‘ হ্যাঁ। আমাদের একটা ঘরেই কাজ চলে যায়। যদি কোনো দিন গেস্ট আসে, তাহলে তাদের ওই ঘরে থাকতে দি। ‘ শ্রাবন্তী বলল।

খাওয়া শেষ করে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল মৃত্যুঞ্জয়।যাওয়ার আগে বিক্রম থেকে নিয়ে নিল তাদের পৈতৃক বাড়ির ও কোচবিহারের বাড়ির ঠিকানা।

মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই তিস্তার মনমেজাজ খুব একটা ভাল ছিল না। নিজের নিরুদ্দেশ ছেলের শোকে তার মায়ের শরীর দিনে – দিনে অবনতির দিকে এগোচ্ছে। সুধাকরবাবু ইতিমধ্যেই বেশ কিছুবার থানার চক্কর লাগিয়ে নিয়েছেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বড়বাবুর এককথা – ‘আমরা খুঁজছি। ‘

পরদিন সকালে মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে তিস্তা দীনবন্ধুবাবুর বাড়ির দিকে রওনা দিল।তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল যখন দীনবন্ধুবাবুর কাছে সে জানতে পারল যে মৃত্যুঞ্জয় আজ ভোরে কোথাও চলে গেছে। কোথায় গেল মৃত্যুঞ্জয়? তাহলে কি সে আর তিস্তাকে সাহায্য করবে না?  পুলিশের ওপর তিস্তার শুরু থেকেই বিশ্বাস ছিল না। চারপাশে নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে স্নিগ্ধ আভা হয়ে ফুটে উঠেছিল মৃত্যুঞ্জয়ের আবির্ভাব।কিন্তু সেই আভাটাও এখন নিরুদ্দেশ। তিস্তার মুখ আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। দীনবন্ধু সরকার তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললেন – ‘চিন্তা করিস না, মা।মৃত্যুঞ্জয় ঠিক ফিরে আসবে। আমি তাকে বহু বছর ধরে চিনি। তখন আমরা কলকাতায় থাকতাম। আমার মেয়ে খুন হয়ে গিয়েছিল।সেই কেসটা মৃত্যুঞ্জয় তদন্ত করেছিল। আমি আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম যে আমার মেয়ের খুনি কোনো দিন ধরা পড়বে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় হাল ছাড়েনি।খুনিকে আদালত পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়। আমি জানি, যে দায়িত্ব সে নেয় সেটা পুরো না করা অবধি সে শান্তি পায় না। চিন্তা করিস না, মৃত্যুঞ্জয় ঠিক ফিরে আসবে। ‘

 

  পর্ব – ৪

দু ‘ দিন ধরে মৃত্যুঞ্জয়ের কোনো খোঁজ খবর নেই। তিস্তা অনবরত তাকে ফোন করে চলেছে, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। মৃত্যুঞ্জয়ের ফোন সুইচঅফ। মৃত্যুঞ্জয়ের ওপর থেকে ধীরে – ধীরে আস্থা হারিয়ে ফেলছিল তিস্তা। এর মধ্যে পুলিশ অল্প সক্রিয় হয়েছে।কসমেটিক্সের দোকান তোলপাড় করে রেড মারল পুলিশ। কিছুই পেল না সেখান থেকে। আবারও নীলকন্ঠকে থানায় উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। জেরা করা হলো বেশ অনেকক্ষণ।নতুন তথ্য কিছুই পেল না পুলিশ। অগত্যা ছেড়ে দিতে হল নীলকন্ঠকে। থানার বড়বাবু সুধাকর ঘোষালকে বললেন – ‘ ওই নীলকন্ঠই গন্ডোগোল করেছে।কোনো প্রমাণ পাচ্ছি না তাই ছেড়ে দিতে হচ্ছে। শালা, দোকানের একলা মালিক হওয়ার ফিকিরে আছে। কিন্তু আমি যতদিন আছি, সেটা সম্ভব হতে দেব না। ‘

গভীর বিষন্নতায় থাকার দরুণ রাত্রে ভালো ঘুম হয় না তিস্তার। আদৌ কি তার দাদা কোনোদিন ফিরে আসবে? আদৌ কি আর কোনোদিন নিজের দাদার মুখে ‘ রুমি ‘ ডাক শুনতে পাব? রাখীও ভাইফোঁটার পর্ব কি বিষাদের গভীর সাগরে ডুবেই কেটে যাবে তিস্তার? চোখের জল সে ফেলে না।এখনও নিজের মাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছে সে। যদি তিস্তা চোখের জল ফেলে তাহলে তার মায়ের মনোবল তো আরও পড়ে যাবে।সারারাত প্রায় জেগেই কাটাল তিস্তা। তাই ভোরের দিকে চোখ লেগে গিয়েছিল। ঠিক সে সময় তার মোবাইল বেজে উঠল। ধড়ফড় করে উঠে বসল সে।মোবাইলের দিকে দেখল সে। দেখেই অবাক। অদ্ভুত এক তৃপ্তি পেল সে। এক এমন তৃপ্তি যেটা বর্ণনা করা সম্ভব না। ফোন তুলল সে – ‘ হ্যালো ! ‘

‘ অনেক জরুরি কথা আছে আপনার সাথে। আমি বারোটা নাগাদ পৌঁছবো। আপনি কি বাসস্ট্যান্ডে আসতে পারবেন? ‘ কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেল মৃত্যুঞ্জয়।

‘ পারব, পারব আমি। আপনি ছিলেন কোথায়? বহুবার আপনার ফোন ট্রাই করলাম। ‘ কথাগুলো বলতে গিয়ে অচিরেই তিস্তার গলা ভারী হয়ে এল।

‘ সব বলব আপনাকে। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করুন। ‘

সেই থেকে আর ঘুম হল না তিস্তার। অধীর আগ্রহে বসে থাকল বেলা বারোটা বাজার অপেক্ষায়। তাহলে দীনবন্ধুবাবু ঠিক কথাই বলেছিলেন।মৃত্যুঞ্জয় যে কাজের দায়িত্ব নেয়, সেটা শেষ না করা পর্যন্ত সে শান্তি পায় না।

বাড়িতে কাউকে জানায়নি তিস্তা। বাসস্ট্যান্ড বাড়ি থেকে একটু দূর, তার এগারোটা বাজার সাথে – সাথেই তিস্তা বেরিয়ে গেল।মৃত্যুঞ্জয় কোথায় গিয়েছিল, জানে না তিস্তা। কি খবর সে নিয়ে এসেছে, সেটাও জানে না সে। ক্রমে তার হৃদয় স্পন্দন বেড়ে চলেছে।সাড়ে এগারোটা নাগাদ সে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে পৌঁছল। বেশ কিছু বাস সেখানে প্রবেশ করল, বেশ কিছু বাস বেরিয়ে গেল নিজের গন্তব্যের উদ্দেশে।এক কোণাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল তিস্তা। খানিক পর শিলিগুড়ি থেকে একটা বাস ঢুকল সেখানে। পিঠে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে সেই বাস থেকে নামল মৃত্যুঞ্জয়।মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে পেল তিস্তা। মরুভূমির লোকেরা জলের দিকে যেমন ছুটে যায়, ঠিক তেমনই ছুটল তিস্তা মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।যেন মনে হল বহু বছর পথ হারানো পথিক অবশেষে নিজের পথ খুঁজে পেল।

‘ কোথায় চলে গিয়েছিলেন আপনি, কিছু না জানিয়ে? এই কিছুদিন কি অবস্থা হয়েছে আমার, সেটা জানেন না আপনি। ‘ একরাশ অভিমানের স্বরে তিস্তা বলল।

‘ সব বলব আপনাকে, কিন্তু সময় এলে। এখন হাতে সময় খুব কম। ‘ মৃত্যুঞ্জয় বলল।

‘ সময় কম মানে? আমার দাদাকে খুঁজে পাওয়া গেছে? ‘

তিস্তারএইপ্রশ্নেঅল্পবিষন্নতাচলেএলোমৃত্যুঞ্জয়েরমুখে।সেটালক্ষকরলোতিস্তা।

‘ কীহয়েছে , মৃত্যুঞ্জয় ? আপনিচুপকেন ? জবাবদিনআমারপ্রশ্নের। ‘

‘ আপনি চলুন আমার সাথে। নিজের চোখেই সব দেখে নেবেন। ‘ কথা শেষ করে এগিয়ে গেল মৃত্যুঞ্জয়। পেছন – পেছন তিস্তা।

হেঁটে যাওয়ার মত সময় নেই। বাসস্ট্যান্ডে কিছু ভাড়ার ট্যাক্সি ছিল, যেগুলো টুরিস্টদের ঘুরতে নিয়ে যায়। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করল মৃত্যুঞ্জয়।যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি চালককে যে ঠিকানাটা সে বলল, সেটা শুনে চমকে উঠল তিস্তা। ঠিকানাটা তাদের শাড়ির দোকানের।

‘ দোকানে যাবেন কেন আপনি? ‘ জিজ্ঞেস করল তিস্তা।

‘ আগে ট্যাক্সিতে বসুন। ‘

মৃত্যুঞ্জয় প্রায় ধাক্কা দিয়ে তিস্তাকে ট্যাক্সিতে বসিয়ে নিজে তার পাশে বসল।

‘ একটু তাড়াতাড়ি যাবেন মশাই। সময় খুব কম।’

‘ ব্যাপারটা কি, মৃত্যুঞ্জয়? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ‘

খানিক চুপ থেকে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল মৃত্যুঞ্জয়, তারপর বলল – ‘ আমি কলকাতা গিয়েছিলাম।এই কেসের গোপন রহস্য ভেদ করতে আমাকে সেখানে যেতেই হত। শুরুতে সেই দোকানে গেলাম যেখান থেকে সুপ্রিয় কসমেটিক্স কিনত। অনেক গোপন তথ্য সেখান থেকে উদ্ধার হল।যখন কলকাতা গেলাম, তখন আরও একটা তথ্য জানবার ইচ্ছে হল। তাই রওনা দিলাম বেলঘড়িয়ার উদ্দেশে।সব তথ্য সংগ্রহ করার পর কলকাতা থেকেই এখানকার থানায় ফোন করলাম।অনিচ্ছা সত্বেও থানার বড়বাবুকে নিজের পরিচয় দিতে হল।যদি পরিচয় না দিতাম, তাহলে হয় তো কাজ হত না। ‘

‘ থানার বড়বাবু তো সুপ্রিয়র দোকান সার্চ করেছে। নীলকন্ঠদাকে আবার থানায় নিয়ে গিয়েছিল। ‘ তিস্তা বলল।

‘ জানি। সেটা আমার ফোন করার আগে। কাল রাতে বড়বাবুর সাথে আমার কথা হয়েছে। এতক্ষণে হয় তো পুলিশ নিজের কাজ সেরে নিয়েছে। ‘

মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইল বেজে উঠল। তিস্তা শুধু মৃত্যুঞ্জয়ের কথাগুলোই শুনতে পেল।

‘ হ্যাঁ বড়বাবু, বলুন …. কি পেলেন? ওঃ .. তাহলে পেলেন তো …. ঠিক আছে .. আপনি এগোন, আমিও আসছি। ‘ ফোন রেখে দিল মৃত্যুঞ্জয়।

তিস্তার কাছে এখনও কিছুই পরিস্কার না।কি হচ্ছে এবং কি হতেচলেছে, কিছুই তার মাথায় আসছে না। এতো কিছু জানার তার দরকার নেই।তার শুধু প্রয়োজন নিজের দাদাকে নিয়ে। মৃত্যুঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করল – ‘ আমার দাদা কোথায়, মৃত্যুঞ্জয়? তার কোনো সন্ধান পেলেন ? ‘

মৃত্যুঞ্জয় আড়চোখে তাকাল তিস্তার দিকে। বলল – ‘ মনে আছে আপনার, সেদিন আপনার বাড়ি গিয়ে সুপ্রিয়র ঘর থেকে কিছু নেলপলিশ ও কিছু লিপস্টিক আমি নিয়েছিলাম ? ‘

‘ মনে আছে। ‘

‘ ওই নেলপলিশ ও লিপস্টিক আমি সাজগোজ করার জন্য নিশ্চই নিইনি। তার পেছনে কারণ ছিল। যে কারণটা একটু পরেই আপনি জানতে পারবেন।ওই কারণের জন্যই আপনার দাদা নিরুদ্দেশ। ‘

দোকান চলে এল। এক দিক দিয়ে তাদের ট্যাক্সি ও অন্য দিক দিয়ে পুলিশের গাড়ি একসাথে দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। ক্রেতাদের খুব একটা ভিড় দোকানে ছিল না। দু – এক জন ক্রেতা ছিলেন, তাদের বিক্রম শাড়ি দেখতে ব্যস্ত ছিল।একদিক দিয়ে পুলিশের দল ও অন্য দিক দিয়ে তিস্তা এবং মৃত্যুঞ্জয়কে ঢুকতে দেখে সুধাকর এবং সুধাময় ঘোষাল চমকে গেলেন। সুধাময়বাবুর গলা থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে গেল – ‘ আপনারা ! ‘

সুধাময়বাবুর কথার জবাব কেউ দিল না।

মৃত্যুঞ্জয় এগিয়ে গেল বিক্রম পালিতের দিকে। তাকে বলল – ‘ বিক্রমবাবু, আপনার বন্ধ ঘরের রহস্যভেদ হয়ে গিয়েছে। ‘

বিক্রম পালিত চমকে উঠল – ‘ মানে ? ‘

‘ মানে আপনি জানেন না বুঝি? ঠিক আছে, মানে আপনাকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে থানায়। ‘

‘ থ – থ – থানায় কেন? আ – আমি কি করেছি ? ‘

‘ কসমেটিক্সের ব্যাবসা তো সুপ্রিয় করত। আপনার সেই বন্ধ ঘরে প্রায় কুড়িটা নেলপলিশের শিশি পাওয়া গেছে। ‘ বলল মৃত্যুঞ্জয়।

‘ তাতে কি হয়েছে? বাড়িতে নেলপলিশ রাখা কি অন্যায়? ‘ এবার সুধাময়বাবু বললেন, গলার স্বর ঈষৎ উচ্চ।

‘ না, একেবারেই অন্যায় না, যদি সেই নেলপলিশ সামান্য নেলপলিশ হয়। একটা নেলপলিশের শিশির দাম যদি হাজার – হাজার টাকা হয়, তাহলে সেটা ভাবতে বাধ্য করে। ‘ মৃত্যুঞ্জয় বলল।

‘ নেলপলিশের শিশির দাম হাজার – হাজার টাকা ! ‘ বিস্ময়ে কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে গেল তিস্তার।

‘ হ্যাঁ তিস্তা। ‘ মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ এক – একটা নেলপলিশের দাম প্রায় পনের থেকে কুড়ি হাজার টাকা।এত দামী নেলপলিশের ব্যবসা আপনার দাদা করত, সাথে বিক্রম পালিত। এইগুলো আদৌ নেলপলিশ নয়, তিস্তা। ‘

‘ তাহলে কি? ‘

‘ এগুলো ড্রাগস্। ‘

‘ ড্রাগস্! ‘ তিস্তার সাথে অনেকেই চমকে উঠলেন।

‘ হ্যাঁ। নেলপলিশের শিশির পরীক্ষণ করানো হয়েছে। নেলপলিশের শিশির ভেতর যে জিনিসটা পাওয়া গেছে, সেটাকে বলা হয় ” লিক্যুইডহেরোয়িন ” ।

মৃত্যুঞ্জয়ের কথা শুনে প্রত্যেকে থ।

‘ তিস্তা, আপনার দাদা আপনার জামাইবাবুর সাথে মিলে ড্রগসের ধান্দা করত। আপনার দাদার কি হয়েছে, সেটা এবার বিক্রমবাবুই ভাল বলতে পারবেন। বিক্রমবাবু, আপনার বাড়ি থেকে যা পাওয়া গেছে সেটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।কলকাতার যেখান থেকে আপনারা হেরোইন কিনতেন সেখানে অলরেডি নারকোটিক্স ডিপার্টমেন্ট রেড করেছে। আপনার ও সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই, বাঁচবার আর কোনো উপায় নেই।এবার বলুন, সুপ্রিয় তো আপনার পার্টনার ছিল, তাকে খুন করলেন কেন? ‘

তিস্তার ও সুধাকরবাবুর আর কোনো সন্দেহ রইল না যে সুপ্রিয় আর এই দুনিয়াতে নেই। হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল তিস্তা।

মূর্তির ন্যায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বিক্রম পালিত। পুলিশের কিছু সিপাহী তাকে অ্যারেস্ট করতে যাবে,  ঠিক সে সময় সুধাময়বাবু বলে উঠলেন – ‘ দাঁড়ান। যদি খুনের কারণে অ্যারেস্ট করা হয়, তাহলে আমাকে করুন। সুপ্রিয়র হত্যা আমি করেছি। ‘

 

 

পর্ব – ৫

 

সবাই থানাতে একত্র হয়েছে। দুটো পাশাপাশি চেয়ারে বসে বিক্রম ও সুধাময় ঘোষাল। তাদের দুজনকে ঘিরে আছে থানার বড়বাবু, মৃত্যুঞ্জয়, সুধাকর ঘোষাল এবং তিস্তা। সুধাময়বাবু বলছেন – ‘ মানুষের জীবনে শুধু একটা জিনিসের প্রয়োজন, সেটা হল টাকা। যার কাছে টাকা নেই, তার সমাজে কোনো মান – সম্মান নেই। মান – সম্মান ছিল না বিক্রমের। আমার নিজের ভাই বিক্রমকে কোনো দিন সম্মান দিতে পারেনি।আমার মেয়ে নাকি বংশের মুখে চুন – কালি মাখিয়েছে। আমি নিজের বড় মেয়ের বিরুদ্ধে কোনোদিন যাইনি।তাই বিক্রমকে বিয়ে করার তার সিদ্ধান্তটা অগত্যা আমাকে মানতেই হল। আমার লক্ষ্য ছিল বিক্রমকে তার সম্মান পাওয়ার যোগ্য করার। আর সম্মান মানুষে একটি জিনিসে পায়, টাকায়। ‘

কথা শেষ করে থামলেন সুধাময় ঘোষাল। অল্প জল পান করে পুনরায় বলতে শুরু করলেন – ‘ সে রাতে সুপ্রিয় কারুর সাথে ফোনে কথা বলছিল।আমি তাদের কথা আড়াল থেকে শুনে ফেলি।ড্রাগস্‌ এর ব্যাপারে কথা হচ্ছিল তাদের মধ্যে। আচমকা আমাকে দেখে সুপ্রিয় ভয় পেয়ে আঁতকে ওঠে।ঠিক তখনই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল। আমি সুপ্রিয়কে বললাম যে আমি টাকা ইনভেস্ট করব। শর্ত এটাই যে এই ব্যবসাতে বিক্রমকেও নিতে হবে।কলকাতার মার্কেটের সাথে সুপ্রিয়র ভাল পরিচয় ছিল। সে ওখান থেকে মাল নিয়ে আসত, এখানে বিক্রি করার দায়িত্ব ছিল বিক্রমের। মাঝে – মাঝে বিক্রমকেও যেতে হত কলকাতা। বেশ সুন্দর চলছিল সব কিছু। বিক্রমের ভালো অর্থ রোজগার হচ্ছিল। স্বচ্ছন্দে চলছিল আমার মেয়ের সংসার।একদিন হঠাৎ সুপ্রিয় বলল সে নাকি এ ধান্দা করবে না আর। এবার নাকি সে সাধুপুরুষ হয়ে থাকবে। আমি তাকে বোঝালাম যে সে যদি না করে, না করুক। কলকাতার মার্কেটের সাথে ভাল পরিচয় করিয়ে দিক বিক্রমের। কিন্তু সেটাও সে করাল না।কলকাতায় গিয়ে সে বলে এল যে তার আর মাল চাই না। যা পেমেন্ট বাকি ছিল, সব দিয়ে এল। আমি আর বিক্রম মিলে কলকাতার মার্কেটের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বাধা সৃষ্টি করল সুপ্রিয়। অগত্যা তাকে পথ থেকে সরানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ‘

‘ শালা বেইমান …. তুই ভাই না শত্রু আমার? ‘ সুধাময়ের দিকে তেড়ে গেলেন সুধাকর ঘোষাল। থানার বড়বাবু , তিস্তা ও মৃত্যুঞ্জয় মিলে তাকে আটকাল।

‘ কুপথে তো অনেকেই যায়, কিন্তু নিজের ভুল বুঝে যে সুপথে আসতে চায়, তাকে আসতে দেওয়া উচিত। আপনি তাকে সুপথে আসতে দেননি, সুধাময়বাবু। এর শাস্তি তো আপনাকে পেতে হবেই। সুপ্রিয়র লাশ কোথায় লুকিয়েছেন, সেটা বলবেন কি? ‘ কথা শেষ করে মৃত্যুঞ্জয় তিস্তা ও সুধাকর ঘোষালের দিকে তাকাল। দুজনেরই চোখ দিয়ে বয়ে চলেছে অফুরন্ত অশ্রুধারা।

 

সকাল প্রায় দশটা বাজে। নিজের ঘরে ব্যাগ প্যাক করতে ব্যস্ত মৃত্যুঞ্জয়। হঠাৎ পেছন থেকে তিস্তার কন্ঠস্বর শুনতে পেল সে।

‘ কোথাও যাচ্ছেন? ‘

পেছন দিকে তাকিয়ে দেখল মৃত্যুঞ্জয়।

‘ যেতে হবে। ‘

‘ কোথায় ? ‘

‘ দেখি কোথায় যাই। ‘

‘ মানে ? কত দিনের জন্য যাবেন ? ‘

‘ ফিরে আসব কিনা সন্দেহ আছে। ‘

চমকে উঠল তিস্তা।

তিস্তার দিকে এগিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল – ‘ তিস্তা, আমার পরিচয় যত গোপন থাকে, ততই ভাল। আমার অতীত খুব একটা ভাল না।আমি এখানে নিজের পরিচয় লুকিয়েই ছিলাম। এখানে যখন অনেকে আমার আসল পরিচয় জেনে গেছে, তখন আর এখানে থাকা চলবে না আমার।দুঃখ শুধু এটাই রয়ে গেল যে আপনার দাদাকে ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। ‘

‘ আপনি যেটা করলেন সেটা কিছু কম নয়। খারাপ লাগছে আমার। আমার জন্য আপনাকে নিজের ঠাঁই ছাড়তে হল। একটা প্রশ্ন আপনাকে জিজ্ঞেস করি? ‘

‘ অবশ্যই। ‘

‘ কলকাতা গিয়ে আপনি কি এমন তথ্য পেলেন যার ভিত্তিতে এটা বুঝলেন যে বিক্রম পালিত দোষী? ‘

অল্প হাসল মৃত্যুঞ্জয়।

‘ জানতে চান? খুব একটা কঠিন ছিল না। সুপ্রিয় কলকাতায় যেখান থেকে কসমেটিক্স কিনত সেখানে গেলাম। ঠিকানাটা নীলকন্ঠ দিয়েছিল।সেখান থেকে যখন খুব বেশি তথ্য পাওয়া গেল না তখন এক কর্মচারীকে আড়ালে কিছু টাকা দিয়ে গোপন তথ্য জানবার চেষ্টা করলাম। যেখান থেকে সুপ্রিয় লিক্যুইড হেরোইন কিনত সেখানকার ঠিকানা পেলাম। সেই কর্মচারী না কি সুপ্রিয়কে এই ধান্দার প্রলোভন দিয়েছিল। যাই হোক, কলকাতার নারকোটিক্স ডিপার্টমেন্টকে খবর দিয়ে সেখানে গেলাম। যেখান থেকে জানতে পারলাম যে সুপ্রিয়র সাথে মাঝে – মাঝে এক অন্যলোকও আসত সেখানে।কে সে? সুপ্রিয় যে একলা কলকাতা যেত না সে টা সুপ্রিয়র ঘরে সেদিন জানতে পেরেছিলাম।ডাস্টবিন থেকে একটা ট্রেনের টিকিটের টুকরো পাই আমি। নিউজলপাইগুড়ি থেকে শিয়ালদা, দার্জিলিংমেল। টিকিটে দুটো বার্থ রিসার্ভ করার উল্লেখ ছিল। তাই বলা হয় ম্যাডাম , কোনো জিনিসকে তুচ্ছ ভাবতে নেই। ” যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই।পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন। ”  যাই হোক, সেই ঠিকানা থেকে যারা – যারা ড্রাগ কিনত তাদের ভিডিও করে রাখত একজন নিজের মোবাইলে। সেখান থেকে সুপ্রিয় ও বিক্রমের ভিডিও পেলাম। বেলঘড়িয়া, বিক্রমের পৈতৃক বাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম যে তার বাবারা তিন ভাই। দু ‘ ভাই এখনও বেলঘড়িয়াতেই থাকে। সুদের ব্যবসা ছিল তাদের।একদিন বিক্রমের বাবা বেশ কিছু টাকার হেরফের করে সেখান থেকে স্বপরিবারে উধাও হয়ে যায়। কিছু জিনিস শুরুতেই মনে খটকা দিয়েছিল আমায়।প্রথমত বিক্রমের সাথে দেখা করার কথাতে সুধাময়বাবুর বাধা দেওয়া, এবং দ্বিতীয়ত বিক্রমের দরকার থেকে বেশি আপ্যায়ন করা। ‘

কথা শেষ করে থামল মৃত্যুঞ্জয়।

‘ তার মানে সেদিন দাদা আর নীলকন্ঠদার মধ্যে কি ড্রাগ নিয়েই ঝামেলা হয়েছিল ? ‘

‘ একদম ঠিক। নীলকন্ঠ জানতে পারে যে তাদের কসমেটিক্সের সাথে ড্রগও আনা হচ্ছে। পুলিশকে খবর দিয়ে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার ধমকি দেয় সে।তাই এতো আপসেট থাকত আপনার দাদা। ‘

মৃত্যুঞ্জয়ের বেরবার সময় চলে এল। তিস্তা তাকে ছাড়তে গেল বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। ইচ্ছেকরল, মানা করুক মৃত্যুঞ্জয়কে যেতে। কিন্তু যে যেতে চায়, তাকে কেউ আটকাতে পেরেছে?

‘ যেখানেই থাকুন, যোগাযোগ রাখবার অনুরোধ রইল। ‘ বিষাদে ভরা মুখে তিস্তা বলল।

জবাবে শুধু অল্প হাসল মৃত্যুঞ্জয়।

বাস ছেড়ে দিল। যতক্ষণ বাসকে দেখা যায়, দেখতে থাকল তিস্তা।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 2 =