সম্পাদকীয়, জানুয়ারি ২০২১

দিন দিন ক্রমশ আমার না বোঝার পরিমানটা বাড়ছে। এই সহজ ব্যাপার না বোঝার রোগে অন্যরা তো বটেই, আমি নিজেও খুব বিরক্ত হই নিজের উপরে। কিন্তু মাথার মধ্যে অবুঝ পোকাগুলি কেমন ছটফট করে। অবুঝ প্রশ্নগুলি মনের ঘর থেকে বেরিয়ে মুখের বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই তো সকালে এই কারনেই পাড়ার ঘন্টাদার কাছে খুব বকুনি খেলাম। ঘন্টাদা আমাদের পাড়ার একজন সবজান্তা, জ্ঞানী সিদ্ধ পুরুষ। খবরের কাগজে হেডলাইন দেখে মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল সেন্ট্রাল ভিস্তাটা আবার কি? ব্যস, ঘন্টাদা এই মারে কি সেই মারে, সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত যেখান থেকে হবে সেটাই জানো না? ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে একটু মায়া হল বোধ হয়। খুলে দিলেন তার জ্ঞানের ভান্ডার।

 সেন্ট্রাল ভিস্তা হল আধুনিক সংসদ ভবন। দিল্লিতে প্রায় ৯০ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে নর্থ ও সাউথ ব্লক। এই এলাকাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক ও ভবন। এখানেই নতুন সংসদ ভবন তৈরির পাশাপাশি ৫১টি মন্ত্রক ও দফতরকে এক ছাতের তলায় আনার পরিকল্পনা করছে সরকার। নতুন সংসদ ভবনে বাড়তে চলেছে লোকসভা ও রাজ্যসভার আসন সংখ্যাও। সামগ্রিক ভাবে বলতে গেলে সম্পূর্ণ ভাবে ভোল বদলাতে চলেছে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতার মূল অলিন্দের। আর এই গোটা কর্মযজ্ঞই পড়ছে সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্পের জন্য ইতিমধ্যেই ৯৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র। তবে গোটা প্রকল্প শেষ হতে প্রায় পনেরো হাজার কোটি টাকা লাগবে। এ কাজের বরাত পেয়েছে টাটা গোষ্ঠী।

এ পর্যন্ত ঠিক ছিল কিন্তু পরের বেয়াড়া প্রশ্নে আর মেজাজ ঠিক থাকল না ঘন্টাদার। এত সব শোনার পরে সোনা মুখ করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সেন্ট্রাল ভিস্তা হলে দেশের কি লাভ হবে? মন্ত্রী, সাংসদ, আমলাদের দুর্নীতি, মিথ্যাচার, স্বজন পোষণ, শোষণ এসব কমবে কি? আপনিই বলুন, এ সব না বোঝা অর্বাচীনের মত প্রশ্ন শুনলে কেমন লাগে? ঘন্টাদাও তাই আর উত্তর দিতেই চাইলেন না। সে তো মন্ত্রী আমলারাও আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেন না, তাই এসব আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে।

গোল বাধল এর পরেই, আমার মতই এক অর্বাচীন প্রশ্ন করে বসলেন এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ান নিয়ে। সেটা কি জিনিস? আবার ফর্মে ঘন্টাদা। হলিউড ছবি টবি দেখিস না নাকি? এয়ার ফোর্স ওয়ান, এক্সিকিউটিভ ডিসিশন এসব ছবি দেখিস নি? হাঁ মুখে মাথা নাড়তেই এবার এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ানের ইতিহাস।

বোয়িং ৭৪৭ বিমান এখন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেগুলি টানা ১০ ঘণ্টার বেশি উড়তে পারে না। কম দূরত্বের যাতায়াতে অবশ্য রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতির জন্য বোয়িং বিজনেস জেট বা এমব্রেয়ার জেট ব্যবহার হয়। তাতে ঠিক জমছিল না বোধহয়। তাই ৮ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার দু’টি বিমান কিনছে আমেরিকা থেকে। একটি এসে গিয়েছে, আরেকটি আসছে। নতুন  বিমান টানা ১৭ ঘণ্টা আকাশে উড়তে পারে। যা চালাবেন বায়ুসেনার বিশেষ প্রশিক্ষিত পাইলটরা। এই বিমানের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ‘লার্জ এয়ারক্রাফ্ট ইনফ্রারেড কাউন্টার মেজার্স’ রয়েছে। ভিভিআইপি-র জন্য থাকবে ‘সেল্ফ-প্রোটেকশন স্যুট’। ভিভিআইপি-র জন্য বিশাল কেবিন, কনফারেন্স রুম, ছোট মেডিক্যাল সেন্টার রয়েছে এখানে। যে যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকবে, তাতে হ্যাকিং বা আড়ি পাতা অসম্ভব। ফলে প্রধানমন্ত্রী বিমানে বসেই সব রকম কাজকর্ম চালানো বা বৈঠক করতে পারবেন। 

সবই তো হল আমার মুখ ফসকে ফের বেরিয়ে গেল বেয়াড়া প্রশ্ন, আগের বিমানে কি যাতায়াত করা যাচ্ছিল না? ঘন্টাদার অবশ্য উত্তর “কি বলছিস? এটা দেশের প্রেস্টিজ”। দেশের প্রেস্টিজ বুঝি বিমান সংসদ ভবন দিয়ে হয়? প্রবল ঠান্ডার মধ্যে দেশের কৃষকেরা পথে বসে থাকলে দেশের প্রেস্টিজে কি ছেঁদা পড়ে না? করোনা পরিস্থিতিতে দেশের অধিকাংশ মানুষ যখন রুটি রুজির চিন্তায় পাগল, আর্থিক বৃদ্ধির হার তলানিতে, তখন বুঝি প্রেস্টিজে দাগ লাগে না? বিভিন্ন নেতা মন্ত্রী আমলাদের নামে যখন কেলেংকারি, তছরুপ, ফৌজদারি অপরাধের মামলার পাহাড় জমে তখন বুঝি দেশের প্রেস্টিজে কালি ছেঁটে না?

এক অভি-নেতা বলেছিলেন ক্ষমতায় এলে প্রত্যেক দেশবাসির একাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে জমা দেবেন। আমাদের গরিব দেশ, কালো টাকা ফেরৎ আসেনি, ১৫ লক্ষ টাকাও জমা পড়েনি। আচ্ছা এই সাড়ে আট হাজার টাকা, ওদিকে পনেরো হাজার কোটি টাকা যোগ করে গরিব মানুষদের ব্যাঙ্ক একাউন্টে কিছু টাকা কি দেওয়া যেত না? এতে কি প্রেস্টিজে খুব কিছু গ্যামাকসিন পড়ে যেত? ডিজেলে একটু ছাড় দিলে কি প্রেস্টিজ থাকতোই না? বয়স্ক নাগরিকদের জমা পুঁজিতে আর একটু বেশি সুদ দিলে কি প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যেত? এত সব আজে বাজে প্রশ্ন শুনে ঘন্টাদা স্পিকটি নট। তাহলে উত্তর কে দেবে? কেউ না, কারন এ দেশে উত্তর না দেওয়াটাই প্রেস্টিজের ব্যাপার। 

ভাল থাকবেন সকলে। ফের কথা হবে আগামী সংখ্যায়।

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ পত্রিকা







Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 − fourteen =