রবীন্দ্রসদন, মেট্রো রেলওয়ে স্টেশনের রহস্য
তাপসকিরণ রায়, জব্বলপুর, মধ্যপ্রদেশ ##
ইউ.টিউব চ্যানেলের সন্ধান পাবার পর থেকে শশী ভূষণ তা মাঝে মধ্যে খুলে বসেন। এবার ওরা ভূত দেখতে কোথায় যাবেন মনের মধ্যে এমনি একটা প্রশ্ন তার লেগে ছিল। দেখতে দেখতে তার মনে পড়ে গেলো কলকাতার মেট্রো রেলওয়ে স্টেশনের কথা। তিনি সার্চে লাগালেন, কলকাতার মেট্রো স্টেশনের ভূত, লিখে। বেরিয়ে এল বেশ কিছু অডিও-ভিডিও। কিছু কিছুতে স্টেশনের, ট্রেনের ও ট্রেনযাত্রীদের চলমান দৃশ্যছবি রয়েছে। কোনটাতে আবার রহস্য ভৌতিক ছায়ার স্পট ফেলে তার ওপর বক্তব্য রাখা হয়েছে। এমনি এক ভিডিও থেকে তিনি পেলেন এমনই এক বিবৃতি–
“দক্ষিণ কলকাতার রবীন্দ্র সরোবরের কাছে অবস্থিত রবীন্দ্রসদন কলকাতা মেট্রোর ব্যস্ততম একটি রেলওয়ে স্টেশন, কিন্তু কলকাতার ভুতুড়ে জায়গাগুলির মধ্যে এটি একটি। উইকিপিডিয়া অনুসারে কলকাতা মেট্রোর অধিকাংশ আত্মহত্যা ঘটেছে এই স্টেশনে এবং সে কারণেই এ স্টেশন ভুতুড়ে স্থান হিসেবে পরিচিত। ইতিহাস বলে, ২০১৫ সালের ৭ই মে-তে স্টেশনের কাছে একটি ড্রাইভার ইমার্জেন্সি ব্রেক ব্যবহার করায় তাকে কিছু দিনের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। পরে ওই ড্রাইভার জানায় যে টানেল চ্যানেলের মধ্যে সে কোন আত্মাকে দেখে ব্রেক কষে কিন্তু তার পরেই তার চোখে কিছুই পড়ে না। এমন কি ওই মাসে আরও একবার এই রকম ঘটনা ঘটেছে। এ ধরণের ঘটনার ফলেই হবে এই স্টেশন মাঝে কিছুদিনের জন্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
লাস্ট ট্রেনে যাওয়া যাত্রীদের মুখে শোনা যায় যে প্রায়ই ওই সময় স্টেশনে কারও ছায়া দেখতে পাওয়া যায় কিছুক্ষণ পরে আবার সেগুলো মিলিয়ে যায়। এমন কি অনেকের মতে যখন লাস্ট ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যায় তখন কিছু ছায়া তারাও লক্ষ্য করেছেন। এত কিছুর পরেও আপনি কি বলবেন যে ভূত বলে কিছু নেই ?”
মোবাইল পাশে রেখে এবার শশী সোফায় গা এলিয়ে বসলেন। বোধহয় মেট্রো রেলের অলৌকিক ঘটনা নিয়েই তিনি কিছু ভাবছিলেন। এমনি সময় অর্ণব এসে হাজির হল। অর্ণব সোফায় বসে শশীকে কিছু ভাবতে দেখে বলে উঠলেন, এবার থেকে তোকে শশিভূষণ বলে ডাকবো।
–কেন ? কৌতূহলী প্রশ্ন করেন শশিভূষণ।
–এই নাম থেকে বড় কোন ডিটেকটিভের গন্ধ আসে, অর্ণব হেসে বললেন।
–এ সব কথা ছাড়, শশী চুপ করালেন অর্ণবকে।
–কেন গুরু–তুই সত্যান্বেষী আর তোর অ্যাসিস্ট্যান্ট হল জনান্তিক, জনান্তিক নামটাও তোর সহকারী হিসাবে কি জমেছে দেখ ?
এমনি সময় জনান্তিকের ফোন এলো, শশী কি করছিস ?
শশী–এই অর্ণবের সঙ্গে গল্প করছি।
জনান্তিক–বলছিলাম অনেক দিন হল চুপচাপ বসে আছি, কিছু একটা প্রোগ্রাম কর! শশী–আগামী রবিবার চল তা হলে–
জনান্তিক—কোথায় ?
শশী–রবীন্দ্রসদন মেট্রো রেল স্টেশনে।
তারপরই তিন বন্ধু ঠিক করলেন আগামী রবিবার রাতে ওরা মেট্রো রেল স্টেশনে যাবেন। এখানেও রাতের অভিযান থাকবে, শেষ মেট্রো রবীন্দ্রসদন পাস করার সময় থেকেই নাকি সব অলৌকিক ঘটনাগুলি সেখানে ঘটতে থাকে। রাত দশটা কুড়িতে রাতের শেষ ট্রেন।
শশীবাবু ওরা রাত দশটার মধ্যেই পৌঁছে গেলেন রবীন্দ্রসদন মেট্রো স্টেশন। এখানে চার-পাঁচজন প্যাসেঞ্জার হাঁটাচলা করছে, যারা শেষ ট্রেন ধরে দমদমের দিকে এগোবেন। তিনটে টিকিট কেটে তিন বন্ধু গিয়ে হাজির হলেন স্টেশনে। দিনের হৈহল্লা এখানে আর নেই। রাত শুরুর ব্যস্ততা এখানে নেই। গোনাগুনতি কয়েক জন যাত্রী প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের অপেক্ষা করছে।
–চল আমরা ঐ দিকে এগোই, শশী বাবু বললেন।
–কেন ওই দিকে কেন? অর্ণব জিজ্ঞাসা করলেন।
ওদিকে স্টেশনের শেষ দিকেই নাকি টানেল চ্যানেলের পাশটায় ভৌতিক ঘটনাগুলি ঘটে, শশীভূষণ বলে চলেছেন। ওঁরা তিন জন নিঃশব্দে সে দিকে এগিয়ে গেলেন। এ দিকে অপেক্ষাকৃত আলোর প্রভাব বেশ কম হবে। স্টেশন কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ বাঁচাতে এদিকের লাইটগুলির কিছু নিভিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। কয়েক জন যাত্রী এই বিরাট স্টেশনের নির্জনতাকে ভাঙতে পারেনি। মাঝে মধ্যে দূর থেকে দু-এক জন যাত্রীর কথাবার্তা শশী বাবুদের কানে এসে ঠেক ছিল।
হঠাৎ ট্রেনের সামান্য গমগম আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো। জনান্তিক বললেন, ট্রেন আসছে।
শশীভূষণ বললেন–হ্যাঁ, কিছু সময় আগে থেকেই ট্রেন আসার আওয়াজ পাওয়া যায়। ট্রেন আধ মিনিটের মধ্যেই প্লাটফর্মে এসে ঢুকল। আর পনের কুড়ি সেকেন্ডের মত দাঁড়িয়ে আবার হুশ করে বেরিয়ে গেল।
–কেউ কেঁদে উঠল কি? শশীবাবুর কান খাড়া করলেন।
জনান্তিক বলে উঠলেন, আমিও যেন শুনলাম, একটা মেয়েলি আওয়াজ মনে হল।
–না, অর্ণব ভয় পেলেন। তিনি দুই বন্ধুর মাঝখানে এসে বলে উঠলেন, কিন্তু আমার তো মনে হল গাড়ির ব্রেক কষার শব্দ! ট্রেনকে স্লো করার চেষ্টা করলে সামান্য ব্রেক লাগলে যেমনটা শব্দ হয়–অর্ণব বন্ধুদের বোঝাবার চেষ্টা করলেন।
না, ওরা স্পষ্ট কেউ ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না।
বন্ধুরা বেশ কিছু সময় স্টেশনের চ্যানেল সুড়ঙ্গের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মনে হচ্ছে, বেশ কিছু সাদাকালো ছায়ারা যেন সেখানে নড়েচড়ে উঠছে ! কিন্তু এ ব্যাপারটা অলৌকিক নাও হতে পারে, হতে পারে স্টেশনের আলো ও ছায়ার মিলিত কারসাজি!
![](https://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2020/12/ghost.jpg)
প্রায় আধ ঘন্টা কেটে গেল লাস্ট ট্রেন চলে গেছে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম একেবারে ফাঁকা। প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি একটা টি-স্টল এখনও খোলা মনে হচ্ছে। শশীবাবু সে দিকে তাকালেন, মনে হচ্ছে স্টল বন্ধ করে লোকটা এখনই বাড়ির দিকে রওনা দেবে। আর হ্যা, স্টল ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ওদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
–চল এক কাপ করে চা পাই কিনা দেখি, শশীবাবু বললেন।
–হ্যা, চল, ও দোকান বন্ধ করছে মনে হয়, অর্ণব বললেন। ওরা দ্রুতগতিতে এগিয়ে গেলেন টি-স্টলের দিকে। জনান্তিক হাঁক দিলেন, ও, ও ভাই, আমরা চা খাব।
টি-স্টলের লোকটা ওদের দিকে খানিক তাকিয়ে থাকল। ও বোধহয় ঠাহর করার চেষ্টা করল, সামনের মানুষগুলি সত্যি মানুষ, না কি অশরীরী ? কিছুটা আস্বস্থ হয়ে হবে সে বলল, তাড়াতাড়ি আসুন, আমি স্টল বন্ধ করছি।
জনান্তিক ওরা পৌঁছে গেলেন স্টলের কাছে। কফি-কাম-টি মেকারে চা দুধ চিনি দিয়ে সুইচ অন করতেই, চার দিকের স্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ, স্যাঁ স্যাঁ আওয়াজ করে চা তৈরি হয়ে গেল। বাহ বেশ লাগছে, এই চায়ের যেন খুবই প্রয়োজন ছিল ওঁদের কাছে। ঠাণ্ডা-গরমের মাঝামাঝি একটা মরশুম চলছে, তবুও ওরা শরীরে বেশ ঠাণ্ডা ভাব অনুভব করছিলেন। ভয়-আশঙ্কায় এমনটাই বুঝি হয়!
–আমি যাচ্ছি, স্টলওয়ালা বলল, আপনারা এখানে বেশি সময় থাকবেন না যেন–
–কেন ? কেন ?? অপূর্ব যেন ভয় পেয়ে প্রশ্ন করে উঠলেন।
স্টলের লোকটা বলল, ওই, এখানে নাকি ভূত আছে!
–আপনি দেখেছেন নাকি কোন কিছু ? শশী বাবু প্রশ্ন করলেন।
লোকটা যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে দাঁড়িয়ে বলল–না, আমার চোখে কিছু পড়েনি, তবে ওই রেল লাইনের টানেল থেকে আমি কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। অবশ্য কান্নার আওয়াজ আমার কানে এসেছে বটে তবে সে আওয়াজ কোন প্যাসেঞ্জারের ছিল কি না তা হলফ করে বলতে পারবো না। তবু বেশি রাতে ফিরতে আমার গা ছমছম করে। আর দাঁড়ালো না স্টলের লোকটা, অনেকটা দ্রুতপদে সে যেন প্লাটফর্ম পার করছিল। শশীবাবু ঘড়ি দেখলেন। রাত এগারোটা বাজতে এখনও পাঁচ মিনিট বাকি। তাঁর মনে হল, আরও ঘন্টাখানেক তাদের তো অপেক্ষা করতেই হবে।
অর্ণব বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, ঐ যে ঐ যে দু’জন লোক আমাদের দিকে–হ্যাঁ দুজন লোক এদিকে এগিয়ে আসছে। এবার স্পষ্ট তাদের দেখা যাচ্ছিল। ওরা রেলের পুলিশ, ওরা সামান্য দূর থেকেই শশীবাবুদের স্পষ্ট ভাবে দেখে নেবার চেষ্টা করছিল। পুলিশ দুজন এবার ওদের সামনে এসে দাঁড়াল, ওদের একজন বলে উঠল, আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে ?
–এই তো চা খেলাম, তাই–শশী বাবু বললেন।
–ঠিক আছে, এবার যান, এখানে থাকবেন না, পুলিশ বলল।
জনান্তিক কৌতূহলী হয়ে বলে উঠলেন, শুনেছি এই জায়গার বদনাম আছে ?
পুলিশ বলল–হ্যাঁ, আছে তো, লোকরা প্রায়ই এখানে এসে সুইসাইড করে। এই তো সাত দিন আগের ঘটনা, আমাদের চোখের সামনে একটা মেয়ে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিল– পুলিশ দম নিয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। ঠিক এমনি সময় আচমকা কেউ যেন ট্রেনলাইনের দিক থেকে তীব্র চিৎকার দিয়ে উঠলো। শশী বাবু ও তাঁর বন্ধুরা একসঙ্গে চমকে উঠলেন। ভীত সন্ত্রস্ত পুলিশ দুটো ওই দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আবার সুইসাইড ? ওরা যেন খানিকটা ভয়ে ভয়ে নিজেদের টর্চ জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল। শশী বাবুরাও ওদের পেছনে পেছনে গিয়ে হাজির হলেন। হাতের টর্চ জ্বেলে জ্বেলে লাইনের উপর দেখছে পুলিশরা। কোন মহিলা হয়ত ট্রেনে কাটা পড়েছে। কিন্তু কই ? কাটা-ছেঁড়া রক্তপাতের কোন চিহ্ন যে লাইনে নেই! বেশ অনেকটা সময় ধরে লাইনের উপর খুঁজে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল পুলিশরা। হঠাৎ ওদের মনে প্রশ্ন এল, তা হলে এটা কোন অতৃপ্ত আত্মার চিৎকার হবে না তো ?
পুলিশরা এবার ভয়ে পালিয়ে যেতে যেতে শশীবাবুদের ডাক দিয়ে বলল, আপনারা এখান থেকে তাড়াতাড়ি পালান–
–না, আর থাকা ঠিক হবে না, জনান্তিক বলে উঠলেন, পুলিশরাই যদি ভয় পায়!
শশীভূষণ বললেন, চল আমরা ফিরব !
ভয়ে অর্ণবের মুখের কথা বুঝি জড়িয়ে আসছিল। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, চল চল, আমার গাটা কেমন শিউরে উঠছে রে!
ব্যস্ততার সঙ্গে তিন বন্ধু ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। পেছনে আলোকিত স্টেশন পড়ে আছে। স্তব্ধতা ঘেরা এক অন্য লোকের নিঃশব্দ গাড়ি যেন এখানে এসে থামবে আর অশরীরীর দল তাতে চেপে বসবে!
ফিরতে ফিরতে হঠাৎ চমকে উঠলেন শশী। স্টেশনের খাম্বায় একটা সাদা ছায়া। মনুষ্য আকৃতির ছায়াটা বারবার নড়েচড়ে উঠছে না! কে জানে কোন আলোর ফোকাস এসে খাম্বার ওপর পড়েছে কিনা। একবার কাছে গিয়ে দেখবেন কিনা ভাবলেন শশী। তারপর অর্ণব ও জনান্তিকের কথা ভেবে আর এগোলেন না তিনি। আজ স্টেশনের যেটুকু দেখার ছিল সবটুকুই যেন তাদের দেখা হয়ে গেছে। তার জের যেন এখনও তাদের গায়ে লেগে আছে, তাই বুঝি তাদের শরীর মাঝে মাঝেই ভয়ে ছমছম করে উঠছে।