সম্পাদকীয়, ফেব্রুয়ারি ২০২১

দলবদলের মরসুমে রাজনীতির কারবারিদের ব্যপক ব্যস্ততা এখন। কারবারি বললাম বলে অনেকেই চোখ তুলে তাকাতে পারেন, আমি অবশ্য বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত না হয়ে বলব রাজনীতির ব্যবসায়ী বলাটাই শ্রেয় ছিল। তা যাই হোক এই কারবারি বা ব্যবসায়ীরা দল বদল বা দোকান বদল করতেই পারেন। কিন্তু আমার কিঞ্চিৎ আপত্তি তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে যারা ভোটে জিতে জনতার রায়ে কোনও একটা পদে এসেছেন বা বসেছেন। জনপ্রতিনিধি মানে তো জনতার হয়ে যিনি প্রতিনিধিত্ব করবেন, তাই তো? কি গাল ভরা নাম, দায়িত্ব। আচ্ছা বলুন তো এই জনপ্রতিনিধিরা যখন দল বদলান তখন কি কখনও জনতার সঙ্গে কথা বলেন। সাম্প্রতিক অতীতে কাউকে কখনও দেখেছেন প্রকাশ্য জনসভা করে জনতার কাছ থেকে দলবদল করবেন কিনা সেই রায় নিতে। ক দল ছেড়ে খ অথবা গ দলে যাওয়ার আগে যে জনগন তাকে নির্বাচিত করেছেন তাদেরকে একবার সৌজন্যের খাতিরেও জানাতে, যে তিনি অন্য দলে যাওয়ার কথা ভাবছেন বা যাচ্ছেন।

না, এমনটা দেখা যায় না। প্রচুর ফুটেজ খেয়ে, বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমের রান টাইম বা খবরের কাগজের জায়গা নষ্ট করে তারা দলবদল করেন নিজের গুটিকয়েক মোসায়েবদের সঙ্গে নিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনতা সংবাদ মাধ্যমে খবর পায়, যে তাদের প্রিয় নেতা অন্য দলে চলে গিয়েছেন। অনেকে অবশ্য দল বদলের পর ঘটা করে সভা করেন, ঘোষণা করেন। এটাকে কি জনতার অপমান বলা যায় না? আমি একটা রাজনৈতিক কারণ বা আদর্শগত ভাবেই যাকে ভোট দিয়েছিলাম। সে যখন সম্পূর্ণ বিপরীত চিন্তার একটি দলে চলে যায় তখন আমাদের মানসিকতা কি হতে পারে, সেটা কখনও রাজনীতির কারবারিরা ভেবে দেখেন নি। বলা ভাল ভেবে দেখার প্রয়োজনই অনুভব করেননি। তারা জানেন শুধু দেখা ছাড়া জনতার কোনও গতি নেই। এই দলবদলের পিছনেও অনেক গল্প থাকে, অনেক হিসেব থাকে। কিন্তু সকলেই জানেন দল বদলের এই হিসেব বা চাওয়া পাওয়ার মাঝে দূর দূর পর্যন্ত কোথাও জনহিতের চিহ্নমাত্র থাকে না।

জনতা জনার্দন। জনতার রায় মাথা পেতে নিয়েছি। জনতার আশীর্বাদেই ক্ষমতায় এসেছি আমরা। জনতাই শেষ কথা বলবে। জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে এমন জনতা বাক্য শুনতে শুনতে আমজনতা মাঝে মধ্যেই ধরে নেওয়ার ভুল করেন তারাই সব। কিন্তু আদতে জনতাকে উপেক্ষা, অবহেলা, অনাদর করেই ধারাবাহিক ভাবে জনপ্রতিনিধিদের বাড়বাড়ন্ত। সামনে এমন ভাব দেখান সকলে জনতা ছাড়া আর কারও বিষয়ে তাদের কোনও কিছু ভাবার অবকাশ নেই।

তর্কের খাতিরে কেউ কেউ বলতে পারেন ভোট কিন্তু জনতাই দেয়। তাই ভোটের সময় সকলেই নত হন জনতার সামনে। আদতে ভোটের সময় যা দেখি সেটা নাটক। ভোটের আগে উন্নয়ন, ভোটের আগে প্রকল্প, ভোটের আগে জনতার জন্য চোখের জল ফেলা, বছরের পর বছর এই নাটকই আমরা দেখে আসছি। দীর্ঘদিন সংবাদ জগতে থাকার সূত্রে এটুকু বলতে পারি রাজ্যের বিভিন্ন জায়গাতে কিভাবে ভোট হয়, কারা ভোট করেন, কারা ভোট দেন তা অনেকটাই আমার জানা বা দেখা। এই ছবি সব আমলেই। তাই আপনি ভোট দেবেন কি দেবেন না, তা নিয়ে কিন্তু বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয় জনপ্রতিনিধিরা। বরং আপনি ভোট দিতে না গেলেই মঙ্গল। 

আমি বা আমরা ভিতু, অশক্ত মানুষ। আমাদের অভিযোগ করবার সাহস নেই। সাহস করলেও উপায় নেই। উপায় থাকলেও পাশে দাঁড়াবার লোক নেই। তাই নেতারা যখন প্রকাশ্যেই অভিনেতা তখন তাদের সেই অভিনয় দেখা ছাড়া গতি কি? আমরা বুঝে গিয়েছি জনতা মানে নেতার স্ত্রী, ছেলে – মেয়ে, ভাই বন্ধু আত্মীয় পরিজন। বাকি আমাদের সকলের মুখে সভ্য জনতার মাস্ক পরানো। সেই মাস্ক খুললেই আমরা সকলেই কখনও মাওবাদী, কখনও উগ্রপন্থী, কখনও শহুরে নকশাল। জননেতারা চান জনতা থাকুক গান্ধীজীর তিন বাঁদরের মত। তার বাইরে গেলেই, বেচাল করলেই ভ্যানিশ।  

 ভাল থাকার চেষ্টা করবেন সকলে। ফের কথা হবে আগামী সংখ্যায়।

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five − one =