সেই লোকটা

 প্রণবকুমার চক্রবর্তী,  বারাসত, উত্তর ২৪ পরগনা  ##

       নতুন গাড়ি কিনেই ইন্দ্রনীল আর দেরি করেনি। খড়গপুরের শো-রুম থেকেই সোজা বারাসতের বাড়িতে রওনা হয়েছিলো, মায়ের সাথে দেখা করতে। ফোনে মাকে বলে রেখেছে, সকালেই  মাকে নতুন গাড়িতে চাপিয়ে নিজেই চালিয়ে নিয়ে গিয়ে আমডাঙার করুণাময়ী কালী মন্দিরে পূজো দেবে। 

       কলকাতায় পৌঁছবার আগেই মোবাইলটা বেজে উঠলো। ইন্দ্রনীল গাড়িটাকে রাস্তার বাম পাশে দাঁড় করিয়ে কথা বলতেই বুঝতে পারে ওর ছোটবেলার বন্ধু সুপ্রিয় ফোন করেছে। বহুদিন হল আমেরিকায় চাকরি নিয়ে চলে গেছে। ওখানে এক আমেরিকান সহকর্মীকে বিয়েও করেছে। কয়েক দিনের জন্য কলকাতায় এসেছে। আগামী কাল বিকেলের ফ্লাইটেই চলে যাবে। ওর সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে। এই মুহূর্তে ও কোথায় আছে জানতে চাইছে। পারলে ও আর ওর বউ ডরোথি এখনই গিয়ে দেখা করবে।

     সুপ্রিয়ের গলা শুনেই  ইন্দ্রনীলের মনটা উৎফুল্লিত হয়ে ওঠে। পাল্টা বলে ওদের আর কষ্ট করে ওর কাছে যেতে হবে না। ও এই  মুহূর্তে কলকাতাতেই আছে। ওরা কোথায় উঠেছে বললেই গিয়ে হাজির হয়ে দেখা করে নেবে। কারণ, আগামী কাল সারাদিন ও বারাসাতে বাড়িতেই থাকবে। তবে, সকাল থেকেই বাড়ির এবং  অফিসের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকবে। ওদেরকে সময় দিতে পারবে না।

      ইন্দ্রনীলের প্রস্তাবে ওরা রাজি হতেই, ও আধ ঘন্টার মধ্যেই এসে ওদের ডেরায় হাজির হল। সল্টলেকের বাইপাসের ধারে – হোটেল সোনার।

      প্রায় ছ”বছর পরে দুই  বাল্যবন্ধুর দেখা। স্বভাবতই গল্পে গল্পে অনেকটাই সময় পেরিয়ে গিয়েছিল। যখন হুঁশ ফিরলো, ইন্দ্রনীল  ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো – রাত্রি একটা বেজে গেছে। ইন্দ্রনীল উঠবার প্রস্তুতি নিতেই সুপ্রিয় এবং ওর বউ ডরোথি ওকে বারবার অনুরোধ করলো – অত রাত্রে একা একদম নতুন গাড়ি ড্রাইভ করে অতটা পথ না যাওয়াটাই ভাল। ওরা রিসেপশনে বলে রাখছে, ও রাতটা কাটিয়ে একদম ভোরে ভোরেই যেন বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু, ইন্দ্রনীল ওদের ওই অনুরোধে কান না দিয়ে বলে, ওর পক্ষে এই মুহূর্তে হোটেলে  ওদের সাথে রাত কাটানো সম্ভব নয়। বাড়িতে ওর মা চিন্তায় সারা রাত জেগে বসে থাকবে। হার্টের পেশেন্ট। দু দু”বার স্ট্রোক হয়ে গেছে। ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাবে। কোনও  অসুবিধা হবে না।

      ওরাও আর বাধা দেয়নি।

       ইন্দ্রনীল গাড়ি নিয়ে নিউ-ব্যারাকপুর বিটি কলেজের মোড়ের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ স্টার্টটা বন্ধ  হয়ে গেল! অনেকবার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনও লাভ হল না। বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে বনেটটা তুলে সব কিছু ভালো করে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখে কিছুই বুঝতে পারলো না। হতাশ হয়ে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস  ছেড়ে হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো – প্রায় সাড়ে তিনটে! 

      মেকানিক ছাড়া মোটেই  সারানো সম্ভব নয়।ইন্দ্রনীল খুব চিন্তায় পড়ে, এত রাত্রে মেকানিক কোথায় পাবে? সব দোকানপাট বন্ধ। তার উপরে রাস্তায় কোনও গাড়িই চলছে না। কিছু একটা ঝামেলা  নিশ্চিত হয়েছে! রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করছলো – কী করবে? তখনই দেখলো এয়ারপের্টের দিক থেকে একটা বয়স্ক লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে সাইকেল চালিয়ে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে । মনে মনে ঠিক করলো, লোকটা যখন সাইকেলেই আসছে, তখন ও নির্ঘাৎ ওই দিকেরই লোক। ওকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলে হয়তো মেকানিকের হদিস  পাওয়া যেতে পারে।

       ইন্দ্রনীল বাধ্য হয়ে লোকটাকে দাঁড় করায়। লোকটি বলে যে, সে একজন মোটর মেকানিক।   লোকটার কথা শুনে ও খানিকটা উৎফুল্লিত হয়ে ওর গাড়ির সমস্যাটার কথা বলে। কিন্তু,  জবাবে লোকটা জানায় – ওই কাজ এখন সে মোটেই  করতে পারবে না। কারণ, তার ভীষন তাড়াহুড়ো  আছে। এক্ষুনি মধ্যমগ্রামে গিয়ে একজনকে একটা চিঠি পৌঁছিয়ে দিয়ে ভোর পাঁচটার আগেই এয়ারপোর্টের কার্গোতে এসে কাজে যোগ দিতে হবে।

     ইন্দ্রনীল ওকে অনুরোধ করে বলে – ও তো মধ্যমগ্রামের উপর দিয়েই বারাসাতে যাবে। যদি অসুবিধা না থাকে, ওর হাতে চিঠিটা এবং ঠিকানাটা বলে দিলেই, ও ওটা পৌঁছে দেবে। 

     লোকটা রাজি হয়ে যায়। লোকটা বলেছিল – ওর নাম ইব্রাহিম। বাড়ি মন্ডলগাঁতিতে, তেমনি কাছাকাছি হতেই  ওর কেন যেন মনে হচ্ছিলো – লোকটা ওর খুব চেনা! আগে কোথায় যেন দেখেছে!

      যাই হোক কাজ সারতে সারতে প্রায় সাড়ে চারটে হয়ে গেলো। ইন্দ্রনীল কথা মতো লোকটাকে এয়ারপোর্টের কার্গোতে পৌঁছে দিতে চাইলে, ও ওকে থ্যাঙ্কস্ জানিয়ে হাতে একটা খাম তুলে দিয়ে বলে – মধ্যমগ্রামের বসুনগরে ওই ভদ্রলোকের কাছে পৌঁছে দিতে। আর ও ওইখান থেকেই ওর কর্মক্ষেত্রে চলে যাবে ।

      ইন্দ্রনীল চিঠিটা হাতে নিয়ে ঠিকানা পড়ে নিয়ে ওর দিকে তাকাতেই, লোকটাকে আর দেখতে পেলো না। নিমেষে উধাও!

      কোথায় গেলো লোকটা! চিন্তাটা মাথার নিয়ে ইন্দ্রনীল গাড়ি নিয়ে সোজা মধ্যমগ্রামের বসুনগরে চিঠিটার প্রাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে গিয়ে দিতেই, ভদ্রলোক খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা বের করে দেখেই চমকে উঠলেন। বলে উঠলেন এটা তো ইব্রাহিমের চিঠি! এটা আপনি পেলেন কোত্থেকে? 

      – নিউ-ব্যারাকপুরে। বিটি কলেজ স্টপেজের একটু আগে। ইন্দ্রনীলের জবাব শুনে ভদ্রলোক আরোও বেশি চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলেন – ক”টার সময় ও তাকে চিঠিটা দিয়ছিল?

      – রাত্রি সাড়ে তিনটের পরে।

      – তা কী করে সম্ভব! সঞ্জয়বাবু গম্ভীর হয়ে বলেন – আমার কাছে যা খবর তাতে, ওকে তো 

রাত্রি দশটা নাগাদ কেউ মার্ডার করে গৌরীপুর কালী মন্দিরের পেছনের পুকুরে ফেলে রেখে গিয়েছিল। ইব্রাহিম একজন সন্ত্রাসবাদী দলের  প্রাক্তন সদস্য। ও ছিলো আমার সোর্স! গতকাল আমার কাছে খবর পৌঁছে দেবার জন্যই আসছিল।

       ইন্দ্রনীল কোনও উত্তর না দিয়ে মনে মনে লোকটার মুখটাকে দেখবার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

9 + 3 =