সম্পাদকীয়, মে ২০২২

এ যেন বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলের গল্প। যে তার বিলাসের জন্য, জীবনধারণের জন্য পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া সম্পত্তি বিক্রিই একমাত্র উপায় ভাবে। একের পর এক সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা জলের দরে বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে দেশবাসীর ভাবনা এবং সন্দেহে ধারাবাহিক সিলমোহর দিয়ে চলেছে কেন্দ্রের মোদি সরকার। এবার ১০ হাজার কোটির সরকারি সংস্থা “পবন হংস” মাত্র ২১১ কোটি টাকায় তুলে দেওয়া হলো রামদেব বাবার সংস্থা স্টার-৯ মোবিলিটি কোম্পানির হাতে।  যদিও সরকার বেশ কয়েক বছর ধরে পবন হংসকে অলাভজনক বলে দাগিয়ে আসছিল। কিন্তু পবন হংস ১৯৯২ সাল থেকে বাণিজ্যক লাভ করে চলেছে, ২০১৪-১৫ সালেও সরকারকে ২২৩.৬৯ কোটি টাকার লাভ দিয়েছে, মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এটি ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। ইচ্ছাকৃতভাবেই এটিকে অলাভজনক দেখিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। সরকার তার ৫১ শতাংশ শেয়ারের জন্য কমপক্ষে ৫০০ কোটি পাবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার বেস প্রাইস বা ন্যূনতম মূল্য ধার্য করে মাত্র ২০০ কোটি টাকা। স্টার-৯ মোবিলিটি কোম্পানিটি বেসপ্রাইজের চেয়ে মাত্র ১১ কোটি টাকা বেশি দিয়ে কিনে নেয় পবন হংস। এশিয়ার বৃহত্তম হেলিকপ্টার পরিষেবা সংস্থাকে ২১১ কোটি টাকায় কোন যুক্তিতে মাত্র ছমাস আগে তৈরি হওয়া একটি সংস্থার কাছে  বিক্রি করে দেওয়া হল, সেটা কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী এবং তার কিছু মোসায়েব ছাড়া আর কেউ জানেন না।

পবন হংসের হেলিকপ্টার মূলত দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ স্থাপন, অনুসন্ধান ও উদ্ধারকার্যের জন্য ব্যবহৃত হত। ওএনজিসির অধীনেও সংস্থাটির শেয়ার রয়েছে, অবশিষ্ট ৪৯ শতাংশের শেয়ারহোল্ডার তারা, এছাড়া তারাও অপারেশনের জন্য পবন হংস হেলিকপ্টার ব্যবহার করে। সাধারণের জন্য ফ্লাইট ছাড়াও বিএসএফ-এর ছয়টি ধ্রুব হেলিকপ্টারও হ্যালের জন্য পবন হংস দ্বারা পরিচালিত হয়। বৈষ্ণোদেবী, কেদারনাথ-বদ্রীনাথ তীর্থ যাত্রার ক্ষেত্রে পবন-হংস গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে এসেছে। এছাড়া, বিভিন্ন প্রাইভেট সেক্টর এবং নেতা-মন্ত্রী, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে এই সংস্থা পরিষেবা দিয়ে থাকে। ২০২১ এর মার্চে অর্থমন্ত্রী যে সমস্ত সরকারি সংস্থা বিক্রি করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন পবন-হংস তার মধ্যে ছিল না।। হঠাৎ করে কেন এবং কোন উদ্দেশ্য সাধন করতে এই সংস্থা বিক্রি করে দেওয়া হল, সেটা জানার আগেই তা হাতবদল হয়ে গেল। পবন হংসের মোট ৪৬ টি হেলিকপ্টার রয়েছে, যেগুলোর দাম সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এরই সঙ্গে গোটা দেশের কয়েক হাজার সরকারি হেলিপ্যাডও প্রকারান্তরে রামদেবের দখলে চলে গেলো। ২৯ শে অক্টোবর ২০২১ সালে তৈরি হয় স্টার-৯ মোবিলিটি প্রাইভেট লিমিটেড। ছয় মাসের একটা সংস্থা, মাত্র ৩১১ কোটি টাকার বিনিময়ে, একটা সরকারি কম্পানীর ৫১% শেয়ার ৩৫ গুণ কম দামে কিনে, মালিকানার অধিকার পেয়ে গেল! শোনা গিয়েছে এই কোম্পানির মাত্র ১ লাখ টাকা পুঁজি, বাকি ২৯৯.৯  কোটি লোন দেবে সরকারি ব্যাঙ্ক। মাত্র এক লাখ টাকার বিনিময়ে…!!!  

অস্থির বাজারে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার ছাড়া কার্যত নজিরবিহীন। যে কারণে পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী গত মার্চে এলআইসির শেয়ার ছাড়া হয়নি। এখন যখন গোটা অর্থবর্ষ হাতে রয়েছে তখন তড়িঘড়ি আইপিও-র বাজারে পা ফেলার কারণ কি? অনেকের বক্তব্য, এই আইপিও থেকে সরকার হয়তো লাভবানই হবে। কিন্তু কার স্বার্থে পড়তি বাজারে আইপিও এনে আরও বড় অঙ্কের অর্থ রাজকোষে তোলার সুযোগ হাতছাড়া হল?

২মে  লঞ্চ হয়েছে এলআইসির আইপিও। তবে প্রথম দুদিন শুধু বড় মাপের বিনিয়োগকারী বা অ্যাঙ্কর ইনভেস্টররাই দেশের বৃহত্তম বিমা সংস্থার শেয়ার কেনার সুযোগ পেয়েছেন। এরপর তা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আওতায় আসে ৪ মে থেকে ৯ মে-র মধ্যে। মঙ্গলবার কেন্দ্র দাবি করেছে, প্রথম দু’দিনে ৫ হাজার ৬২৭ কোটি টাকার আইপিও বিক্রি হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস সহ অন্য বিরোধী দলগুলির দাবি, সরকার যে দরে এলআইসির শেয়ার বিক্রি করছে তাতে মোটা অঙ্কের লোকসান হতে চলেছে সরকারি কোষাগারের।  ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই যেখানে দেশের বৃহত্তম বিমা সংস্থার মূল্য ধরা হয়েছিল ১২ থেকে ১৪ লক্ষ কোটি টাকা, সেখানে এখন মূল্য ধরা হচ্ছে মাত্র ৬ লক্ষ কোটি টাকা। মাত্র দুমাসে কোন জাদুতে এত কমে গেল এলআইসির ব্র্যান্ড ভ্যালু? প্রশ্ন সকলের। কংগ্রেসের  রণদীপ সুরজেওয়ালার দাবি, এলআইসির প্রতিটি শেয়ারের দাম প্রথমে ঠিক হয়েছিল ১ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু সেখান থেকে দাম কমিয়ে করা হয়েছে ৯০২ থেকে ৯৪৯ টাকা। এতে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হবে। এলআইসির এমবেডেড ভ্যালু ৬ লক্ষ কোটি টাকা ধরে এই ৯০২ থেকে ৯৪৯ টাকা শেয়ারের দর ঠিক করা হয়েছে, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এমবেডেড ভ্যালুর আড়াই থেকে চার গুণ বাড়িয়ে শেয়ারের দর ঠিক হয়। সেক্ষেত্রে এই দর ন্যুনতম আড়াই গুণ বাড়ালেও এক একটি শেয়ারের দর হওয়ার কথা ছিল ২১০০ থেকে ৩০০০ টাকা। সরকার যেখানে এলআইসির ৫ শতাংশ শেয়ার বেচে ৭০ হাজার কোটি টাকা তোলার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল, সেখানে এখন ৩.৫ শতাংশ শেয়ার বেচে কেন্দ্রের আয় হতে চলেছে মাত্র ২১ হাজার কোটি টাকা। ক্ষতি? ২৫ থেকে ৫৪ লক্ষ কোটি টাকার মত। এত কম দামে এলআইসির শেয়ার বেচতে কেন মরিয়া কেন্দ্র? সম্পদের বিচারে এলআইসি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম সংস্থা। এলআইসির মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তা সত্ত্বেও কার স্বার্থে এত সস্তায় এলআইসির শেয়ার বিক্রি করছে কেন্দ্র?” অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা এর ফলে বিভিন্ন বেসরকারি বিমা সংস্থা এবং বিদেশী সংস্থাগুলি কম দামে এলআইসির শেয়ার নিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। 

গত বছর এয়ার ইন্ডিয়া টাটা সন্সকে বিক্রি করেছে কেন্দ্র। তার পর চলতি বছরে পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারিকরণের লক্ষ্য নিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার। সেই তালিকায় রয়েছে ভারত পেট্রোলিয়াম, শিপিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া, বিইএমএল ও আইডিবিআই ব্যাঙ্ক। তারই মাঝে টুক করে বিক্রি হয়ে গেল পবন হংস। এভাবে চললে আর কয়েক বছর পরে তো বেচার জন্য সরকারি সংস্থাই থাকবে না, তখন?  

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 − 2 =