সন্ধ্যার রঁদেভু

সঞ্জীব সেন, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা ##

সৃজা  শাড়ি পরতে পরতে সুগতকে বলল মাকে বলেছো, না  আজকে  আমায় বলতে হবে ! যাও না আজকেও একটু ম্যানেজ করো না প্লিজ ।

গত সপ্তাহে তো তুমি কি সুন্দর মিথ্যে কথাটা বলে ছিলে তোমার বন্ধুর বাবা হসপিটালে দেখতে যাবে,আর গেছিলে কলেজের সব বন্ধুদের নিয়ে গেট টুগেদার আর আমাকেও নিয়ে গিয়েছিলে,

তাইতো, ভাবছি আজ আবার কি মিথ্যে কথাটা বলবো । কথাটা বলতে,সৃজা বলে উঠলো সত্যি কথা যা তাই বলবে ,বলবে সিনেমা দেখতে যাচ্ছো আর কি সিনেমা না ধারাস্নান,মায়ের সত্যবাদী ছেলে বলে কথা!

যত্তসব, কি হলো, যাও মাকে বলে এসো, আর তৈরী হয়ে নাও ।তিন টের মধ্যে না বেরলে পৌঁছাতে পারবো না।

তাহলে মাকে কি বলবো ! সৃজা এটাও তো ঠিক প্রতি রবিবারেই বাড়িতে থাকবো না,, কথাটা শেষ না হতেই সৃজা এবার জোরের সাথে বলে উঠলো তুমি যাবে ,যাও , গিয়ে বলবে আমায় নিয়ে ডাক্তার দ্যাখাতে  যাবে। ,,

ডাক্তার!মিথ্যে কথাটা বলবো,তালে সত্যি কথাই বলবে ,যা ইচ্ছা হয় তাই কর আর তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও।।

সুগত ওর মায়ের দরজায় কড়া নাড়ল। পঞ্চাশ পেরনো এক শান্ত পরিশীলিত মোহবদ্ধতার মধ্যে নিজেকে বন্দি রাখা এক মহিলা তার প্রিয়তম মানুষটিকে যখন হারিয়েছে,  তখন সংসারে জড়িয়ে লাভ কি।তাও দেখতে দেখতে বছর দশেক হয়ে গেছে।তখন  চশ্লিশ হবে।এখনও বার্ধক্য শরীরে বাসা বাধেনি  যতটা না নিজেকে  শরীর আর মন  থেকে দূরে রেখেছে ।

কি রে কিছু বলবি,

না আসলে তোমার বৌমাকে নিয়ে ডাক্তার দ্যাখাতে যাবো?

ও বৌ পাঠাল, তোর বৌ তো কিছু বলল না সকালে

যখন বললাম মন্দিরার মেয়ের শরীর খারাপ দুই দিন কাজে আসবে না,তখনও তো একবার , ,

বলল না ওর শরীর খারাপ,সুগত বলে উঠলো না মা  ঠিক শরীর খারাপ না , ইতস্ততঃ করে বলল,মানে,,,

ও বুঝেছি,  যা   দ্যাখানো হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি ফিরিস।

সৃজা শাড়ি পালটে অন্য শাড়ি পরেছে ,বলল, নাও এবার ,তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও ।

বলেছো মাকে,কি বললে !বললাম তোমাকে ডাক্তার দ্যাখাতে নিয়ে যাব ।

যাও দেখো গিয়ে  তোমার মা অন্য কিছু ভেবে বসে থাকবে।

যাওয়ার আগে সৃজা বলে যায় মা আমরা একটু বেরোচ্ছি আর আসতে কিন্তু আটটা বাজবে,ডাক্তারের কাছে কত ভীড় হবে কে জানে! ,  

ছেলে বৌ চলে যেতে খাটে গিয়ে বসল ,জানালার দিকে চেয়ে দেখল একটা মেঘ মাথা তুলে এগিয়ে আসছে বৃষ্টি হতে পারে । উঠে গিয়ে সেই ব ইটা নিয়ে আসল” ন হন্যতে ” হালকা ঠান্ডা একটা হাওয়া এল, মনে হল,অন্য কোথাও বৃষ্টি হয়েছে আর হাওয়াটাও বেশ ভাল লাগছে।

উঠে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল, হঠাৎ চোখটা কেমন ঝাপসা লাগছে , মনে পড়ে গেল ফেলে আসা সময়ের কিছু স্মৃতি।

এমনই এক বৃষ্টির দিন ছিল ,এত বৃষ্টি হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি, কোনো বাসের দ্যাখা নেই ভাবলাম দুশো ত্রিশ বাসটা পেয়ে যাব সুবিধা হবে !

শ্বেতার সঙ্গে চলে গেলেই ভালো হতো, ভাবছিলাম আর ঠিক তখন , এক পুরুষ কন্ঠে ডাকল  ট্যাক্সির ভিতর থেকে, উঠে এসো , আমি ডানলপ নামিয়ে দেবো ওখান থেকে বাস বা অটো পেয়ে যাবো, কিছু না ভেবেই উঠে পড়লাম। সত্যিই এর পর দেরি হয়ে যেত,

বললাম, স্যার আপনি এদিকে কোন কাজ ছিল ?

বললেন , না, বিশেষ কিছু না, একটু। একাডেমিতে এসেছিলাম , দরকারে, আর তুমি ? ভাবলাম আমি যে নন্দনে আড্রে হেপবার্ণের ” লাভ ইন আফটারনুন” দেখতে এসেছি বলা ঠিক হবে না, মিথ্যা কথা বললাম ,  বললাম, আমি তো এসেছিলাম এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে, স্যারের এমন দীপ্তভঙ্গি যে কোন মেয়েই প্রেমে পড়তে বাধ্য, আমিও পড়েছিলাম।  আসলে প্রেমে  পড়ার কাছে বয়সটা কোন ম্যাটার করে না ।

পাশাপাশি যেতে যেতে ভাবছি আমিও  কি তবে স্যারের  প্রেমে পড়ে যাচ্ছি !

পাশ থেকে কেউ যেন বলল তুই জানিস না স্যার বিবাহিত, ছোট ছেলে আছে , বৌ কিছু দিন আগে মারা গেছে , এত সব জেনেও , না এই সুযোগটাই নিচ্ছিস !

ডানলপ চলে এল , অটো করেই এলাম, ঘরে ঢুকতেই মা বলে উঠল রাতটা বাড়ির বাইরেই কাটাতে পারতিস ।

কোন কথা না বলে ঘরে ঢুকে পরলাম, তারপর কলেজে যতবার দেখা হয়েছে কেমন যেন স্যারকে আঁকড়ে ধরার ইচ্ছে মনের ভিতর দানা বাধছে , নিজেকে বহুবার প্রশ্ন করেছিলাম মনে মনে ভেবেছি এটাই কি তবে অসম বয়সী প্রেম , না চাইতেও ভিতর থেকে একটা আকর্ষণ  তৈরী হয় ।  কেউ যেন উসকে  দিল, বলল, তুই কি ভাবছিস  স্যার কবে বলবে , সত্যি কথা বলতে আমি কোনদিন নিজে থেকে বলতে পারিনি । স্যারই একদিন নিজে থেকেই বলল জানো, সুজাতা ছেলেকে আজ নতুন মা এনে দেবো বলে কথা দিয়েছি ! আর । আমার কেমন জানি মনে হল স্যার কি কিছু বলতে চাইছে না হলে এই কথাটা এই ভাবে বলছে , না  ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু বোঝাতে চাইছে, তাই যদি হয় তাহলেও, আমি বলব কি করে তাছাড়া বাড়িতেই বা কি বলব মা বাবাকে, যে আমি এক বিবাহিতকে বিয়ে করবো যার পাঁচ বছরের এক ছেলে আছে আর বয়সেও অনেক অসম, নিজেকে অনেক প্রশ্ন করেছি কোন উত্তর পাইনি ।

হয়ত ভগবানের কোন ইচ্ছা ছিল, না হলে কোথা থেকে কি করে এসব হয়ে গেল,,

তখনই একটা আওয়াজ  হল , মনে হল  রান্না ঘর থেকে ,                দেখে আসতে  গেল,

না, কেউ তো নেই, চা খাওয়ার ইচ্ছাটা জাকিয়ে বসেছে,

একটু চা খেলে ভাল হত,

একার জন্য চা করতে ভাল লাগে! বইটা হাতে নিয়ে খাটে  এসে বসল ‘ন হন্যতে” প্রথম পাতায় পরিস্কার হাতে লেখা আমাদের বিবাহিত জীবনের পাঁচ বছরে । হাত রাখল   স্পর্শের অনুভূতি। পাখির ডানা ঝাপটানোর মত মনে পড়ে গেল কিছু ঘটনাপ্রবাহ । তিনি বলেছিলেন সেদিন রাতে, “আমায় দেওয়া সব কথাই রেখেছ তুমি,

তোমাকে বলেছিলাম আমার ছেলেকে মায়ের সব ভালবাসা দেবে তো ! তুমি সবটুকু দিয়েই ভালবেসেছো এর জন্য আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো” , আমি কাঁদছিলাম এমন উপহাসটা কেন করলে , কেন বইটা দিয়ে বললে যখন আমি থাকবো না তখন বইটা পড়ো, আমি বলেছিলাম আজ আপনার কাছে একটা জিনিস চাইব এক নারী হিসাবে এক স্ত্রী হিসাবে, হয়ত বেশী চাওয়া হয়ে যাবে , আমি আপনার সন্তানের মা হতে চাই শুধুমাত্র আপনার স্ত্রীর দাবি নিয়ে,, সেই রাতে  আমাদের প্রথম বার মিলন হয়েছিল আর শেষবারের মতও, বলেছিলেন সুজাতা তুমি কি সারাজীবন আমায় স্যার বলে যাবে, আমি হেসে বলেছিলাম অসুবিধা কি?

সে রাত ছিল এক স্ত্রী  হিসাবে আমার পরম পাওয়া, আমি প্রশ্ন করেছিলাম অমৃতের খোঁজ দিতে পারে এমন কোন জিনিস,

 তিনি বলেছিলেন পার্থিব সবকিছুই একদিন নশ্বরতার দিকে নিয়ে যায় , একমাত্র অমায়িক প্রেম অমৃতের সন্ধান দিতে পারে, সে রাতে আর কোন কথা হয়নি  , সেই রাতের উৎস হতে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান মৈত্রেয়ী আমাদের জীবনে এলো । হায়, জীবন  শুধুই নির্মম পরিহাস ! যেন, বায়ুর স্রোতে মেঘের জড়ো  হওয়া, আবার বায়ুর স্রোতেই  মেঘের চলে যাওয়া!

আজও, মনে আছে সেইদিনের কথা হাসপাতালে শেষবারের মত আমায় কাছে ডেকে বলেছিলে ,

আমি যাচ্ছি সবাইকে যেমন একদিন  চলে যেতে হয়, দুঃখ করো না, চিন্তা কিসের, তোমাকে তো আমি আমাদের ছেলে আর আমাদের মেয়েকে  দিয়ে গেলাম, আর যা কিছু সঞ্চয় সবকিছুই দিয়ে গেলাম , আমি  ওনার  বুকে মাথা রেখে বলেছিলাম কি হবে অমন সম্পদ দিয়ে যা অমৃতের সন্ধান দিতে পারে না ?

চলে গেলেন সে রাতেই,,,

মাথাটা ধরে আছে চা না খেলেই নয় , গ্যাস অন করতে পরিস্কার শুনতে পেল সেই দীপ্ত কন্ঠ আমার জন্য এককাপ? দু কাপ চা বানিয়ে টেবিলে রাখল।

কত দিন পর আবার একসাথে চা খাচ্ছি বলতো । আর দ্যাখো, আজকেও রবিবার, তোমার ছেলে বৌ সিনেমায় গ্যেছে, তুমি বাড়িতে একা  একা বোর হচ্ছ, তাই দ্যাখা করতে এলাম, খুশি হয়নি তুমি!

ভাল আছ সুজাতা,,,

মনে আছে সুজাতা রবিবার গুলো আমাদের কেমন আনন্দে কাটতো, সারা সপ্তাহে ওই একটা দিন ছিল ভীষণ রকম আনন্দের,

মনে থাকবে না, আসলে রবিবার গুলো একটা নিছকই ছুটির দিন ছিল না , আপনার মনে আছে আমি আপনার কাছে মাতৃত্ব চেয়েছিলাম সেই দিনটাও ছিল রবিবার  ,,

মৈত্রেয়ী আমাদের মেয়ে, এখন ব্যাঙ্গালোরে, সামনের মাসে আসছে

জানি  ,,সুজাতা   সবকিছুই জানি

স্যার আপনার মনে আছে আপনাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আচ্ছা অমায়িক প্রেমই কি  সেই অমৃতের সন্ধান দিতে পারে আর অমৃতই বা কি ? এই সসাগরা পৃথিবী যদি পুরোটাই আমার হয় তাহলেও কি সেই অমৃতের খোঁজ পাব, ,,আপনি কিছু বলেন নি, হেসেছিলেন!

হা হা, সুজাতা আজকেও তুমি আমায় স্যার বলবে,

আপনি তো আমার স্যারই ।

সেই দিনের প্রশ্নের উত্তর আমি আজকে দিতে পারি, সেদিন দিইনি কারণ তখন সময় হয়নি ,

শোনো যে জিনিসটা পেলে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবে পেয়েছি,, পেয়েছি ! সেটাই অমৃত,, এতদিন তুমি চাওয়ার আগে সন্দিগ্ধ মনকে প্রশ্ন করে এসেছো সেই মনই হচ্ছে মানুষের পরম শত্রু  আবার এই মনের ভিতর ই থাকে সেই সত্য , সেই সত্যকে অন্বেষণ কর, মানুষের ভিতর থাকে দুটো আধার একটা অন্তরের আরেকটা বাইরের, একটা  সম্পদের আরেকটা সৌকর্যের, একটা সুখের, আরেকটা আনন্দের ।

চাওয়ার আগে বিবেকের কাছে দ্বারস্থ হতে হয় ।

তখনই কলিং বেলের আওয়াজ হতেই তিনি বলে উঠলেন এবার আমায় যেতে হবে ,

দরজা খুলতে দেরি করায় সৃজা সন্দেহের বসে দরজায় কান পেতে শুনতে পেলো মা কার সাথে যেন কথা বলছে ।

সৃজা সুগতকে বলল ,সুগত তোমার মা কার সাথে যেন কথা বলছে এদিক দিয়ে কোন কথা শোনা যাচ্ছে না । কে হতে পারে বলতো !  তোমার মায়ের পুরনো প্রেমিক নয়ত!

বাধ্য হয়ে সুগত  দরজায় হালকা ঢাক্কা মারল,,

 সুজাতা বলল, দাঁড়া খুলছি,,

তবে ,যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যান,

স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রী  কি নিয়ে বাঁচে , শুধু আধখানা হৃদয় !

তিনি বললেন আজ যাই ,বলবো অন্য কোনদিন ।

 সুজাতা দরজা খুলে দিতে,ঘরে এসে সুগত  জিজ্ঞেস করল ,  মা এত দেরি করলে , 

সুজাতা বলল  তিনি এসেছিলেন,,,

সৃজা গোয়েন্দার  দৃষ্টিতে দেখল

টেবিলে দু কাপ চা, এককাপ  খালি আরেকটা কাপ  যেমন চা তেমনি পড়ে রয়েছে

সৃজা নিজের ঘরে ঢুকে গেল   যাওয়ার আগে  সুগতকে ডেকে নিয়ে গেল। চলে এসো ।

  সুজাতা নিজের ভিতরে একটা নির্জনতা  টের  পেল,

আর  মনের গভীর থেকে কথাটা বেরিয়ে এলো ”ন হন্যতে হন্যমান শরীরে “।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × 5 =