ধর্মান্তর

তপন চন্দ ##

  অভি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করেছে ডানদিকের কোনা দিয়ে পেটকাট্টি ঘুড়িটা ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে অনেকদূর চলে গেছে। ঘুড়িটা অনেক ছোট দেখাচ্ছে। দেখে বোঝার উপায় নেই কোথা থেকে ওটা ওড়াচ্ছে। কিন্তু অভি ঠিক বুঝতে পেরে গেছে যে, ওটা ওদের বাড়ি থেকে আরও ১০-১২টা বাড়ি পেছনে সাততলা বাড়ির স্বপনদার ঘুড়ি। স্বপনদা এপাড়ায় ঘুড়ি ওড়ানোয় ওস্তাদ। দারুণ টেনে খেলে। ঘুড়ি অনেকটা বাড়িয়ে দিয়ে ডানদিক থেকে বাঁদিকে গিয়ে আবার ডানদিকে এমন চ্যাঁ চ্যাঁ করে টেনে ওপরে তোলে যে একসঙ্গে ৫-৬ টা ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে যায়। কেউ বুঝতে পারে না, কে কোথা দিয়ে এমন টেনে দিলো। অভি তুলিকে সাবধান ক’রে দিল’।-” তুলি লাটাইটা ঠিকমত ধরিস। দূরে পেটকাট্টিটা দেখেছিস? ছোট দেখতে হলে কিহবে, ওটা দোতে ঘুড়ি। অনেকদূরে ব’লে ছোট দেখাচ্ছে। ওটা টানবে”।

           “ওটা কার ঘুড়ি দাদা”?-লাটাই হাতে অভির ছোট বোন তুলি জিজ্ঞেস করে।

           “ওটা সাততলা বাড়ির স্বপনদার ঘুড়ি। তলায় প’ড়ে টানা শুরু করলেই, আমিও গোত্তা মেরে ঘাড়ে ফেলবো। তুই শুধু লাটাই ঢিলে রাখবি। ঠিকমত ঘাড়ে ফেলে লাট দিতে পারলে, স্বপনদার ঘুড়ি ভোকাট্টা হ’য়ে যাবে”।

         যা ভেবেছিল ঠিক তাইই ঘটল। খানিকটা এগিয়েই পেটকাট্টিটা চ্যাঁ চ্যাঁ ক’রে টানা শুরু ক’রলো। একসঙ্গে চাঁদিয়াল, মুখপোড়া, ময়ূরপঙ্খীকেকে কেটে যেই অভির জয়হিন্দের নীচে এলো, অভি সঙ্গে সঙ্গে গোত্তা মেরে পেটকাট্টির ঘাড়ে ফেলে, দিল লাট। হাওয়ার টান ছিল। স্বপনদার পেটকাট্টি ভোকাট্টা হ’য়ে গেল। দুজনেই সমস্বরে চীৎকার ক’রে উঠল,”ভো ও ও কাট্টা আ আ”।

         ওরা পেছনে তাকিয়ে দেখলো, দূরে সাততলা বাড়ির ছাদ থেকে স্বপনদা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে,আর স্বপনদার লাটাইম্যান তাড়াতাড়ি সুতো গুটিয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ অভি দেখলো, অনেকদূর থেকে একটা লাল রঙের দোতে ঘুড়ি কেটে গিয়ে টলতে টলতে এগিয়ে আসছে। ও তুলিকে বলল,” তুলি একটা লাল দোতে ঘুড়ি আসছে। তুই লাটাইটা ঠিকমত ধর, আমি চিল ছাদে উঠে কাটা ঘুড়িটা ধরছি”!

         “চিলছাদে উঠবি! ওটাতো ন্যাড়া ছাদ!”

         “কিচ্ছু হবে না। নাহ’লে ঘুড়িটা পাবোনা।”

         “সাবধানে যাস দাদা”!…………..লগা নিয়ে অভি জলের পাইপ বেয়ে চিলছাদে উঠে গেল’। ততক্ষণে লাল দোতে ঘুড়িটা ওদের ছাদ পেরিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে, কিন্তু ওর সুতোটা তখনও ওদের বাড়ি আর বিল্টুদের বাড়ির মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। অভি তাড়াহুড়ো করে সুতোটা ধরার জন্য লগাটা বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু নাগাল পেলনা। অভি ছাদের একদম ধারে গিয়ে লগা বাড়ালো,কিন্তু তাতেও নাগালে এলনা। একটু আরেকটু করে কার্ণিসে নেমে লগা বাড়াতেই সুতোটার নাগাল পেয়ে গেল। নীচ থেকে তুলি রুদ্ধশ্বাসে দেখছে দাদার কান্ডখানা। ভয়ে দমবন্ধ হয়ে গেছে।..সুতোটা লগায় পেঁচিয়ে কাছে টানতে যেতেই কার্নিস গেল ভেঙ্গে, সঙ্গে সঙ্গে হতভম্ব তুলির চোখের সামনে অভি তিনতলা বাড়ির চিলছাদ থেকে পড়ে গেল একদম নীচে। তুলি দৌড়ে ছাদের ধারে গিয়ে তাকিয়ে দেখল, একদম নীচে দাদা চিৎ হয়ে পড়ে আছে! মাথার পাশদিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। তুলির মাথা ঘুরতে লাগল, চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। “দা দা” বলে চীৎকার করে তুলি অজ্ঞান হয়ে ছাদে পড়ে রইল।                           1

         জ্ঞান যখন ফিরল, তুলি দেখল, ও বিছানায় শুয়ে।ওর মাথার একপাশে পাড়ার গোপাল ডাক্তার বসে আছে। পাশের বাড়ির বোস কাকীমা,ওদের ছেলে বিল্টু,স্বপনদার বাবা শিবু জেঠা,জেঠিমা আরো অনেকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে। দাদা, মা-বাবা কাউকেই দেখা যাচ্ছে ন। ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। গোপাল ডাক্তার বলল,” ভীষণ শক পেয়েছে। ওর এখন মানসিক বিশ্রাম দরকার। একটা ট্যাবলেট দিচ্ছি, ওকে এখন বিস্কুট আর দুধ খাইয়ে ট্যাবলেটটা খাইয়ে দেবেন। ও ঘুমিয়ে পড়বে। আমি এখন চেম্বারে যাচ্ছি।  ফেরার সময় আরেকবার দেখে যাবো”।- বলে গোপাল ডাক্তার ব্যাগথেকে একটা ট্যাবলেট বের করে বোস কাকীমাকে দিয়ে চলে গেলেন।

        জেঠিমা কয়কেকটা বিস্কুট আর গ্লাসে করে দুধ নিয়ে এসে বললেন,” একটু বসতে পারবি তুলি”? তুলি চারদিকে তাকিয়ে দাদাক খুঁজতে লাগলো।

       “চিন্তা করিস না। তোর দাদাকে নিয়ে তোর মা-বাবা হাসপাতালে গেছে, এক্ষুণি ফিরে আসবে”।-বলে বোস কাকীমা আস্তে করে বিছানায় বসিয়ে দিলেন।

    ” বিস্কুটটা আর দুধটা খেয়ে ওষুধটা খেয়ে নে মা, সব ঠিক হয়ে যাবে”।…..বিস্কুটদুধ খেয়ে তুলি ট্যাবলেটটা খাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর চোখ দুটো ভারী হয়ে এলো। ঘুমিয়ে পড়ার আগে ওর চোখের সামনে ভাসতে লাগলো’ অনেক নীচে মাটিতে দাদা চিৎ হয়ে পড়ে আছে! মাথা থেকে বেরিয়ে আসছে লাল রক্তের ধারা ‘।

        সন্ধে ৭-টা। কলকাতার নামকরা সরকারি হাসপাতাল। রোগীর আত্মীয় স্বজনের থাকার জায়গাটা লোকারণ্য। বেশীরভাগই উত্তর কলকাতার বেনিয়াটোলা স্ট্রীটে অভিদের পাড়ার। সবাই নিস্তব্ধ কোন এক অমোঘ আশঙ্কায়। থেকেথেকে অভির মা কল্যাণীর কাতর প্রার্থনা শোনা যাচ্ছে, ” ঠাকুর! আমার অভিকে ভাল করে দাও।”

     “কোনো চিন্তা কোরোনা, কলকাতার সেরা নিউরোসার্জন ডাঃ কুনাল সেনগুপ্ত ওর অপারেশন করছেন। অভি ভাল হয়ে যাবে।”- বলে সুপ্রিয় স্ত্রীকে প্রবোধ দিতে লাগল।

        “কোন চিন্তা করবেন না মাসীমা, অভির জন্য আমরা যতদূর যাওয়া যায় ততদূর যাবো। সবাই মিলে ওকে ঠিক ভাল করে তুলবো”।-বলে স্বপনদা পাশে এসে

বসলো।…….চারদিক নিস্তব্ধ। সময় এগিয়ে চলেছে। একসময় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে মাইক এ ঘোষণা হল, ” অবিনাশ চ্যাটারজীর বাড়ির লোক ডাঃ কুনাল সেনগুপ্তের সঙ্গে কথা বলুন।”……..সবাই ছুটল ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার নির্দিষ্ট জায়গায়।

       ডাঃ কুনাল সেনগুপ্ত আগে থেকে অপেক্ষা করছিলেন। সুপ্রিয় এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমি অবিনাশের বাবা, ও অবিনাশের মা। ডাক্তারবাবু কেমন আছে ও?”

      “ডাক্তারবাবু আমার অভিকে ভাল করেদিন, আপনার যা চাই তাই দেবো।”-বলে কল্যণী কাঁদতে আরম্ভ করল।

     “দেখুন,আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। এর বেশী কিছু করণীয় নেই। তারপরেও …… ওনার কাছে প্রার্থনা করুণ। উনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পরেন।২৪ ঘন্টা না গেলে কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা সবাই চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

     “স্যার, দরকার পড়লে আমরা চাঁদা তুলে flight এ বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবো।”-বলে স্বপনদা এগিয়ে গেল। “সে রকম হলে বলবেন স্যার।”

      “সেরকম অবস্থায় ও নেই। ওকে এখন কোন মতেই নাড়াচাড়া করা চলবে না। ২৪-ঘন্টা যাক। অবস্থার উন্নতি হলে তখন চিন্তা করা যাবে।”                           2

      ডাঃ সেনগুপ্ত ভেতরে চলে গেলেন।…….সময় যেন কিছুতেই কাটেনা। সবাই কেমন এক আশঙ্কায় থমকে আছে। প্রায় ১৬-১৭ ঘনটার পর ডাক্তারদের মধ্যে একটা ব্যস্ততা দেখা গেল।স্বপনদা অন্য এক ডাক্তারের কাছে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,”স্যার, অভির কি অবস্থা””?

      “ভাল না”-বলে ডাক্তার বাবু হনহন করে চলে গেলেন।…একসময় সমস্ত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ডাঃ সেনগুপ্ত আরও তিনজন ডাক্তারকে নিয়ে মাথা নীচু করে ধীরে ধীরে বললেন,”দেখুন আমরা সমস্ত রকম চেষ্টা করলাম, কিন্তু ওকে ফেরানো গেল না।”

    কল্যাণী'” অ ভি “বলে চীৎকার করে অজ্ঞান হয় পড়ে গেল। সুপ্রিয় যেন পাথর হয়ে গেছে। “সুপ্রিয়বাবু, আপনাকে একটা কথা বলার আছে।যদিও আপনাদের এই অবস্থায় বলতে আমার খুব খারাপ লাগছে,তবুও বলা আমার কর্তব্য।” বলে ডাঃ সেনগুপ্ত কিছুক্ষণ থামলেন।তারপর রুমাল দিয়ে মুখ মুছে আবার শুরু করলেন,” দেখুন, অবিনাশের মস্তিস্ক পুরোপুরি মৃত।কোন ভাবেই তা ফিরে আসবে না।কিন্তু ওর চোখ,কিডনী হৃদপিণ্ড আরও কিছু অঙ্গ এখনও ঠিক আছে।এই অঙ্গগুলিও ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে। এই অঙ্গগুলো অন্য কারো দেহে প্রতিস্থাপন করে কাজে লাগানো যেতে পরে।” সুপ্রিয়র মানসিক অবস্থা তখন বাস্তব জগতের বাইরে।কোনমতে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল,”দেখুন ওর মায়ের মত ছাড়া আমি একা সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। আর দেখছেন তো ওর মায়ের অবস্থা।” “ঠিকই। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে বলবেন। যদি কিছু করা যায়।” স্বপনদা দৌড়ে এসে একদম ডাক্তারের পায়ে পড়ে গেল,”স্যার আরেকবার দেখুন না, অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে যদি কিছু করা যায়।” ডাঃ সেনগুপ্ত স্বপনদাকে জড়িয়ে ধরলেন,”দেখুন ঐটুকু একটা কিশোর।কত সম্ভাবনা। আমরা কি ওর জন্য চেষ্টা করব না? কিন্তু যে অবস্থায় এসেছিল, তখনই হাতের বাইরে চলে গেছে।”

     অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে কল্যণী ধড়মড় করে উঠে বসল।”অভি কোথায়?”

      “অভি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। তুমি ওর জন্য আর কেঁদোনা কল্যাণী।                                

      “না,অভিকে না নিয়ে আমি কিছুতেই যাব না। তুমি আমাকে অভির কাছে নিয়ে চল।” সুপ্রিয় স্ত্রীকে ডাঃ সেনগুপ্তের কাছে নিয়ে আসে। ডাক্তারবাবুকে দেখে কল্যাণী ডুকরে ওঠে, “ডাক্তারবাবু আমার অভিকে বাঁচিয়ে দিন ডাক্তারবাবু, ওকে ছাড়া আমি কিছুতেই বা্ঁচব না ডাক্তারবাবু।” অপ্রস্তুত ডাঃ সেনগুপ্ত মাথা নীচু করে বসে থাকেন। কিভাবে স্বান্তনা দেবেন এই সন্তান হারা মাকে।একসময় বলেন,”আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম।

      কিন্তু ও যে অবস্থায় এসেছিল,সেই অবস্থা থেকে কেউ বাঁচে না। ঠিক আছে চলুন আপনাকে ওর কাছে নিয়ে যাচ্ছি।” স্খলিত পদক্ষেপে কল্যাণী এগিয়ে যায় অভির বেডের দিকে। ডাক্তারের নির্দেশে কিছুক্ষণের জন্য খুলে ফেলা হয়েছে সমস্ত যন্ত্রপাতি। কল্যাণী দেখে চোখ বুজে শুয়ে আছে অভি ধবধবে সাদা বিছানায়। পুরো মাথাটা ব্যাণ্ডেজে জড়ানো।”অভি! ফিরে আয় বাবা”-বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে বলে “একি! ডাক্তারবাবু অভি এখনো বেঁচে আছে। আমি ওর হার্ট বিট শুনতে পাচ্ছি। ও বেঁচে আছে!”

 “ওর হৃদপিণ্ডটা এখনও কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু মস্তিস্কের মৃত্যু ঘটে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে হৃদপিণ্ডের ও মৃত্যু ঘটবে। আপনি যদি ওর হৃদপিণ্ডটা কাউকে দান করেন, তবে তার মধ্যে ওটা বেঁচে থাকবে।” “না না তা চাই না। ডাক্তারবাবু আপনি আমার অভিকেই বাচিয়ে তুলুন। ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না ডাক্তারবাবু।” বলে কল্যাণী আবার অজ্ঞান হয়ে গেল। 

    আজ মহাষ্টমী। বাইপাসের এক বিশাল ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে সুদীপার ট্যাক্সিটা। প্রায় এক ঘন্টা ধরে গাড়িটা একচুল ও এগোতে পারেনি। এখন ঘড়িতে ৮-৩০। মহাষ্টমীর লগ্ন ৯-৩০ পর্য্যন্ত। সুতরাং ৯-১৫ র মধ্যে গড়িয়ায় পৌছালে মহাষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলী দিতে পারবে।কিন্তু গাড়িতো এগোয়না। শরতের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়ায় সুদীপা ঘামতে লাগল। কিছুক্ষণ পর জ্যাম কিছুটা কাটলো। সায়েন্সসিটি পার হয়ে গাড়ি উর্দ্ধশ্বাসে ছুটলো। ঘড়িতে ৯-১৫।আজ পর্য্যন্ত কোন দিন মহাষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলী মিস হয়নি। এইবার তা ঘটতে চলেছে। রাস্তায় যেতে যেতে মাইক এ কোন এক পূজা মণ্ডপের ঘোষণা শোনা যেতে লাগল,”যারা যারা মহাষ্টমীর অঞ্জলী দিতে চান, আমাদের পূজা মণ্ডপে চলে আসুন। এটাই শেষবার।” সুদীপা চেচিয়ে ঐ পূজা মণ্ডপের সামনে গাড়িটা থামাতে বলল। ড্রাইভার মণ্ডপের খানিকটা আগে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিল। সুদীপা নির্মলকে ট্যাক্সিতে রেখে দৌড়ে পূজা মণ্ডপে ঢুকে গেল।হাঁপাতে হাঁপাতে ঠাকুরমশাই এর কাছ থেকে পুষ্পাঞ্জলীর ফুল নিয়ে নিল।দেখল সবাই অবাক হয়ে ওকে দেখছে।সবাইকে ফুল দিয়ে বিশুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে ঠাকুর মশাই পুষ্পাঞ্জলীর মন্ত্র বলতে লাগলেন। প্রথমবার মন্ত্রপাঠ করে ফুলটা ঠাকুরের পায়ে ছুঁড়ে দেবার পর ডানদিকে তাকিয়ে ও অবাক হয়ে গেল। ” একি! ডাক্তার সিকান্দার এখানে মহাষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলী দিচ্ছেন?” বিস্ময়ে ও দ্বিতীয়বার ফুল না নিয়ে ওই দিকেই তাকিয়ে রইল। ডাঃ সিকান্দারও সুদীপাকে দেখতে পেয়েছিল। উনি ইশারায় ওকে ফুল নিয়ে পুষ্পাঞ্জলী চালিয়ে যেতে বললেন। পুষ্পাঞ্জলী শেষ হলে উনি এগিয়ে এলেন।” কি? খুব অবাক হয়ে গেছেন,

 না? সে অনেক কথা। আমার বাড়ি কাছেই। আসুন না, ওখানে বসে সব কথা বলা যাবে। অবশ্য আমি ম্লেচ্ছ। আমার বাড়ি যেতে আপনার  আপত্তি থাকতে পারে।”

     “না,না তা নয়। আমি ট্যাক্সি করে গড়িয়ায় বাবা মায়ের কাছে যাচ্ছিলাম। লগ্ন শেষ হয়ে আসছে বলে এখানে নেমে মহাষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলীটা সেরে নিলাম। তাছাড়া ট্যাক্সিতে আমার হাজবেন্ড আছেন।”  “ও,আচ্ছা। ঠিক আছে,আরেকদিন সময় করে চলে আসবেন।”  ট্যাক্সিতে ফিরে ও ঘটনাটা নির্মলকে বলল।” জানো, আজ একটা অবাক কান্ড দেখলাম”

     “কি কান্ড””?

     “ডাঃ সিকান্দারকে দেখলাম পূজা মন্ডপে।”

     “এই জায়গাটা তো মুসলিম এরিয়া।”

     “না গো!উনি মহষ্টমীর অঞ্জলী দিলেন! অথচ উনি কিন্তু সাত্ত্বিক মুসলমান।”

     “আশ্চর্য্য। হয়তো কোন ঘটনায় উনি দেবী দুর্গার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন।

    কলকাতার এক বিখ্যাত সরকারী হাসপাতাল। সিনিয়ার সিস্টার সুদীপা চক্রবর্তী কাজকর্ম সেরে নির্দিষ্ট জায়গায় বসে ভাবছেন ডাঃ সিকান্দারের কথা। বেশীদিন নয় উত্তরবঙ্গ থেকে পদোন্নতি পেয়ে এই হাসপাতালে এসছেন।ডাঃ সিকান্দার এখানকার কার্ডিয়োথোরাসিক সার্জন।সার্জারিতে যেমন অসাধারণ,ব্যবহারটা তেমনি অমায়িক। সব সময় হাসিমুখ।ওনার ব্যবহারেই কার্ডিয়াক পেসেন্টরা অর্ধেক সেরে ওঠেন।নিষ্ঠাবান মুসলমান। রমজানের সময় এক ফোঁটা জল মুখে দেন না। একিদন তো জিজ্ঞাসাই করে ফেলেন, 

     “স্যার,আপনি ডাক্তার মানুষ।আপনি কি করে এসব মানেন? এতে তো শরীরের ক্ষতি হয়।আপনি তো শিক্ষিত”। একটুওকিছু মনে না করে ডাঃ সিকান্দর বললেন,”শিক্ষিত হলেই কি এসব মানতে নেই? আসলে কি জানেন, সেযুগে যাঁরা এসব ধর্মীয় অনুশাসন প্রবর্তন করেছিলেন, তাঁরা এ যুগে আমাদের থেকে বেশী শিক্ষিত ছিলেন। এই যে কৃচ্ছসাধন করে চলি, এতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, আমাদের শরীর অনেক মজবুত হবে।অনেক ঝড় ঝাপটাতে ও আমরা কাহিল হব না।”     4

     সেই ডাঃ সিকান্দার কিনা মহাষটমীর অঞ্জলী দিচ্ছেন!   

     “কি ব্যাপার, অত কি ভাবছেন”?–চমকে উঠে সুদীপা দেখল, কখন ডাঃ সিকান্দার সামনে দঁড়িয়ে আছেন, খেয়ালই করেনি। অপ্রস্তুত হয়েও সুদীপা ওনাকে বসতে বলল,

    তারপর কপট ঝাঁঝ দেখিয়ে জবাব দিল, “ভাববার বিষয় তো একটাই। আপনি।”

     “মুসলমান মানুষ অথচ মহাষ্টমীতে পুষ্পাঞ্জলী দিচ্ছে। তাই না? সে অনেক কথা। আচ্ছা,আপনি আমার পুরো নামটা জানেন?”

      “আপনাকে আমি ডাঃ সিকন্দার বলে জানি।”

      “অনেকেই আমার পুরো নমটা জানে না। নাঃ এই ব্যাপারটাতে নজর দিতে হবে।”-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাঃসিকান্দর আবার বলতে শুরু করলেন. “ছোটবলায় আমার

      শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হত।একটুতেই হাঁপিয়ে উঠতাম। বাবা আখতার হোসেন পঙ্খীরাজকে দিয়ে ভিক্টোরিয়ার সামনে ঘোড়ার গাড়ি চালান। আমার অবস্থা দেখে নিয়ে গেলেন

     হাসপাতালে। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বললেন আমার হা্র্ট নাকি ফুটো। অপারেশন করে ঠিক করতে হবে। অনেক খরচ।গরীব আখতার হোসেন রোজগারের একমাত্র স্বম্বল ঘোড়ার গাড়িটা বিক্রি করে ছেলেকে সুস্থ করলেন।সংসার চালানোর জন্য রাজমিস্ত্রির কাজ ধরলেন। দিন এনে দিন খেয়ে কোন রকমে টেনে নিয়ে চলেছেন সংসারটা। আশা, যে পঙ্খীরাজকে বিক্রি করে সুস্থ করলেন ছেলেকে, সেই ছেলে একদিন বড় হয়ে পঙ্খীরাজের মত সংসারের হাল ধরবে।কিন্তু আল্লার ভাবনা অন্য। ভাল ফুটবল খেলতাম। সেই ফুটবল খেলতে গিয়ে একদিন বুকে জবরদস্ত চোট পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। পাড়ার সবাই তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেল।ডাক্তাররা পরীক্ষা করে গম্ভীর হয়ে গেল। হার্ট পুরোপুরি ড্যামেজ হয়ে গেছে। কোন উপায় নেই! একটা মাত্র উপায় আছে, তা শুধুমাত্র ব্যয় বহুল নয় অসম্ভব। সেটা হল, যদি কোন সুস্থ হার্ট দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়। পাড়ার ক্লাব আরও অন্যান্য ক্লাব অর্থ সংগ্রহে নেমে পড়ল, কিন্তু হৃদপিন্ড পাবে কোথায়? এদিকে অবস্থা একদম শেষের দিকে। চোখের সামনে মৃত্যুর হাতছানি। উপায় না দেখে আখতার হোসেন এগিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে,” ডাক্তারবাবু আমার কলজেটা দিয়ে আমার ছেলেকে বাঁচান।”

     “তা কি করে হবে?এটাতো নীতি বিরুদ্ধ।কাউকে বাঁচানোর জন্য আমরা অন্য কাউকে মেরে ফেলতে পারিনা।”………অবশেষে আল্লা যেন মুখ তুল চাইলেন। পেলাম একটা।

     দুর্র্ঘটনায় মৃত অবিনাশ চ্যাটার্জী নামে  এক কিশোরের হৃদপিন্ডের বিনিময়ে ফিরে পেলাম আমার জীবন। এক সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা হাহাকারের মধ্যদিয়ে ফিরে পেল আমার মা রোকেয়া বেগম তার ছেলের হারানো জীবন। কিন্তু আল্লার খেলই বলুন আর ভগবানের লীলা বলুন, তখনও অনেক বাকী।….দিন পনেরর মধ্যে আমাদের বাড়ির সামনে একটা বিশাল গাড়ি এসে দাঁড়ালো।পাগলপ্রায় অবিন্যস্ত বেশে বেড়িয়ে এলেন অবিনাশের মা। ঘরে ঢুকে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন,” এই তো! এই তো আমার অভি! দেখ,দেখ ওর হৃদপিন্ডটা কেমন অভির হৃদপিন্ডের মত ধুকপুক করছে। ওইই আমার হারানো অভি।” সুপ্রিয়বাবু স্ত্রীকে স্বান্তনা দিতে বললেন,”তুমি ঠিকই বলছ কল্যানী ওর ভেতরের হৃদপিন্ডটা অভিরই। কিন্তু ওতো অভি নয়। ও সিকান্দার”।

     “সে তো আমি জানি গো।কিন্তু এখন থেকে ও সিকান্দার নয়। এখন থেকে ও অভি।তুমি ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে চল।”    সে এক বিচিত্র পরিস্থিতি।দুই মা আমাকে

  জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন, বাবা আখতার হোসেন গামছা দিয়ে চোখের জল মুছছেন। কি বলবেন সন্তানহারা এই দম্পতিকে?    সেই থেকে আমি দুই পরিবারের। আমার নাম হল সিকান্দার অবিনাশ।                                                                                                           5

আমার যাবতীয় দায়িত্ব নিল আমার নতুন মা-বাবা। আমি পড়াশুনা করলাম, ডাক্তার হলাম ওনাদের কৃপায়। সবচেয়ে আশচর্য্য কি জানেন, আমার নতুন মা, মানে আমার হিন্দু মা আলাদা করে চিনে নিতে পারতেন আমার হৃদপিন্ডের আওয়াজ। অনেক আওয়াজের মধ্যে বলে দিতেন কোনটা ওর অভির।প্রত্যেক দিন জড়িয়ে ধরে একবার না একবার আওয়াজ শোনানো চাইই সিস্টার সুদীপা অবাক হয়ে সজল চোখে তাকিয়ে আছেন ডাঃ সিকান্দারের দিকে। কি বিচিত্র জীবন এই মানুষটার। চোখের জল মুছে জিজ্ঞাসা করলেন,

       “আপনার নতুন মা এখন কেমন আছেন””?

       উদাস দৃষ্টিতে জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে ডাঃ সিকান্দার বলে যেতে লাগলেন,” সে আরেক কাহিনী। মায়ের ক্যান্সার হল। প্রচন্ড শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও

      শোনাতে হত আমার হৃদপিন্ডের আওয়াজ।সেই আওয়াজ শুনতে শুনতে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তেন। কানে স্টেথো লাগিয়ে সেই আওয়াজ শুনতে শুনতে একদিন চলে গেলেন চিরনিদ্রার দেশে। তারপর এক অন্য অভিজ্ঞতা।শ্মসান ঘাটে মাকে দাহ করার সময় ঠাকুরমশাই যখন মুখাগ্নির জন্য পাটকাঠিতে আগুন দিয়ে ধরিয়ে দিলেন মেয়ে তুলির হাতে, তুলি সেই আগুন নিয়ে চলে এলো আমার কছে। “দাদা, এটা তোমার কাজ।”

       আমি তো কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তাকিয়ে রইলাম আমার রোকেয়া মায়ের দিকে।চোখের জল মুছে মা বললেন,”যা বাবা যা। এটা তোরই কাজ। আমি তোর জন্মদাত্রী মা,

     উনি তোর জীবনদাত্রী মা।” হিন্দু প্রথা অনুযায়ী সমস্ত আচার বিধি পালন করলাম।এমন কি নির্দিষ্ট দিনে আমার রোকেয়া মা আমাকে নাপিতের কাছে নিয়ে গিয়ে মাথা

      নেড়া করে দিলেন। এবার বলুন আমিকি মহাষ্টমীর অঞ্জলী দিতে পারি না?”

      “আপনি তো মুসলমান পাড়ায় থাকেন। আপনার পাড়া প্রতিবেশীরা আপনার এই হিন্দু চালচলনের প্রতিবাদ করে না?”

      “একদম না। তারা বরং অনুপ্রাণিত হয়েছে। প্রকৃত ধার্মিক অন্য ধর্মকে ঘৃণা করে না। আমার জীবন এদের অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শেখাচ্ছে হয়তো। ধর্মীয় অনুশাসন মানে জীবনের চলার পথে কিছু রীতিনীতি। উদ্দেশ্য পরমশশ্ন্তি।শান্তিতেই ঈশ্বর লাভ,শান্তিতেই আল্লার প্রাপ্তি। সেই থেকে আমাদের পাড়ায় দুর্গাপূজার প্রচলন। অনেক মুসলমান এখানে পুষ্পাঞ্জলী দেয়। বিজয়া দশমীতে  অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের বিজয়োৎসব পালন করে। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে চাঁদা আসে। তা দিয়ে কোন সমারোহ হয় না। একটা ফান্ড তৈরী করা হয়েছে। তা থেকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে গরীব দুস্থদের সাহায্য করা হয়।”

        সিস্টার মিনু এসে বলে, “স্যার ৫ নম্বর বেডের বাচ্চাটা কিছুতেই আপনার হাতে ছাড়া ওষুধ খাবে না। “

“চলুন তো একবার দেখি” বলে ডাঃ সিকান্দার এগিয়ে যান ৫ নম্বর বেডের দিকে। সিস্টার সুদীপা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে এই ধর্মান্তরিত মানুষটার দিকে। এই বিশ্বে ধর্ম নিয়ে কি হানাহানি চলছে। আর এই মানুষটা সব ধর্মকে জয় করে কি পরম শান্তিতে কাজ করে যাচ্ছেন।     

——

                                                                                                                                                                                   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − fifteen =