রাজা

মুকুলিকা দাস ##

রাজু হঠাৎ একটা দুশো টাকার নোট খুঁজে পেলো। কমলা রঙের চকচকে একটা নোট।রাজু গ্যারেজে কাজ করে রোজ পঞ্চাশ বা বড়জোর একশো টাকা পায়।কিন্তু দুশো টাকা কোনদিন পায়নি।
রাজু নোটটা উলটে পালটে দেখছে, আর ভাবছে টাকাটা কি ও নেবে!
মা বলে যে অন্য কারো কিছু না বলে নেওয়াকেই চুরি করা বলে,রাজু কি তাহলে চোর হবে!
কিন্তু রাজুর কাছে তো টাকা থাকেনা, মাকে দিয়ে হাতে থাকে দশ টাকার মতোন। ওই টাকায় রাজু একটা লজেন্সও কিনতে পারেনা। ওর কতদিনের ইচ্ছে একটা নতুন গেঞ্জি কিনবে,এখন যেটা পরে সেটা একদম ফুটিফাটা। তারপর ঘরে বোনটাও রোজ একটা পুতুলের বায়না করে, মায়ের কাশির ওষুধটাও তো শেষ।
এই দুশো টাকায় সব হয়ে যাবে।
কিন্তু এটা চুরি করা হয়ে যাবেনা!
– ধুর, পেটে ভাত নাই, আর চুরি…
রাজু টাকাটা পকেটে ঢোকায়।

তারপর চলে বিশু কাকার দোকানে,অনেকদিন ধরে ওর ইচ্ছে একটা পান্তুয়া খাওয়ার।
  – কিরে,তুই এখানে! কি চাই, এখন রুটি দিতে পারবনা, যা তো।
  – না কাকা, আমি একটা পানতুয়া নেবো।
  – কি! বাকিতে পানতুয়া বেচবো, মাথা খারাপ নাকি!
  – না কাকা, টাকা আছে তুমি দাওনা!
  – একটা পানতুয়া পঁচিশ টাকা, তুই দিবি কি ভাবে?

রাজু চুপ হয়ে যায়, পঁচিশ টাকা! এই টাকায় তো এককিলো চাল হয়ে যায়। না না টাকা নষ্ট করে লাভ নেই!

রাজু এবার মাছের বাজারে ঢোকে। সেই কোন ছেলেবেলায় বাবার সাথে আসতো,তখন রোজ মাছ থাকতো পাতে।বাবা মারা যাওয়ার পর মাছের গন্ধ ও ভুলে গেছে ও!

  – রুইমাছ কতো কিলো দাদু?
  – ও কি, তুই এ বাজারে কি করিস।
  – বলোনা, মাছ নিবো।
  – দুশো টাকা কিলো, নিবি!
  – এতো দাম!!
  – হে হে, মাছের কাচা গন্ধে পেট ভরাই, বাড়িতে নিতে পারিনা। এসব গরীবের খাবার নয়। বাড়ি যা।

সত্যি কি দাম! পুরো টাকাটাই তো চলে যেতো মাছের পেটে!

না, এবার আর খাবারদাবার না। সোজা রাজু ফুটপাতের দোকানে ওর গেঞ্জি খুঁজতে থাকে।

রিডাকশনের মাল, তাও একশোর নীচে নেই!

মায়ের ওষুধ ও দেড়শো টাকা।

মাথা গরম হয়ে যায় রাজুর, ভেবেছিল এই দুশো টাকায় না জানি কতো কি হবে? কিন্তু এখন!
মনে হচ্ছিল টাকাটা ছুঁড়ে ফেলে দেবে নালায়!

  – ভাইয়া, দুটো পয়সা দিবে দুদিন কিছু খাই নাই। ভাইটাও কিছু খেতে পায় নাই।

জামার কোনা ধরে টেনেই যাচ্ছিল মেয়েটা।
রাজু মন দিয়ে দেখে,গায়ে মেয়েটার জামা প্রায় নেইই।শরীরে হাড় গোনা যায়, জটা ধরা লাল হয়ে যাওয়া চুল,আর মাথায় ব্যান্ডেজ। কোলে ভাইটাকে একটা ছেঁড়া কাথা দিয়ে কোনমতে ধরে রেখেছে।
ভাইটার শরীরে একটা কালো তাবিজ ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।

মেয়েটি আবার একই সুর আওড়াতে থাকে।
  – ভাইয়া দুটো পয়সা…
  – নে।
  মেয়েটা হা করে তাকিয়ে থাকে রাজুর দিকে। তারপর খুব সুন্দর একটা হেসে বলে,
  – থ্যাংকু।

মেয়েটার যাওয়ার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে রাজু, হাসিটা একদম ওর বোনের মত। অদ্ভুত একটা আনন্দ হয়।
কয়েক বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর কাকার বাড়িতে যখন থেকেছিলো রাজু, তখন কাকা ওকে আর ওর বোনকে বলেছিলো ভিখারির বাচ্চা।

রাজুর ইচ্ছে হচ্ছিল আজ সেই কাকাকে নিয়ে এসে দেখায় যে সে দিতে জানে, ভিখারির মতন নিতে না।

সন্ধ্যা নামতে চললো, বাড়ি ফিরতে ফিরতে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে চললো রাজা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven − 4 =