স্লিপিং পিলস

পায়েল বন্দ্যোপাধ্যায়

 

– কি রে দিদি, তুই আজকেও ওগুলো খেলি?

– হ্যাঁ, ওই গুলো না খেলে আজকাল আমার আর ঘুম আসে না।

– যা হয়েছে সব ভুলে যা, আর কতদিন মনে রাখবি বল? পাঁচ বছর হয়ে গেছে ওই ঘটনার, আজও তুই নিজেকে দোষী মনে করিস !

– ভালো লাগছে না আমার, ঘুমিয়ে পর।কাল আবার সকালে উঠতে হবে।

– কাল তোর বিয়ে আর তুই আজও……!

– আমার কিছু শুনতে ভালো লাগছে না মিলি, শুয়ে পড় প্লিজ !

এতবার করে বলার পরেও কথা শুনলো না দিদি ! রোজ রাতে ওই ঘুমের ওষুধ না ওর খেলে ঘুম আসে না। অসহায়ের মতো তাকিয়ে মা-বাবাই বা কি করতে পারে ? তারা অনেক কিছুই তো করেছে, তার পরেও ফিরে পায়নি সেই আগের প্রাণ- চঞ্চল তিন্নিকে!

“কাল তিন্নির বিয়ে, শ্বশুর বাড়ি গিয়ে যে কি করবে মেয়েটা কে জানে !”
বড় চিন্তা লেগে থাকে মা বাবার মনে।
তাকে কিছু বলেও লাভ নেই, যদি আবার অন্য কিছু করে বসে…….! না না, ভাবতেই পারছে না তিন্নির ফ্যামিলির কেউ সেই আট নয় বছর আগের ঘটনা।

তখন সবে সবে কলেজে ঢুকেছে তিন্নি।বন্ধুদের সাথে তখন এখান ওখান যাওয়া শুরু হয়েছে। বাড়ি থেকে তেমন বাধা দেয় নি তিন্নির মা।এখনকার মেয়ে, সবকিছুই করতে হবে । শুধু সন্ধ্যের আগে বাড়ি ঢুকলেই হলো।

তখন সবে নতুন ভালোলাগা শুরু অর্ণবের সাথে। তিন্নি কেন, অর্ণবকে দেখে কলেজের সব মেয়েই পাগল ! কিন্তু,অর্ণব তিন্নির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। অর্ণবও তিন্নিকে পছন্দ করে।অপরদিকে সিনিয়র ব্যাচের অয়ন ক্যাবলা কান্ত , যে কিনা তিন্নিকে পছন্দ করে । তিন্নির কলেজের প্রথম দিন থেকে তাকে মনে মনে ভালোবাসে।অয়নকে পাত্তাও দেয়না তিন্নি।সবে সবে কলেজে ঢুকে তিন্নি তখন আকাশে উড়ছে। অর্ণবের প্রেমে পাগল। অয়নের মতো একটা ক্যাবলা কান্তকে কেন তিন্নির মতো প্রাণ চঞ্চল মেয়ে পাত্তা দেবে?

বেশ কিছুদিন ভালোলাগালাগি চলতে চলতে অবশেষে অর্ণব আর তিন্নির প্রেমটা বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে। কলেজ শেষে এদিক ওদিক যাওয়া, ঘুরে বেড়ানো- এর জন্য বাড়িতে প্রচুর বকাবকিও খেত তিন্নি দেরি করে বাড়ি ফিরতো বলে।কিন্তু তখন সবে নতুন প্রেম, কোনো কিছুর যেন তোয়াক্কাই করতো না সে।

এইরকমই একদিন কলেজের সবাই মিলে ঘুরতে যাবার প্ল্যান বানায়।বাড়ির বাইরে রাত কাটানো দু’দিনের জন্য। তিন্নির বাবা মা কিছুতেই যেতে দিতে রাজি না হলে, বেশ কান্না কাটি শুরু করে তিন্নি ! এমনকি খাওয়াদাওয়াও বন্ধ করে দেয়। তারপর কিছু বন্ধু বাড়িতে এসে তিন্নির বাবা মা কে রাজি করায়, তিন্নিকে ঘুরতে যেতে দেবার জন্য। তিন্নির বাবা মা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়ের জেদের কাছে হেরে গিয়ে যেতে দিতে রাজি হয়। অর্ণব ও যায় ওদের সবার সাথে ঘুরতে। বেড়াতে গিয়ে দু’জনে আরও কাছাকাছি আসে। অর্ণব আর তিন্নি মিলিত হয় দু’জন দু’জনের সাথে।

তিন্নি যখন ভাবে যে তাদের প্রেম আরো গাঢ় থেকে গাঢ়তর হবে,ঠিক তখনই অর্ণব তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও বানিয়ে বার বার ব্ল্যাকমেল করে তিন্নিকে। বাধ্য করে তাকে বারবার মিলিত হতে। পরে তিন্নির বাড়িতে এবং সব বন্ধুদের মোবাইলে ভিডিওটা পাঠিয়ে দেয় অর্ণব। এরপর পুলিশ, কোর্ট, আইনি সহায়তা সব নেওয়ার পর পরিস্থিতি ঠিক হলেও, সমাজে বদনাম হয়- শুধু তিন্নির। বন্ধু বান্ধব কলেজ আত্মীয় পরিজন সবাই দূরে সরে যায় তিন্নির থেকে। খারাপ চোখে দেখতে থাকে তাকে।সবার পাশে থাকার বদলে সবাই দূরে সরে যায় তাদের ফ্যামিলির থেকে। তার মধ্যেও নিজের পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ায় তিন্নি।আজ পরিস্থিতি ঠিক হলেও সেই দিন গুলোর কথা কিছুতেই ভুলতে পারে নি তিন্নি। আজ তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। ঘুমের মধ্যেও দুঃস্বপ্ন হয়ে আজও আসে সেই দিন। আর সেখান থেকেই তার এই স্লিপিং পিলসের নেশা। ওইগুলো না খেলে তিন্নির ঘুম আসেই না ! সেই সময় শুধু একজন তিন্নি আর ওর ফ্যামিলির পাশে ছিল কলেজের সেই ক্যাবলা ছেলেটা- অয়ন। এখন অয়ন তিন্নির অফিসের বস। এখন ও তিন্নিকে অফিসে শুনতে হয় ওপরে ওঠার জন্য তিন্নি বসকে ফাঁসিয়েছে। অফিসেও বিভিন্ন কথা শুনে এসে বাড়িতে ওই পিলস গুলো খেয়ে শান্তিতে ঘুমোতে চায় তিন্নি।

আজ অয়ন আর তিন্নির ফুলশয্যা। অয়ন আর অয়নের ফ্যামিলি সব জেনেই তিন্নিকে গ্রহন করেছে। তিন্নির পছন্দের ফুল দিয়ে আজ সাজানো হয়েছে তিন্নি আর অয়নের ফুলশয্যার খাট। সব নিয়মকানুন শেষে আজও তিন্নি স্লিপিং পিলস খেতে যায় !

– “না তিন্নি আজ থেকে আর তুমি ওগুলো খাবে না।
– না অয়ন ওইগুলো না খেলে আমার ঘুম আসে না।
– ঘুম না এলে তিন্নি আমরা রাত জেগে গল্প করবো, তবুও আজ থেকে তুমি আর ওই গুলো খাবে না।”

এই বলে তিন্নির হাত দুটো সজোরে চেপে ধরে বিছানায় তিন্নিকে কাছে নিয়ে এসে বসে অয়ন । তারপর নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে বিভিন্ন গল্পে ভুলিয়ে রাখে তিন্নিকে। তিন্নি ও আজ কতদিন পরে কারো সাথে হেসে কথা বলে। সে ভাবতে থাকে এই সেই অয়ন যাকে সে কিনা পাত্তা দিত না, ওই অর্ণবের জন্য !

– “অয়ন আমায় ক্ষমা করে দাও, সেদিন আমি……
– না আজ কোনো পুরনো কথা নয়। তিন্নি আজ সব পুরোনো ভুলে সব কিছু নতুন করে শুরুর দিন।”

বলে কাছে টেনে নেয় তিন্নিকে। তারপর কখন গল্প করতে করতে তিন্নি অয়নের বুকের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েছে টের ও পায়নি সে। না আজ থেকে তিন্নির আর স্লিপিং পিলসগুলোর দরকার নেই। আজ থেকে অয়নই তার স্লিপিং পিলস।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twenty + seven =