সম্পাদকীয়, মার্চ ২০২১

ভোটের মরসুমে বেজায় ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলি, তাদের নেতা কর্মীরা। কিন্তু আপনার জানা আছে কি এদের চেয়েও বেশি ব্যস্ত কর্পোরেট হাউজ এবং তাদের পোষা মিডিয়া হাউজগুলি। না, সাধারণ মানুষের পক্ষে এসব তলিয়ে দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু আপনি মানুন বা না মানুন আমাদের দেশে নির্বাচন চালায় কিন্তু রাজনৈতিক দল নয় কর্পোরেট হাউজগুলিই। তারাই ঠিক করে আগামীতে মসনদে বসবে কারা, সেই অনুযায়ী নির্বাচনে অর্থের ব্যবহারের সিংহভাগ চাহিদাও তারাই পূরণ করে। তাদের হাতে থাকা মিডিয়াগুলিও পছন্দের রাজনৈতিক দলের প্রচারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়।  

এবার দেখে নেওয়া যাক কর্পোরেট হাউজগুলি কি ভাবে কব্জা করে রেখেছে বর্তমান সংবাদ মাধ্যমগুলিকে। সেই সঙ্গে দেখে নেব তাদের রাজনৈতিক সমর্থনের দিকটাও। তাহলেই স্পষ্ট হবে রাজনীতি, কর্পোরেট হাউজ এবং মিডিয়া কিভাবে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত পরস্পরের সঙ্গে। প্রথমেই আসি জি গ্রুপের কথায়, সকলেই জি এর বিভিন্ন চ্যানেলের দর্শক। বাংলায় জি চব্বিশ ঘন্টা অন্যতম জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেল। জি এর খাতায় কলমে মালিক এসেল গ্রুপ, এই গ্রুপের কর্ণধার সুভাষচন্দ্র। বোস নন গোয়েল।  সুভাষ চন্দ্র ২০১৬ সালে হরিয়ানা থেকে রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছিলেন বিজেপির প্রত্যক্ষ সমর্থনে। এবার আসি নেটওয়ার্ক ১৮ গ্রুপে, সিএনবিসি, নিউজ ১৮, এ রাজ্যে নিউজ ১৮ বাংলা প্রভৃতি এক ঝাঁক চ্যানেলের বর্তমান মালিকের নাম জানা আছে কি? মুকেশ আম্বানি। অর্ণব গোস্বামীর দৌলতে রিপাবলিক টিভির নাম এখন সর্বজনবিদিত। সেই রিপাবলিক টিভির খাতায় কলমে মালিকানা জুপিটার ক্যাপিটালের। জুপিটারের কর্ণধার রাজীব চন্দ্রশেখরণ কেরালা বিজেপির বড় নেতা। ইন্ডিয়া টিভির রজত শর্মাকে প্রায় সকলেই চেনেন। বিজেপির বদান্যতায়, বলা ভাল প্রয়াত বিজেপি নেতা মন্ত্রী অরুন জেটলির ঘনিষ্ঠতায় দীর্ঘদিন তিনি দিল্লির ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান ছিলেন। ইন্ডিয়া টিভির প্রধান শেয়ার হোল্ডারের নাম আদানি গোষ্ঠী, যাদের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠতা সকলেরই জানা।

এ তো গেল দেশের কিছু বড় মিডিয়ার খোঁজ খবর। এবার আসি বাংলাতে। বাংলায় এখন হঠাৎ করেই মিডিয়ার সুনামি। চাকরির ক্ষেত্রে খুলে গিয়েছে নতুন দিগন্ত। রাজনীতির মতই একাধিক দলবদল ( পড়ুন চাকরি বদল) এখন রোজনামচা। ফেসবুক খুললেই দেখছি চাকরি ছাড়া এবং নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার সগর্ব ঘোষণা। এর বড় কারণ, এক ঝাঁক নতুন চ্যানেল। টিভি নাইন, রিপাবলিকের মত সর্বভারতীয় নামী চ্যানেলের পাশাপাশি, খাস খবর, নিউজ এখন ইত্যাদি স্থানীয় কিছু ব্রান্ডের চ্যানেলও নতুন করে আসছে। এই সময়েই আসার অপেক্ষায় রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি টিভি এবং ওটিটি নির্ভর চ্যানেল। বিষয়টা খুব ভাল, প্রচুর ছেলেমেয়েদের চাকরি হচ্ছে। কাজের সুযোগ হচ্ছে। শুনতে ভালই লাগছে। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা অবশ্য এতে সিঁদুরে মেঘই দেখছে। কারণ এর আগেও বাংলাতে এমন নিউজ চ্যানেলের জোয়ার এসেছে। সেক্ষেত্রে বড় ব্র্যান্ডের পাশাপাশি অনামী অখ্যাত ব্যান্ডও ছিল। তাদের মধ্যে অধিকাংশই এখন ইতিহাস, দু একটিই টিকে আছে।

নির্বাচনের আগে এই নিউজ চ্যানেল আনার ব্যস্ততা নতুন নয়। সাধারণ যুক্তি হল এই সময় নাকি মানুষ টিভি বা খবর বেশি দেখেন, তাই চ্যানেলের দর্শক মিলবে। আদতে কারনটা ভিন্ন। অধিকাংশ চ্যানেলের মালিকই কিন্তু ব্যবসায়ী। তারা ভোটের আগে  চ্যানেল এনে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টাতেই বেশি থাকেন। নতুন চ্যানেল এনে রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করবার উপায় খুঁজতে থাকেন। এবারও ব্যতিক্রম নয়। তাই রাজনীতির মতই এখন কর্পোরেট মিডিয়াতেও ব্যপক তোলপাড়।

 রাজনৈতিক নেতাদের কথা সংবাদ মাধ্যমে দেখি তাই জানতে পারি। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে জড়িতদের কথা জানা বেশ মুশকিল।  দর বাড়িয়ে অন্য দলে যাওয়া, সেখান থেকে ফের দর বাড়িয়ে ফিরে আসা বা অন্য আর এক দলে যাওয়ার কথা খবরে পড়েন। কিন্তু মিডিয়াতেও এই উদাহরণ যথেষ্ট। সম্প্রতি একজন স্বনামধন্য পরিচিত মুখ, সদ্য আসা একটি টিভি চ্যানেলের প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতে সেই তিনিই ফের একটি নামী চ্যানেলে চলে যান ভাল অফার পেয়ে। শোনা  যাচ্ছে সদ্য সম্প্রচার শুরু হওয়া সেই টিভি চ্যানেল নাকি এখনও তাদের মাথা খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আগেই বলেছি বাংলার অধিকাংশ সংবাদ মাধ্যমের বর্তমান মালিকেরা ব্যবসায়ী। ব্যবসা করতে গেলে অধিকাংশ সময়েই সব ক্ষেত্রে নিয়ম কানুন ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। অনেকেরই তাই নানান গোলমাল রয়েছে, এছাড়া চিট ফাণ্ডের মালিকানা, বেআইনি নানান ব্যবসা, অসাধু উপায়ে টাকা করা ব্যক্তিদের মালিকানাধীন চ্যানেলের পক্ষে সরাসরি সরকারের বিরোধীতা করা সম্ভব নয়। তারা সেটা করেও না। তাই তৃণমূলের মোসায়েব কোনও চ্যানেল বা খবরের কাগজ হঠাৎ করে যখন শাসকদল বা সরকার বিরোধী বা তথাকঠিত নিরপেক্ষ হয়ে ওঠে তখনও বুঝবেন ডাল মে কুছ তো কালা হ্যায়।  বাংলায় এমন হয়েওছে। গত লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে থেকে এমনই এক তৃণমূল ঘেঁষা চ্যানেল হঠাৎ করেই নিরপেক্ষ হয়ে ওঠে। দুর্জনেরা বলেন এর পিছনে বিজেপির ভাল মত সমর্থন ছিল। তাই নির্বাচন মানে শুধু যে রাজনৈতিক সোরগোল তা নয়, তার চেয়েও বহুগুণ ব্যস্ততা বেড়ে যায় কর্পোরেট এবং মিডিয়াতেও। যা আপনার আমার নজরে আসে না, আসে শুধু রাজনীতির কারবারিদের ব্যস্ততাটুকু। যেটা সব ব্যস্ততার হিমশৈলের চূড়া মাত্র।   

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one − one =