ভুল বশত

সুব্রত ভৌমিক, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা   ##

 আজ একটা মানুষ এসেছিল দিনটায়। যেন কোথাকার হাওয়া। সব ক’টা জানলার গার্হস্থ্য পর্দাগুলো পাখির মতো উড়ছিল। বেলা শেষের একটা অযাচিত আলো ঢুকে পড়েছিল ঘরে, রুবির আনত মুখের উপর। রুবি এখন রায়, কপালে সিঁদুর। বিয়ের আগে সে যখন এক দুপুরবাস থেকে নূপুরশব্দে নামত আর চোখের কোণে দেখত বাসস্টপটায় দাঁড়ানো একটা ছেলে আজও একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে, প্রথমে সেই চোখ ধরতে পারেনি৷ পরে তার ভাষা টের পেত৷ এভাবেই একদিন আলাপ৷ একটুই৷ পাখি এরপর ডালে এসে বসে৷ ভয়ে ভয়ে শিস দ্যায়। কিন্তু বাবার বদলি চাকরি ‘হুস্’ করে তা উড়িয়ে দ্যায়। হঠাৎই এক অন্য শহরে চলে আসে তারা। একটা মানুষ হারিয়ে যায় জীবন থেকে। সেই মানুষ এতদিন পর তার বিবাহিত জীবনে এসেছে আজ! সন্ধে সন্ধে, দিনটা হাত নাড়ছে। মানুষটা স্ত্রীর বাপের বাড়ির দিকের শুনে বড়লোক স্বামী অময় গিয়েছে কিছু মিষ্টি আনতে। ফাঁক ধরলে ওইটুকু, রুবি খানিক ছাড়া। একটা ফেলে আসা দিনের মুখোমুখি। কোলে উল। কারও সোয়েটার বুনছে৷ কাঁটাটার দিকে আনত দীঘল চোখের পাতা দুটো রেখে খামকা প্রশ্ন ঠেলল, ‘বাসস্টপটায় দাঁড়িয়ে থাকা হতো কেন?’ উত্তর নেই। রুবি রায় মুখ নীচু। দাঁতে ধরা আলতো ঠোঁট। অল্প হাসল। ছেলেটা মুখ খোলে, ‘আপনার কথা শোনা হল না।’ ‘আমার?’ রুবি রায় এবার খানিক উদাস, ‘আমার আবার কী কথা৷ ওখান থেকে চলে আসবার সময় আপনাকে অনেক খুঁজেছিলাম। পাইনি। এখন আর কোনও কথা নেই। প্রতিদিন ভাল থাকি, অভ্যেসের মতো।’ বলে হাসে। হাসিটা কেমন কথার মতন। যেন জীবনটায় কিছু থাকে, কেউ থাকে। একবার ‘সে’ ছেড়ে গেলে বাকি জীবন শুধু অভিনয়। হঠাৎই ফের স্তব্ধতা ভাঙল রুবি রায়, ‘বিয়ে হয়েছে?’ ‘না।’ ‘কেন, আমার জন্য? পথে আর কেউ পড়েনি?’ ‘সব পথে সবাই পড়ে না।’ ‘যে পড়ে?’ ‘হয়তো থাকে না।’ ‘কিন্তু আসে তো।’ মানুষটা চমকে তাকায়। তারপর চুপ৷ তারপর চলে যায়। ফের যে-কে সে-ই। কিন্তু রুবি রায় এবার বাধ সাজে। পুরোপুরি পোষ মানতে চায় না। এভাবে রাত। রাতের বিছানায় সরীসৃপের মতো গা বেয়ে একটা হাত এগোয়। ঘড়িতে সময়ের শব্দ। আচমকা একটা চাপা স্বর বাজে, ‘আহ্, আজ থাক না।’ ‘কেন?’ ‘এমনি। ভাবছি একটা জিনিস।’ ‘কী?’ ‘একটা সম্পর্ক, জীবন।’ অময় এই আত্মজাগরণ ধরতে পারে না। আমল দ্যায় না। খানিক বাদে টয়লেটের আলো জ্বলে ওঠে। ফিরে এসে রুবি রায় দ্যাখে, অময় আর জেগে নেই। সশব্দ নাক ডাকছে। একটা হাহাকার! সমস্ত ভেতরটা যেন হু হু করে ওঠে। এই গ্রহণের রাতে প্রতারিত জীবনের মতো সারা বুক খালি হয়ে যায় কেন! টের পাচ্ছে সে? রুবি রায় হঠাৎ নাড়া খায়। মনে হয়, কী যেন নেই। কোথায় ফেলে আসা। তাকে খুঁজতে সে এবার বিছানায় চোখ বুজে মনে মনে এক কবেকার বাসস্টপে নামে। এদিক-ওদিক তাকায়। তারপর কী একটা খুঁজতে থাকে সেখানে। এমন তো হয়, কোনও একটা ফেলে আসা দিন এভাবে একটা অভ্যস্ত জীবনের কাঁধ ঝাঁকিয়ে কখনও আস্তে ডেকে ওঠে, ‘হেই?’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 − one =