সম্পাদকীয়, আগস্ট ২২
আপামর জনগণ যে জিনিসটির উপরে জিএসটি বসানোর জন্য দীর্ঘদিন সওয়াল করে আসছেন সে ব্যাপারে কোনও উচ্যবাচ্য নেই। তার বদলে দৈনিক যে খাবারগুলিই মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে তার উপরেই চাপিয়ে দেওয়া হল জিএসটির বোঝা। সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ এবং দেশের নেতারা। বহুদিন থেকেই আমজনতার দাবী পেট্রোপন্যে জিএসটি বসানো হোক। তাতে সর্বোচ্চ ২৮% কর দিতে হলেও স্বস্তির মধ্যেই থাকবে পেট্রোপন্যের দাম। কিন্তু তা করলে তো সরকারের চলবে না, তারা পেট্রোপন্য থেকে ৬০% এরও বেশি কর আদায় করেন। তাই তাকে জিএসটির আওতায় আনলে সরকারের চলবে কি করে? স্বাভাবিক ভাবেই সরকার সেই রাস্তায় তো হাঁটেননিই, উপরন্তু বোঝার উপরে শাকের আঁটির মত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের উপরে এসে পড়ল জিএসটির খাঁড়া।
গরীব বা মধ্যবিত্ত মানুষ সাধারণত কি খান? চাল ডাল আটা বা নিদেন পক্ষে মুড়ি। হ্যা এই সবের উপরেই বসেছে ৫% হারে জিএসটি। একটাই স্বান্তনা, এগুলি প্যাকেটজাত হলেই তাতে কর বসবে। কিন্তু এখন প্রায় সব কিছুই প্যাকেটজাত। তাই প্রায় সকলকেই দিতে হবে বর্ধিত মূল্য। এখানেই শেষ নয় আরও যে সকল জিনিসপত্রের দাম বাড়তে চলেছে সেগুলি হল প্যাকেটজাত ও লেবেল সাঁটা দই, লস্যি, বাটারমিল্ক, মাংস (বরফে রাখা মাংস বাদে), মাছ, পনির, মধু, গুড়, আটা, মেসলিন ময়দা, শুকনো মাখনা ইত্যাদি। এযাবৎ ব্র্যান্ডেড ময়দা এবং চালে পাঁচ শতাংশ জিএসটি ধার্য করা হত। কিন্তু এবার থেকে ব্র্যান্ডেড না হলেও প্যাকেটজাত এবং লেবেল সাঁটা হলেই ময়দা ও চালের উপর জিএসটি ধার্য করা হবে। এছাড়াও প্যাকেটজাত ও লেবেল সাঁটা খাদ্যের (কর্নফ্লেক্সের মতো) উপর জিএসটি বসানো হচ্ছে। গ্রাম হোক বা শহর, এখন প্রায় সকলেই প্যাকেটের দুধই খেয়ে থাকেন, দাম বাড়ছে তারও। গুরুজনেরা বলেন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে, এখন কিন্তু দুধ এবং ভাত দুটোই দামি।
মাস তিনেক আগেই প্রায় ৮০০ জীবনদায়ী ওষুধের দাম বেড়েছে। আর এবার হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ বাড়তে চলেছে। করোনাকালে হাসপাতালের খরচের বোঝা বেড়েছে করোনা বিধির কারণে যা বর্তমানেও চলছে এবং কতদিন চলবে তার কোনও স্পষ্ট নয়। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হল জিএসটির অতিরিক্ত খরচ। কারণ হাসপাতালের দৈনিক শয্যাভাড়া হোক কিংবা ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান্ট, সবের উপরেই জিএসটি বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, এতদিন যে সমস্ত শয্যার দৈনিক ভাড়া হিসাবে কোনও ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হত নতুন কর কাঠামোয় এবার থেকে তাকেই দিতে হবে ৫২৫০ টাকা। ফলে খরচ যে কতটা বাড়ছে তা স্পষ্ট। বায়ো মেডিক্যাল ওয়েস্ট বা চিকিৎসা ক্ষেত্রের বর্জ্য নষ্ট করার জন্য বিশেষ প্ল্যান্ট ইনস্টল করা হয় হাসপাতালগুলিতে, তার উপরেও বসছে ১২% কর। অভিজ্ঞ মহল এ বিষয়ে নিশ্চিত যে হাসপাতালগুলি কোনওভাবেই এই খরচ নিজেদের কাঁধে নেবে না, ফলে খরচের বোঝা চাপবে সাধারণ মানুষের উপরেই। আইভিএফের মতো চিকিৎসা এতদিন জিএসটির বাইরে ছিল। এবার তার উপরেও জিএসটি দিতে হবে। এমনিতেই আইভিএফের খরচ অধিকাংশ বিমাতেই অন্তর্ভুক্ত হয় না। ফলে তার বিপুল খরচও যাবে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে।
পকেটে টানাটানি কিন্তু পরিবার বা নিজের আশ মেটাতে দুটো দিন একটু বেড়াবার কথা ভাবছিলেন? সস্তায় দীঘা, পুরি বা তারাপীঠে গিয়ে থাকার দিনও শেষ। কারন এক হাজার টাকা পর্যন্ত হোটেলের যে ঘর এতদিন করের আওতায় ছিল না, এবার তাও জিএসটির কবলে। শুধু বেড়ানো কেন, চিকিৎসা, পেশাগত কারণ, বৈষয়িক কাজ ইত্যাদি নানান প্রয়োজনেই অনেককে হোটেলে রাত কাটাতে হয়। কেউ কেউ চাকরির সন্ধান বা ইন্টারভিউ দিতে এসেও সস্তার হোটেল খোঁজেন, কিন্তু এবার তারাও বেশ চাপে। জিএসটি লাগু হওয়ার সময় সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, সাধারণ মানুষের উপর এবার করের বোঝা হাল্কা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ঠিক তার উল্টো। নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের উপরে জিএসটি চাপিয়ে সাধারণ মানুষকেই আরও বিপদে ফেলা হচ্ছে। কেন্দ্র জিএসটি চাপায় তাই তাদের সরাসরি দোষারোপ করা গেলেও, রাজ্যগুলি কিন্তু দায় এড়াতে পারে না। কারণ জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে কেন্দ্র ও রাজ্যের উপস্থিতিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আগেও আমরা দেখেছি পেট্রোপন্যকে জিএসটির অন্তর্ভুক্ত করবার ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়পক্ষই বাধা দিয়েছে। তাই এবারের এই জনবিরোধী সিদ্ধান্তের দায়ও কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্য দুই পক্ষকেই নিতে হবে। রাজনৈতিক চাপান উতোর চলবে, চলবে পারস্পরিক দোষারোপের নাটক। মাঝে থেকে প্রাণ যাবে প্রজারূপী উলুখাগড়ার।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ