রহস্যে মোড়া এরিয়া ৫১

পলাশ মুখোপাধ্যায়

যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা অঙ্গরাজ্যের লাস ভেগাস শহর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তরে মোহাভে মরুভূমির (Mojave Desert) বিশাল এক অংশ – অন্তহীন রহস্যের উৎস। শুকিয়ে যাওয়া বিশাল গ্রুম হ্রদের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত এই এলাকা নিয়ে কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র, গুজব কিছুই বাদ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অত্যন্ত গোপনীয় ঘাঁটি হচ্ছে এরিয়া ৫১ (Area 51)। এটি এতটাই গোপনীয় যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার দীর্ঘদিন এর অস্তিত্বই স্বীকার করেনি। মানচিত্র বা সড়ক নকশা কোন কিছুতেই এরিয়া ৫১ এর উল্লেখ করা হত না। এর আকাশ সীমায় সামরিক বা বেসামরিক কোন ধরনের বিমান প্রবেশ করতে পারে না (কেবল এরিয়া ৫১’গামী বিশেষ বিমান ছাড়া)। ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত রাশিয়া স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নেওয়া এরিয়া ৫১ এর ছবি প্রকাশ করলে প্রথমবারের মত সাধারণ মানুষ এলাকাটির ছবি দেখার সুযোগ পান।

এই এলাকাটির উদ্দেশ্য কি, সে সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই বলে না আমেরিকা সরকার। Area 51 লিখে ৩৭০১৪’৩৬.৫২” উত্তর অক্ষাংশ এবং ১১৫০৪৮’৪১.১৬” পশ্চিম দ্রাঘিমাংশ (37°14’36.52″N, 115°48’41.16″W) এই স্থানাংক ব্যবহার করে গুগল আর্থের মাধ্যমে এলাকাটির ছবি দেথা যায়। বাইরের মানুষের সেখান প্রবেশ নিষেধ। ‘প্রবেশ এবং ছবিতোলা নিষেধ, প্রবেশ করলে প্রাণঘাতী শক্তিপ্রয়োগ হবে’ এই মর্মে নোটিশও হয়েছে। এখানে প্রবেশ করতে গিয়ে বহু কৌতূহলী মানুষের প্রাণ যাওয়ার কথা শোনা গেলেও এর কোন প্রমাণ মেলেনি। যদিও এর চারপাশে সরাসরি চোখে পড়ার মত কোনো প্রাচীর বা বেড়া নেই, অনেকগুলো সাইনবোর্ডে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তবে এই এলাকার চতুর্দিকে সিসি টিভি ক্যামেরা, মোশন ডিটেক্টর, লেজার ডিটেক্টর, সাউন্ড ডিটেক্টর, এমনকি অত্যাধুনিক স্মেল ডিটেক্টর সহ বিভিন্ন প্রযুক্তির প্রয়োগ করা হয়েছে নিরাপত্তাযর স্বার্থে।

আকাশ পথ দেখার জন্য রয়েছে রাডার। এই ঘ্রাণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আশেপাশে থাকা যে কোন মানুষ বা বন্য প্রাণীর অস্তিত্ব তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এখন যদি কেউ কোন ভাবে ঢুকে পড়লে তার অস্তিত্ব ধরা পরবে এই সেন্সর গুলিতে। আর ধরা পড়লেই চলে আসবে সুরক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী। সুরক্ষায় যারা থাকে তারা শুধুমাত্র এরিয়া ৫১ এর সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত। কেউ যদি সব সুরক্ষা ব্যবস্থাকে কাটিয়ে ভিতরে ঢুকলেও রয়েছে বড় সমস্যা। কেননা এই এলাকাটি মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত। তাই, প্রকৃতির সাথে লড়াই করেও এখানে বেঁচে থাকা কষ্টসাধ্য। তাই, প্রাকৃতিক ভাবেও এই এরিয়া ৫১ অনেক সুরক্ষিত।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দলিল থেকে জানা যায়, এখানে সামরিক বিমানের পরীক্ষা চালানো হয়। তবে এখানে অন্যান্য অস্ত্র এমনকি পারমাণবিক পরীক্ষাও চালানো হয় বলে শোনা যায়। এখানে বিমান ওড়ানোর জন্য রানওয়ে, বিমান রাখার হ্যাঙ্গার (বিশেষ ছাউনি) ছাড়াও গবেষণাগার রয়েছে। এখানকার ভবনগুলোয় জানালা নেই এবং বিমানের পরীক্ষামূলক উড়ানের সময় কর্মীদের ঘরের ভেতর রাখা হয় যাতে তারা উড়ান দেখতে না পারে। একদলের গবেষক অন্য দলের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু জানতে পারে না।

অনেকের দাবী এরিয়া৫১ এর আকাশে ফ্লাইং সসারের মত মত কিছু উড়তে তারা দেখেছেন।আবার অনেকেই নাকি এমন দ্রুতগতির বিমান উড়তে দেখেছেন যার গতি সাধারন বিমান বা যুদ্ধবিমান কোনোটার সঙ্গেই মেলে না।

এরিয়া ৫১ বিশ্বব্যাপী ‘ষড়যন্ত্রের এলাকা’ বা Area of Conspiracy নামে পরিচিত ছিল। আগে সরাসরি এই এলাকার কোনো ছবি পাওয়া যেতো না। কিন্তু Cold War চলাকালীন সময়ে রাশিয়া তাদের শক্তিশালী স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই এলাকার অনেকগুলো ছবি তোলে। যা এখন ইন্টারনেটে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। এই এলাকার আশেপাশের লোকজন অনেকটা গুজবের মতই UFO বা Unidentified Flying Object এর গল্প সাজিয়েছে। বাস্তবে তারা যা দেখে তা হচ্ছে এই “এরিয়া ৫১” এর ভেতর তৈরি করা অতি মাত্রার ক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক বিমান। এরিয়া ৫১ এর ভেতর রানওয়ে রয়েছে সাতটি। এখানে এমন বিমান রয়েছে, যা এখনো বাইরের কেউ কল্পনাও করেনি। এখানে যে কর্মীরা কাজ করেন তাদের জন্যে কয়েকটি বোয়িং – ৭৩৭ বিমান রয়েছে।

এরিয়া ৫১ নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু কিছু চলচ্চিত্র, টিভি সিরিয়াল, গেম নির্মিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে হলিউডের বিখ্যাত ছবি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’ তে দেখানো হয়েছে যে ভিনগ্রহের প্রাণীরা এরিয়া ৫১ এর উপর আক্রমণ করেছে এবং এই ছবির শেষ দিকে দেখানো হয়েছে এই প্রাণীদের ব্যবহার করা বিশাল আকারের UFO কে উন্নত প্রযুক্তির মিসাইলের সাহায্যে ধ্বংস করে দেয়া হয়। জেমস বণ্ডের একটি ছবিতেও এরিয়া ৫১ এর ছায়া রয়েছে।

আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) ২০১৩ সালে এক বিবৃতিতে এরিয়া ৫১ এর অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং বলে যে শুধুমাত্র গোপন সামরিক পরীক্ষার জন্যে এ স্থান এতো বেশি সুরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। হয়তো তা-ই হবে। কিন্তু F117 বিমানটি যখন মানুষের সামনে আসে, তখন এর কার্যকারিতা দেখে অবাক হয়েছিলো অনেকেই। সবাই আরো অবাক হয়, যখন শুনতে পারে যে এই বিমানটি আরো প্রায় ২২ বছর আগে তৈরি হয়ে গিয়েছিলো এরিয়া ৫১- এর ভেতরে।

বিল কেইসিং যিনি ছিলেন অ্যাপোলো রকেট ডিজাইন করা কোম্পানি রকেটডাইন-এর একজন ইঞ্জিনিয়ার ও পর্যবেক্ষক। তার লেখা একটি বই “উই নেভার ওয়েন্ট টু দি মুন”। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে তিনি দাবি করেন অ্যাপোলো মিশন ছিল শুধু বড় একটা মিথ্যা। বিল কেইসিং এর মতে নাসার অ্যাপোলো মিশন এর চিত্রায়ন করা হয়েছিল আমেরিকা এর একটি মরুভুমিতে যা এরিয়া ৫১ নামে পরিচিত। রাশিয়ার স্পাই স্যাটেলাইট থেকে এরিয়া ৫১ এর তোলা ছবিতে দেখা যায় সেখানে মুভি সেট রয়েছে এবং কিছু যায়গা চাঁদের পৃষ্ঠের মতো দেখতে। অ্যাপোলো ১০ থেকে তোলা ছবি এবং স্যাটেলাইট থেকে তোলা এরিয়া ৫১ এর ছবির মধ্যে আশ্চর্য রকম মিল খুজে পাওয়া যায়। বিল আরও বলেন এই কারনে এরিয়া ৫১ এত সুরক্ষিত। তিনি মনে করেন চাঁদে যাওয়ার শুটিং স্পট এখনও সেখানে আছে।

নানা মুনির নানা মত, সেই সঙ্গে আমেরিকার মুখে কুলুপ। দুইয়ে মিলে কিন্তু ক্রমশ বাড়িয়ে তুলেছে এরিয়া ৫১ এর রহস্য। তাই গোপন সামরিক ঘাঁটি হোক বা গবেষণাগার; স্বকীয়তা, এবং রহস্যময়তায় অন্যদের সহস্র যোজন পিছনে ফেলে দিয়েছে এরিয়া ৫১।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve − 6 =