সহজে মাল্টা মুসাম্বি লেবুর চাষ করে স্বনির্ভর হয়ে উঠুন
অগ্নিভ হালদার ##
বাজারে বহুল প্রচলিত এবং সুমিষ্ট রসযুক্ত যে লেবুকে আমরা মুসাম্বি নামে জানি তা আসলে লেবুর কোন এক ধরন নয় বরং একটি লেবুর জাতের নাম। এই লেবু যার খোসা সহজে ছাড়ানো যায় না এবং সাধারণত রুক্ষ শুষ্ক অঞ্চলে ভালো হয়, আমাদের হর্টিকালচারের পরিভাষায় এই ধরনের লেবুকে বলা হয় সুইট অরেঞ্জ বা মিষ্টি কমলা। এই মিষ্টি কমলার বিভিন্ন প্রচলিত জাত হলো মুসাম্বি, সাতগুদি, মালটা ব্লাড রেড , বারি মাল্টা ইত্যাদি।
এখন আমরা এই মাল্টা নিয়ে আলোচনা করব। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে এটি চাষ হচ্ছে এবং সেদেশের বাজারেও ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ফলটি।
ভিয়েতনাম, উত্তর পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ চিন মাল্টার আদি উৎপত্তি স্থল। তবে বর্তমানে এই ফলটি বিশ্বের উষ্ণ ও অব–উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় বেশী চাষ হচ্ছে। কমলার তুলনায় এর অভিযোজন ক্ষমতা বেশী হওয়ায়, পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য এলাকায় সহজেই চাষ করা যাচ্ছে।
জলবায়ু ও মাটিঃ
কম বৃষ্টিবহুল সুনির্দিষ্ট গ্রীষ্ম ও শীতকাল অর্থাৎ শুষ্ক ও উষ্ণ জলবায়ু মাল্টা চাষের জন্য সবচেয়ে বেশী উপযোগী। বায়ুমণ্ডলের আদ্রতা ও বেশী বৃষ্টিপাত মাল্টা ফলের গুনাগুণকে প্রভাবিত করে। বাতাসে অধিক আদ্রতা ও বৃষ্টিপ্রবন এলাকায় মাল্টার খোসা পাতলা হয় এবং ফল বেশী রসালো ও নিন্ম মানের হয়। শুষ্ক আবহাওয়ায় ফলের মান ও স্বাদ উন্নতমানের হয়। আদ্র জলবায়ুতে রোগ ও ক্ষতিকর পাকার আক্রমণ বেশী হয়। মাল্টা গাছ আলো পছন্দ করে এবং ছায়ায় বৃদ্ধি ও ফলের গুণগত মান কমে যায়। সব ধরণের মাটিতে জন্মালেও সুনিষ্কাশিত, উর্বর, মধ্যম থেকে হালকা দোয়াস মাটি মাল্টা চাষের জন্য উত্তম। মধ্যম অম্ল থেকে সামান্য ক্ষারীয় মাটিতে মাল্টা জন্মে। তবে ৫.৫ থেকে ৬.৫ (ph) অম্লতায় ভালো জন্মে। জলাবদ্ধতা মোটেও সহ্য করতে পারেনা এবং উচ্চ তাপ ও লবণের প্রতি সংবেদনশীল।
মাল্টার বংশ বিস্তার — বীজ ও কলমের মাধ্যমে মাল্টার বংশ বিস্তার করা যায়। তবে বীজের চারা আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়ার সাথে সমন্বয় করে বেশী দিন টিকে থাকতে পারে না। তাই কলমের মাধ্যমেই চারা তৈরি করা উত্তম। তাছাড়া কলমের তৈরি চারায় মাতৃ গুন বজায় থাকে ও দ্রুত ফল ধরে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধী ও বলিষ্ঠ শিকড় সমৃদ্ধ আদি জোড়ের মাধ্যমে কলম করলে গাছের জীবনকাল ও ফলন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
জোড় কলমঃ
গ্রাফটিং এর জন্য প্রথমে রুটস্টক/এলা উৎপাদন করতে হবে। রুটস্টক হিসেবে বাতাবিলেবু, রাফলেমন, কাটা জামির প্রভৃতি ব্যাবহার হয়। অতপর কাঙ্ক্ষিত মাতৃ গাছ হতে সায়ন/পরশাখী সংগ্রহ করে রুটস্টকের উপর স্থাপন করে মাল্টার গ্রাফটিং তৈরি করা হয়। রুটস্টক হিসেবে এক থেকে দেড় বসর বয়সের সুস্থ্য, সবল, সোজা, বাড়ন্ত চারা নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচিত মাতৃগাছ হতে সায়ন তৈরির জন্য দুটি চোখ সহ ৫/৬ সেমি লম্বা ও ৮/৯ মাস বয়সের ডাল সংগ্রহ করতে হবে। মধ্য বৈশাখ-মধ্য ভাদ্র (মে- আগস্ট) মাস পর্যন্ত গ্রাফটিং করা যায়। ভিনিয়ার ও ক্লেফট গ্রাফটিং উভয় পদ্ধতিতে মাল্টার কলম তৈরি করা যায়। সাধারণত কলম করার ১০-১৫ দিনের মধ্যে রুটস্টক ও সায়নের মধ্যে সংযোগ স্থাপন হয় ও সায়নের কুঁড়ি ফুটে ডাল বের হয়।কলম হতে একাধিক ডাল বের হলে সুস্থ্য সবল ও সোজা ভাবে বেড়ে ওঠা ডালটি রেখে, বাকীগুলো কেটে ফেলতে হবে। এলা থেকে বাড়ন্ত ডাল নিয়মিত কেটে দিতে হবে।
জমি নির্বাচন ও প্রস্তত পদ্ধতিঃ
সারাদিন রোদ পড়ে ও বৃষ্টির জল জমে না এমন উচু বা মঝারি উচু জমি মাল্টা চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। আগাছা পরিস্কার ও আশেপাশে উচু গাছ থাকলে ডালা ছেঁটে দিতে হবে।
![](https://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2021/07/WhatsApp-Image-2021-04-05-at-21.29.18-576x1024.jpeg)
রোপণ পদ্ধতিঃ
ষড়ভুজ বা বর্গাকার পদ্ধতিতে চারা বা কলম রোপণ করতে হবে। মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য ভাদ্র ( মে- আগস্ট) মাস রোপণের উত্তম সময়। তবে জল সেচের ব্যাবস্থা থাকলে সারা বসর রোপণ করা যায়।
মাদা তৈরিঃ
চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে উভয় দিকে ৫-৬ মিটার দূরত্বে ৭৫x৭৫x৭৫ সেমি মাপে গর্ত খুড়তে হবে। প্রতি গর্তে ১৫ কেজি পচা গোবর, ৪/৫ কেজি ছাই, ১০০গ্রাম এসএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি, ৫ গ্রাম বরিক এসিড, ৫০০ গ্রাম চুন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে গর্তে ভরে দিতে হবে। গর্ত ভরাট করার ১০-১৫ দিন পরে চারা রোপণ করতে হবে।
চারা/ কলম রোপণঃ
গর্তে সার প্রয়োগের ১০-১৫ দিন পরে চারা/ কলম গর্তের মাঝ বরাবর সোজা করে রোপণ করতে হবে। রোপণের পর খুঁটি দিয়ে বেধে দিতে হবে। প্রয়োজন মত সেচের ব্যাবস্থা করতে হবে।
![](https://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2021/07/IMG-20201026-WA0011-576x1024.jpg)
পরিচর্যাঃ
চারার যথাযথ বৃদ্ধির জন্য সময় মত সঠিক পরিমান ও পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। ছোট গাছের ক্ষেএে (১-৪ বছর), গোবর ১০-১২ কেজি,ইউরিয়া ২০০-৩০০ গ্রাম, এসএসপি ১০০-১৫০ গ্রাম, এমওপি ১০০-১৫০ গ্রাম, জিংক ১০ গ্রাম ও বরিক ৫ গ্রাম।
প্রতি বছর উৎকৃষ্ট মানের এবং আকারের লেবু পেতে হলে নিয়ম করে সার দিতে হবে। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছে (পাঁচ বা তার বেশি বয়স) ৩০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার, ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া (, নাইট্রোজেন) , ১৫০ গ্রাম এসএসপি (ফসফরাস) , ৩০০ গ্রাম এমওপি (পটাশ) , ডলোমাইট বা চুন ৩০০ গ্রাম দিতে হবে। মোট এই সারের পরিমাণ তিনটি পর্যায়ক্রমে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম পর্যায়ে মানে ফল যখন মটর দানা আকারের হবে, তখন জৈব সারের অর্ধেক অংশ, নাইট্রোজেন সারের তিন ভাগের এক ভাগ, ফসফরাস অর্ধেক অংশ এবং ডলোমাইট বা চুন অর্ধেক দিতে হবে। প্রথম সার প্রয়োগের দু’মাস বাদে দিতে হবে নাইট্রোজেন সারের তিন ভাগের দু’ভাগ, ফসফরাস সারের বাকি অংশ এবং পটাশ সারের অর্ধেক অংশ। শেষ পর্যায়ে মানে আষাঢ় মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে বাকি যা পড়ে রয়েছে, তা প্রয়োগ করতে হবে গাছে। সার দিতে হয় গাছের গোড়া থেকে তিন ফুট দূরে দু’ ফুট চওড়া এবং ছয় ইঞ্চি গভীর গোলাকার রিং-এর ভিতর। প্রতি বছর গাছে দু’বার অণুখাদ্য সার প্রয়োগ করতে হয়। অণুখাদ্য সার জলে গুলে পাতায় স্প্রে করা ভাল। চৈত্র মাসে এক বার ও আষাঢ় মাসে আর এক বার।
আগাছা দমনঃ
বর্ষার পরে সার প্রয়োগের পর গাছের গোঁড়া থেকে একটু দূরে বিভিন্ন লতাপাতা বা খড় দ্বারা বৃত্তাকারে আচ্ছাদিত (মালচিং) করে দিলে আগাছা দমন সহ শুষ্ক মৌসুমে আদ্রতা সংরক্ষিত হয়।
সেচঃ
ভালো ফলের জন্য শুষ্ক মৌসুমে বা খরার সময় নিয়মিত সেচ দেয়া একান্ত দরকার। বর্ষার সময় গাছের গোঁড়ায় যেন জল না জমে, সে জন্য দ্রুত নিষ্কাশন ব্যাবস্থা করতে হবে।
ডাল-পালা ছাঁটাইঃ
মাল্টা গাছের জন্য ডালা ছাঁটাই অপরিহার্য। গাছ লাগানোর পরে ফল ধরার পূর্ব পর্যন্ত ধীরে ধীরে ডালা ছেঁটে গাছকে নিদিষ্ট আকার দিতে হবে, যাতে গাছ উচু না হয়ে চারদিকে ছড়াতে পারে। কারন পার্শ্ব ডালে ফল বেশী ধরে। কাণ্ডের এক মিটার উচ্চতার সকল ডাল ছাঁটাই করতে হবে। ডাল ছাঁটাইয়ের পরে কাঁটা অংশে ব্লাইটক্স এর প্রলেপ দিতে হবে। মরা, শুকনো, রোগাক্রান্ত ডালা ছেঁটে ফেলতে হবে।
![](https://www.abekshan.com/wp-content/uploads/2021/07/IMG-20201026-WA0008-576x1024.jpg)
ফল পাতলাকরণ ও ব্যাগিং
মাল্টা গাছে থোকা থোকা ফল ধরে। সমস্ত ফল রাখা হলে ফল ছোট ও নিন্ম মানের হয়। এজন্য প্রতি পুস্প মঞ্জুরিতে সুস্থ্য ও সবল দেখে দুটি ফল রেখে, বাকীগুলো ছোট (মার্বেল আকৃতি) থাকা অবস্থায় ছাঁটাই করে দিতে হবে। কলমের গাছ প্রথম বা দ্বিতীয় বসর থেকে ফল দেয়া শুরু করে। গাছের ভালো বৃদ্ধির জন্য প্রথম ২ বসর ফল না রাখাই ভালো। ফলের আকৃতি সবুজ হওয়ায় পাখি বা পোকার আক্রমণ কম হয়। তবে পরিপক্কতার পূর্বে ব্যাগিং করলে অবাঞ্ছিত পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ফলন ও ফল সংগ্রহঃ
ফলের পরিপক্কতার সাথে সাথে ফলের গাড় সবুজ বর্ণ, হালকা সবুজ বর্ণে বা ফ্যাঁকাসে সবুজ হতে থাকে। মাল্টা, সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসে আহরন করা যায়। গাছ প্রতি ৩০০-৪০০ টি ফল ধরে। বিঘা প্রতি ফলন ২.৫ টন। ফল সংগ্রহের পর নষ্ট বা আঘাত প্রাপ্ত ফল আলাদা করতে হবে। ভালো মানের ফল গুলো পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে ঠাণ্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।
একটি কথা বলে রাখা দরকার, মুসাম্বি যেহেতু ১৫ ফুট দূরে-দূরে বসানো হয়, সেহেতু দু’টি গাছের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় প্রথম পাঁচ-ছ’বছর বর্ষাকালে বিভিন্ন ধরনের সব্জি, বিরি কলাই, চিনা বাদাম, বরবটি ইত্যাদি চাষ করে আয় বাড়ানো যায়।
লেখকঃ কৃষি গবেষক, পল্লী শিক্ষা ভবন, বিশ্বভারতী, শ্রীনিকেতন
ছবি ঃ সৌরভ মন্ডল এবং পঙ্কজ সরকার