হঠাৎই একদিন ট্রেনে

চিন্ময় ভট্টাচার্য

ট্রেনে যারা নিত্য যাতায়াত করেন, কমবেশি এই অভিজ্ঞতা তাদের সকলেরই হয়। প্রতিদিন যিনি ন’টা পাঁচের ট্রেনে ওঠেন, হঠাৎ একদিন তিনি আসেন না। প্রথমে সহযাত্রীরা ভাবতে থাকেন শরীর খারাপ হয়েছে। দিন গড়িয়ে সপ্তাহে পড়ে, সপ্তাহ গড়ায় মাসে – তিনি আর আসেন না । সহযাত্রীরা ভেবে নেন তিনি আর কখনোই ট্রেনে উঠবেন না। তারপর একদিন হঠাৎই তিনি আবার ট্রেনে উঠে পড়েন, সহযাত্রীরা তার উপস্থিতি টের পান। ভারতীয় ফুটবলের অবস্থাও ঐ নিত্যযাত্রীর অনুপস্থিতির মত। আছে কি নেই দেশের বেশিরভাগ মানুষ টেরই পান না। আইএসএল ভারতীয় ফুটবলে ঐ ন’টা পাঁচের ট্রেনে হারিয়ে যাওয়া যাত্রীর মতই হাজির হয়েছে। সে যে আছে বোঝানোর একটা সুযোগ হয়েছে। এই ট্রেন মিস করলে সে সুযোগ চলে যাবে । ফুটবল জীবিত না মৃত কোনদিনই জানতে পারবেন না সহযাত্রীরা ।

আইপিএল, আইবিএল, আইকেএল-এর পর এবার আইএসএল । খেলার জগত এখন ‘আই’ময়। এই আই মানে আমি নয়, চোখও নয় – ইন্ডিয়ান। ভারতীয় ক্রীড়া জগত ইন্ডিয়াময়। আইপিএল চালু হওয়ার পর ক্রিকেটের, বিশেষ করে কুড়ি কুড়ি ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বহুগুন বেড়েছে, বৃদ্ধ দিদিমা, রান্নার মাসি, শাহরুখ খানের প্রেমে পড়া সদ্য কিশোরী সবাই এখন ক্রিকেটপ্রেমী। সিরিয়াল ছেড়ে, প্রেমিকের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছেড়ে, বাজারে দরাদরি ছেড়ে আইপিএল সিজনে আমজনতা ক্রিকেটমুখী। তাতে ক্রিকেটের কতটা উন্নতি হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তর্কে তর্কে গরম কাবাব ঠাণ্ডা করে রাত কাবার করা যেতে পারে। তবে ক্রিকেটের প্রসার এবং প্রচার যে অনেক বেড়েছে তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। এই প্রচার এবং প্রসারের লক্ষ্যেই ফুটবল এবার ‘আই’-এর স্মরণাপন্ন।

এই মুহূর্তে শক্তিশেলের আঘাতে মৃতপ্রায় ভারতীয় ফুটবলে আইএসএল-ই একমাত্র মৃতসঞ্জীবনী। ফুটবলের সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক আছে এরকম সবাই তৃষিত নয়নে তাকিয়ে আছে আইএসএলের দিকেই। আর সেই লক্ষ্যেই দুনিয়া ঢুঁড়ে খুঁজে আনা হয়েছে প্রাক্তন বিশ্বকাপার, চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রাক্তনী, প্রাক্তন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে। ভারতের মেহতাব হুসেন খেলছেন ব্রাজিলের ইলানোর সঙ্গে, রহিম নবী খেলছেন আনেলকার দলে, দেল পিয়েরো খেলছেন শিলটন পালের সঙ্গে। দেল পিয়েরো এখন ৩৩, পিরেসের বয়স ৪০, গারসিয়া প্রায় ৩৫। ফুটবল জীবনের একেবারে সায়াহ্নে পৌঁছে যারা ভারতে এসেছেন তাদের অনেকেই অবসর নিয়ে ফেলেছেন বেশ কয়েকবছর আগে। খুব নির্মম সত্যিটা হল, ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি এশিয়ার জাপানের মত দেশে খেলার মতো শারীরিক সক্ষমতা ওদের কারোরই নেই। কার্যত পেনশন প্রকল্পে ওরা এখন ভারতমুখী। বলা হচ্ছে এই সব বিশ্ববিখ্যাত খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেললে ভারতীয় ফুটবলারদের মান উন্নত হবে। সত্যিই হবে? তিরিশের কোঠায় পৌঁছে যাওয়া ডেঞ্জিল ফ্রাঙ্কো, সুব্রত পাল, ক্লিফোরড্‌ মিরান্দা পাসিং, রিসিভিং কভারিং শিখবেন নতুন করে! সম্ভব, এই বয়সে বেসিক স্কিলের উন্নতি করা ? উন্নতমানের কোচ, অনুশীলন পদ্ধতি, পাশে বিশ্বের প্রথম সারির খেলোয়াড়রা – এসবের ফলে টেকনিক্যাল কিছু উন্নতি হতে পারে, খেলোয়াড় জীবন আর একটু দীর্ঘায়িত হতে পারে, কিন্তু তাতে ভারতীয় ফুটবল জেগে উঠবে না, ভারত বিশ্বকাপে খেলার যোগ্য হয়ে উঠবে না।

তাহলে কি এই আইএসএল শুধুই টাকা কামানোর খেলা? শুধুই হৈ চৈ বাঁধিয়ে কিছু লোকের গুছিয়ে নেওয়ার খেলা? যেরকমটাই কিনা হয়ে এসেছে এই এতগুলো বছর? না, তাও নয় । আইএসএলের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত, ইউথ ডেভেলপমেন্ট। সিনিয়র দল চালানোর পাশাপাশি যুব দলেরও উন্নতি করবে ওরা। আর সেটাই ভারতীয় ফুটবলের জিয়নকাঠি। যদি সত্যিই যুব উন্নতিতে মন দেয় আইএস এলের দলগুলি- জিকো, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, জেমস, মাতারাজ্জিরা ঘাড় ধরে তুলে দেবেন ভারতীয় ফুটবলকে । দশ, পনেরো কুড়ি বছরের মধ্যে এই যুবরাই ভারতকে পৌঁছে দেবে বিশ্ব ফুটবলের দরবারে। আর সেটাই আমাদের ফুটবল বেঁচে থাকার ভরসা ।

তাহলে সোজা কথাটা সোজাসুজি বলে ফেলাই ভালো। এক দু বছরের মধ্যেই পাল্টে যাবে আমাদের ফুটবল – এমন স্বপ্ন যারা দেখাচ্ছেন, যারা দেখছেন – তারা ভুল করছেন। এত তাড়াতাড়ি এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়, হবেও না। আমাদের চোখের শান্তি হবে, প্রতিদ্বন্দ্বীতা বাড়বে, ফুটবল ঠিক কতটা এগিয়ে গেছে সে সম্পর্কে চাক্ষুষ জ্ঞান লাভ করব তার বেশি কিছু নয়। অন্তত সামনের এই কটা বছরে। ততদিন আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে, ভরসা রাখতে হবে কোচ, ক্লাবের ওপর, সময় দিতে হবে আমাদের বাচ্চাদের, গোকুলে বেড়ে ওঠার মতোই যারা বেড়ে উঠবে আইএস এলের আঁতুড়ঘরে । যারা একদিন হঠাৎ উঠে পড়বে নটা পাঁচের রানিং লোকালে, জানান দেবে বেঁচে আছি, আমরা বেঁচে আছি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 − three =