সম্পাদকীয়, জানুয়ারি ২০২২
না, শেষমেশ ধর্ম এবং রাজনীতির যৌথ শক্তির কাছে মাথা নোয়াতেই হল রাজধর্ম বা প্রজাপালনকে। এর আগে একটি লেখাতেই বীরভূম জেলা প্রশাসনকে একটা সাধুবাদ দিয়েছিলাম। এ বছর করোনার বাড়বাড়ন্তে জয়দেব মেলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত তারা নিতে পেরেছিলেন বলে। কিন্তু হায়, প্রশাসন বন্ধ করে দিলে কি হবে, রাজনৈতিক নেতৃত্বরা ফের দায়িত্ব নিয়ে ওই বন্ধ হওয়া মেলা চালু করে দিয়েছেন। বেচারা প্রশাসন। নেতা মন্ত্রীদের মুখ রাখতে তারাও করোনার নিয়ম মেনে ছোট করে মেলা করবার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। আসলে জয়দেব মেলা গঙ্গাসাগর মেলার সঙ্গে একই দিনে বসে, এখানেও কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। দূরদূরান্ত এমনকি বিদেশ থেকেও মানুষজন আসেন জয়দেবে। এবছর তাই মেলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মানুষের কথা ভেবেই মেলা চালু করা হল বলে জানিয়েছেন স্থানীয় মন্ত্রী। এটা অবশ্য হওয়ারই ছিল। রাজ্য সরকার তো যেন তেন প্রকারে গঙ্গাসাগর মেলা করতে বদ্ধ পরিকর ছিল। গঙ্গাসাগর মেলা যদি হতে পারে তো, জয়দেব মেলারও একটা ধর্মীয় ব্যাপার স্যাপার তো রয়েইছে। ব্যস… ধর্ম থাকলে কিসের করোনা ? এবার যদি এই দেখে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বনবিবির মেলা, মনসা মায়ের মেলা, ওলাইচণ্ডী মেলা জাঁকিয়ে বসে, তার দায় কে নেবে? রাজ্য সরকার, নাকি এক্ষেত্রেও সেই আদালতই বলে দেবেন মেলা হবে কি হবে না?
বিতর্কিত সব বলই কোর্টের কোর্টে পাঠিয়ে দিয়ে, সরকার এখন খেলা দেখে। রাজধর্ম পালনের সব দায় এখন আদালতের। তাদের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে গোটা বাংলা। কেন, শুধুমাত্র বিচারকদেরই কি চোখ কান খোলা থাকে? তারাই কি কেবল বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা অনুভব করতে পারেন? আমাদের রাজ্য প্রশাসনের মন্ত্রী আমলা কারোরই কি চোখ কান নেই? তারা নিজেরাও কি দেখতে পাচ্ছেন না, কি ভয়ানক অবস্থা শুরু হয়ে গিয়েছে? নিশ্চয় পাচ্ছেন। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে করোনা। খোদ পুলিশ কমিশনার করোনা আক্রান্ত। পুলিশ, স্বাস্থ্যকর্মী, আমলা, নেতা, অভিনেতা করোনা কাউকে ছাড়ছে না। এসব দেখেও কি মনে হচ্ছে না এবার অন্তত গঙ্গাসাগর মেলাটা বন্ধ রাখা উচিৎ ছিল। হচ্ছে বৈকি, কিন্তু রাজনীতি বড় বালাই। তৃণমূল এখন বাংলা ছাড়িয়ে অন্য রাজ্যে পা ফেলছে। গঙ্গাসাগরের ভিড়ে অবাঙালিদের সংখ্যাধিক্য, তাই অন্য রাজ্যের মানুষের কাছে নিজেদের গুণগান করবার এটা একটা দারুণ সুযোগ। এছাড়াও ভোটের মরসুমে অন্য রাজ্য বিশেষ করে উত্তর ও মধ্য প্রদেশের পূণ্যার্থীদের চটাতেও চাইছে না তৃণমূল। তাই তো আদালতের কোর্টে বল ঠেলে দিয়েছে তারা। মুখে দেখাচ্ছে মেলা করতে তাদের উৎসাহ এবং আন্তরিকতার সীমা নেই, কিন্তু মনে মনে তারা সকলেই জানেন সেটা কতটা মারাত্মক হতে পারে। তাই তো তারা বিষয়টি আদালতের হাতেই সপে দিয়েছেন।
এমনটাই হয়েছে গত দুই বছর দুর্গা পুজোর সময়েও। আদালতের নির্দেশে পুজোতে জনসমাগম নিষিদ্ধ হয়েছে। রাজ্য সরকার এক্ষেত্রেও নিজেরা সিদ্ধান্ত না নিয়ে আদালতের উপরেই ছেড়ে দিয়েছিল। অর্থাৎ নিজেরা কিছুতেই খারাপ হব না। রাজ্য সরকারের কি একবারও মনে হয় না, তাদেরও দায় আছে রাজ্যের মানুষের প্রতি। তারাই আমাদের অভিভাবক, আমাদের ভাল মন্দ দেখার দায়িত্ব তাদের। তাই আমাদের ভাল কিছুর জন্য কখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে এত দ্বিধা কেন? প্রশাসনে বসলে অনেক সময় অনেক সিদ্ধান্তই অনেকের পছন্দসই না হতেও পারে। সে কথা মুখ্যমন্ত্রী তথা অন্য মন্ত্রী, আমলাদের ভাল করেই জানা। এ বছর গঙ্গাসাগর মেলা স্থগিত হলে রাজ্যবাসী খুব রাগ করতেন কি? বরং কিছুটা স্বস্তিই পেতেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতৃত্বের নজর এখন রাজ্য ছাড়িয়ে অন্য রাজ্যেও। গঙ্গাসাগর মেলায় ভিড়ের বেশির ভাগটাই ভিন রাজ্য থেকে আসা মানুষের। তাই তো গঙ্গাসাগরের এই ভিন রাজ্যের ভিড়ের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়তে ছাইছেন না কেউই। কিন্তু পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সগর্বে কিছু করা যাচ্ছে না। রাজ্যের বিরোধী দল থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছ থেকে আসছে মেলা বন্ধের চাপ। অগত্যা তাই বার বার কোর্টের কোর্টেই বল।
একই কথা বলা যায় পুরনির্বাচনের ক্ষেত্রেও। ২০২০ সালে পুর নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন কোভিডের বাড়বাড়ন্তের দোহাই দিয়ে, মানুষের কথা ভেবে নির্বাচন করা হয়নি। অধিকাংশ পুরসভাতেই ক্ষমতায় ছিল তৃণমূল, পুরপ্রশাসক বানিয়ে তারা প্রায় দুবছর বিনা ভোটেই ক্ষমতা ভোগ করেছে। মজার কথা ২০২০ সালের ১৬ মার্চ যখন পুরনির্বাচন স্থগিত করে দেওয়ার ঘোষণা করেছিল কমিশন তখন কিন্তু রাজ্যে একটিও কোভিড রোগী ছিল না। তার পরের দিন একজনের কোভিড পজিটিভ ধরা পড়ে। অথচ এখন যখন রাজ্যেই দৈনিক পনেরো হাজার মানুষ আক্রান্ত তখন নির্বাচন কমিশন এটাকে ভোট করবার উপযুক্ত সময় ভাবছে কেন? এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। কেউ কেউ এক্ষেত্রে রাজ্যের শাসক দলের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। তাদের মতে দুবছর আগে পুরভোট হওয়ার কথা যখন হচ্ছিল, তখন রাজ্যে বিজেপি বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। লোকসভা ভোটে উল্লেখযোগ্য ভাবে আসন বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় স্তরেও বিজেপি প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে এসেছিল। অবস্থা সুবিধের নাও হতে পারে ভেবেই তখন নির্বাচন স্থগিত করে দেওয়া হয়। তার পরে বর্তমানে রাজ্যে বিজেপি তথা অন্য বিরোধীদের কি অবস্থা সকলেই জানেন। তাই এই মুহূর্তে পুরভোট হলে কি ফল হবে তা দিনের আলোর মতই স্পষ্ট। তাই শাসক দল আর দেরি না করে এবার সরাসরিই পুরপ্রশাসনের দায়িত্ব নিতে চাইছে। নির্বাচন কমিশনও তাই এখন পুরভোটের উপযুক্ত সময় বলে মনে করছে। এ ক্ষেত্রেও তাই রাজ্যের মানুষের ভরষা সেই আদালতই। ফলে রাজ্য তথা দেশ চালানোর দায় বা দায়িত্ব এখন প্রকারান্তরে আদালতেরই। সেই কারনেই এখন প্রতিটি বিষয়ে কোর্টের কোর্টেই বল ঠেলে দিচ্ছেন সকলে।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ