সম্পাদকীয়, রথযাত্রা সংখ্যা ২০১৯
রথ আসছে। শশব্যস্ত সকলেই। দূরে রথ, দেখা যাচ্ছে রথের ধ্বজা। আগে থেকেই টোটোতে মাইকে বেঁধে সকলকে জানান দেওয়া হচ্ছে রথ আসার খবর। মাঝে কিছু ছেলে পথ চলতি মানুষজন তথা যান বাহন সরাতে ব্যস্ত। একটি ট্যাক্সি সামান্য এগোনোর চেষ্টা করতেই… বনেটে চাপড়। মারব সালা(শালা)… দেখছিস না রথ আসছে। অগত্যা অন্যরাও সে ছবি দেখে নিশ্চল। আধ ঘন্টা পরে রথ যেতে একটু একটু করে নড়ে উঠল জনজীবন। সে আপনার স্কুল কলেজ থাকতে পারে, থাকতে পারে গাড়ির ভিতরে কোনও রোগী, হতে পারে আপনার চাকরির একটা ইন্টারভিউ আছে, হয় তো বা আপনার নিয়ে যাওয়া খাবারের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট শিশুটি। তা হোক দাঁড়াতে আপনাকে হবেই মশাই। রথ আসছে যে…
না একা জগন্নাথের নামে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারন এ ছবিটা শুধু রথের নয়, পাড়ার শীতলা পুজোর ঠাকুর আনা থেকে আন্না কালী পুজোর বিসর্জন। সবেতেই ছবিটা এক। এর পরে যদি দুর্গা, কালী, সরস্বতী, গনেশের মত সুপারহিট পুজো হয় তবে তো কথাই নেই। বাড়ির পুজোর বিসর্জনেও এক অবস্থা। বড়দের দেখে কচিরাও গাড়ির বনেটে চাপড় মারতে থাকে। আটকানো থাকে পথ। অন্যরাও কম যান কি? মহরম বা ঈদের সৌহার্দ্য মিছিল যাই হোক না কেন, রাস্তা বন্ধ। পথচারীরা তাও এপাশ ওপাশ করে কোনও রকমে চলে গেলেও যেতে পারেন। গাড়ি চালকদের মহা অপরাধ, রাস্তায় আবার গাড়ি নিয়ে বেরনো কেন বাপু! রাস্তা থাক মিটিং মিছিল শোভা বা শোক যাত্রার জন্য।
এ ছবি দেখি ভোটেও। নির্বাচনী প্রচারে বেরিয়েছেন ভোট প্রার্থী, তার মিছিল আসার আগেই হাজির তার অনুগামীরা(পড়ুন সাঙ্গো পাঙ্গোরা)। রাস্তা খালি করতে গিয়ে যান বাহন এমনকি মানুষগুলিকে পারলে নর্মদায় থুড়ি নর্দমায় নামিয়ে দেয় আর কি। সঙ্গে কি দাপট! ধমকে চমকে শাসিয়ে সকলকে একধারে দাঁড় করিয়ে রেখে সে কি হম্বি তম্বি! দেখে মনে হওয়ার উপায় নেই যে এরা এসেছে আমাদেরই করুণা (পড়ুন ভোট) ভিক্ষা করতে। জেতার পরেও একই ছবি, বিজয় মিছিল মানে হম্বি তম্বির মাত্রা আরও এক কাটি ওপরে। রাস্তা তো ওদেরই, আপনাকে আমাকে অনুগ্রহ করে মাঝে মধ্যে চলাচল করতে দেয় এটাই বড় ব্যাপার।
পুজো করাটা একটা বড় সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাই পুজো আমাদের করতেই হবে। পাড়ায় পাড়ায় মোড়ে মোড়ে, পুজো হবে, হয় সর্বত্র। কিন্তু বাবা প্রোমোটেশ্বরের পুজোর জন্য মাঠ বা এক চিলতে ফাঁকা জমিও তো আমরা রাখিনি। তাই অন্য পুজোগুলি হবে কোথায়? কেন রাস্তায়! পথ আটকে পুজো প্যান্ডেল আমাদের সংস্কৃতির একটা বড় পরিচায়ক। কোথাও কোথাও খুব মহানুভব পুজো কমিটি যাতায়াতের জন্য এক চিলতে জায়গা রাখেন, কোথাও সে সবেরও বালাই নেই।
এলাকায় উৎসব, খেলাধুলা, রাজনৈতিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক কর্মসূচী যাই হোক না কেন তার একটা জবরদস্ত তোরণ দরকার। ব্যাস শুরু হয়ে গেল; রাস্তা আটকে বাঁশের বা লোহার কাঠামো বানিয়ে দুপাশে বেশ কয়েক ফুট জায়গা নিয়ে গড়ে উঠল সেই তোরণ। অনুষ্ঠান শেষ, কিন্তু এক সপ্তাহ, দু সপ্তাহ কোথাও এক মাস হয়ে গেলেও সরে না সেই ঘটে যাওয়া অনুষ্ঠানের তোরণগুলি। তোরণে থাকা নেতা বা অভিনেতাদের হাসিমুখে আটকে থাকে রাস্তা।
এখানেই শেষ নয়, অনুষ্ঠান বা পুজো করতে গেলে তো চাঁদা চাই, দেবে কে? স্থানীয় মানুষের দেওয়া পাঁচ টাকা দশ টাকা চাঁদায় আজকাল আর পুজো বা অনুষ্ঠান হয় না। তাহলে টাকা উঠবে কোথা থেকে? কেন। রাস্তা আছে তো। গ্রামে শহরে যেখানেই হোক পথের দাবী সর্বত্র। গাড়ি করে যাওয়া মানে সাংঘাতিক অপরাধ করে ফেলেছেন আপনি। ক’পাড়ায় শনি কালী পুজো, খ’পাড়ায় সারা রাত্রি ব্যাপী ফুটবল প্রতিযোগিতা। গ’পাড়ায় নতুন ক্লাবঘরের ঘর তৈরি, ঘ’পাড়ায় রক্তদান শিবির। সবার দাবীই পথের পরে। সে আপনি যেখানকারই বাসিন্দা হোন না কেন, পথে নেমেছেন তো পথের দাবী (পড়ুন চাঁদার জুলুম) আপনাকে মানতেই হবে।
এমনিতে আমরা সঙ্গীত প্রেমী, এখন তা আরও কয়েক গুণ বেড়েছে বৈকি। রণে বনে জলে জঙ্গলে সর্বত্র প্রায় সকলের কানে দড়ি ঝুলতে দেখলেই তা বোঝা যায়। তাই বলে “পথে এবার নামো সাথী” গানটিতে জাতি ধর্ম বর্ণ গন্ধ নির্বিশেষে সকলেই যে এত উদ্বুদ্ধ হবেন স্বয়ং সলিল চৌধুরীও বুঝতে পারেননি। পথে বসার অভিশাপ প্রথম কে দিয়েছিলেন তা জানা নেই, কিন্তু পথে বসে কত মানুষ যে দাঁড়িয়ে গেল তা যদি সেই মানুষটি জানতেন তবে অন্যকে পথে না বসিয়ে নিজেই হয় তো বসে যেতেন পথে।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ