বিশ্বকাপ ২০০২ এবং ব্রাজিল

অভিজিৎ বিশ্বাস

আমার বয়স তখন ৬-৭ বছর। ফুটবল সম্পর্কে বেশি কিছু বুঝতাম না। যেটুকু বুঝতাম ওই পাড়ায় দাদাদের খেলতে দেখে আর বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে ইস্টবেঙ্গল মাঠে গিয়ে। সময়টা ২০০২ সালের মাঝামাঝি হবে, পাড়ায় পাড়ায় দেখি কোথাও সবুজ-হলুদ, কোথাও আকাশি-সাদা আবার কোথাও হলুদ-লাল রঙের পতাকা ছেয়ে গিয়েছে। প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারিনি। ভোটের আগে তো কই এরকম পতাকা দেখিনি। বাবাকে জিঞ্জেস করতে পাওয়া গেল এর উত্তর। ফুটবল বিশ্বকাপে মেতেছে গোটা বিশ্ব। কেউ ব্রাজিলের সমর্থক, কেউ আর্জেন্টিনার, কেউবা আবার জার্মানিকে সমর্থন করছে। আমি তো অবাক। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আবার কি! এদের তো শুধু ওই ম্যাপেই দেখেছি। এরা আবার ফুটবল খেলে নাকি, ফুটবল তো খেলে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান। শুনি আমার ধারণা ভুল, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে বসতে চলেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মত দেশ সেখানে সবথেকে বড় বাজি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানতে বাধ্য হলাম।

যথারীতি এসে পড়ল বিশ্বকাপ শুরুর দিন। বাড়িতে কিংবা পাড়ায়, উন্মাদনা টা সবথেকে বেশি বুঝলাম ব্রাজিলকে নিয়েই। বাড়ির বড়রাও কট্টর ব্রাজিল সমর্থক, বাবা কেবল জার্মানির। তুর্কির সঙ্গে ব্রাজিলের প্রথম খেলা, ম্যাচের ৫০ মিনিটে বাঁদিক থেকে বাড়ানো বলে গোল পেল ব্রাজিল। গোল করলেন টাকমাথা এক ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড, নাম শুনলাম রোনাল্ডো। ব্রাজিল জিতল ১-০।
দ্বিতীয় ম্যাচে চিনের মুখোমুখি ব্রাজিল, এতদিনে ধীরে ধীরে বিশ্বকাপ ফুটবলের ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট। খেলা শুরুর ১৫ মিনিটে রোবার্তো কার্লোসের ফ্রিকিক থেকে লিড নিল ব্রাজিল। ৩২ মিনিটে রিভাল্ডোর গোল, ২-০। ৪৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে রোনাল্ডিনহোর গোল, ৩-০। ৭৫ মিনিটে রিভাল্ডোর মাইনাস থেকে রোনাল্ডোর গোল, ৪-০।
চিনের সঙ্গে খেলা দেখার পর সেই যে আমার ব্রাজিল প্রেমের শুরু, তা এখনও পর্যন্ত চলে আসছে সেই একই ভাবে। কোনওকিছুই চিড় ধরাতে পারেনি আমার আর ব্রাজিলের মধ্যে। তৃতীয় ম্যাচে কোস্টারিকার বিরুদ্ধে রোনাল্ডো, এডমিলসন, জুনিনহো এবং রিভাল্ডোর করা দুর্দান্ত গোলে আবার জিতল ব্রাজিল।
দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলায় বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে ব্রাজিলকে লিড এনে দিলেন রিভাল্ডো। ৮৭ মিনিটে ব্যবধান বাড়ালেন রোনাল্ডো। ব্রাজিল পৌঁছল কোয়ার্টার ফাইনালে।

এবার বেকহ্যাম, জেরার্ডের ইংল্যান্ডের মুখোমুখি রোনাল্ডোরা। ব্রাজিলকে ফেভারিট ধরলেও, ধারে ও ভারে, কোনওদিক থেকেই পিছিয়ে ছিল না ইংল্যান্ডও। প্রথমার্ধে গোল করে এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। ৪৭ মিনিটে রোনাল্ডিনহোর দুর্দান্ত দৌড় এবং রিভাল্ডোর ফিনিশে সমতায় ফেরে ব্রাজিল। এরপর ৫০ মিনিটে ফ্রিকিক থেকে রোনাল্ডিনহোর বিশ্বমানের গোল। ব্রাজিলের পক্ষে ফলাফল ২-১।
সেমিফাইনালে ব্রাজিলের মুখোমুখি হয় সেই তুর্কি। যাদের হারিয়ে বিশ্বকাপের জয়যাত্রা শুরু করেছিলেন রোনাল্ডোরা। ম্যাচের ৪৯ মিনিটে রোনাল্ডোর একমাত্র গোলে জয় তুলে নেয় ব্রাজিল।

এরপর আসে সেই বহু প্রতিক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ। ফাইনালে মুখোমুখি ব্রাজিল এবং জার্মানি। জার্মান গোল দুর্গের প্রহরী আবার সেই বিশ্বকাপে ফাইনালের আগে অবধি একটিও গোল হজম না করা অলিভার কান। পেপারে পড়েছিলাম, মূলত রোনাল্ডো এবং কানের লড়াই দেখতেই মুখিয়ে গোটা বিশ্ব। বাড়িতেও অন্যরকম পরিবেশ, একদিকে আমরা সকলে ব্রাজিল সমর্থক, অন্যদিকে বাবা আবার জার্মান সমর্থক। সে যাই হোক, গালে “ওর্ডেম ই প্রোগ্রেসও” লেখা হলুদ-সবুজ পতাকা এঁকে বসে পড়লাম গিয়ে ক্লাবের টিভির সামনে। কট্টর ব্রাজিল সমর্থক মানিয়েছে এবারে আমায়। খেয়াল করলাম, পাড়ার অনেকেই আবার সমর্থন করছেন জার্মানিকে। জার্মান অ্যাটাকে তাদের সে কি আনন্দ। কিন্তু সেই আনন্দ স্থায়ী হল না যখন অলিভার কানের হাত থেকে ফস্কালো বল। বলা যায়, সেদিন শুধু কানের হাত থেকে বলই ফসকায়নি, ফসকেছিল বিশ্বকাপ। পেনাল্টি বক্সের রাজা রোনাল্ডো সামনেই ছিলেন। ফসকে আসা বল জালে ঠেলতে ভূল করেননি তিনি। ৭৯ মিনিটে জার্মান কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিলেন রোনাল্ডোই। ব্রাজিল জিতল ২-০।

এরপর চলল আবির খেলা আর মিষ্টি খাওয়ার পালা। সেই হলুদ-সবুজ পতাকা নিয়ে বড়দের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালাম গোটা পাড়া। আমার দেখা সেরা বিশ্বকাপই বটে। নিজের অজান্তেই হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা করে নিল ব্রাজিল। বুঝলাম, ব্রাজিল শুধুমাত্র একটি দেশ কিংবা দল নয়। ব্রাজিল আমার আবেগ। ব্রাজিলই শিখিয়েছে ফুটবল যোগ্য।
নাহ, এরপর আর বিশ্বকাপ জেতেনি ব্রাজিল। ফুটবল বিশ্বকাপের সৌজন্যে আর বেরনো হয়নি আবির খেলতে। হলুদ-সবুজ পতাকা নিয়ে আর মিছিলও বের হয়নি পাড়ায়। গতবার যখন ফুটবলের মক্কা ব্রাজিলে বসেছিল বিশ্বকাপের আসর, তখন আমার মত আরও কোটি কোটি সমর্থক হয়তো বুক বেঁধেছিলেন আশায়। জানিনা আমার মত বালিশে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছিল কতজন। সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭ গোল খাওয়া মেনে নিতে পারিনি আজও। কান্না থামলেও আজও শুকোয়নি বুকের ভিতরের সেই ক্ষত। স্টেনগানের জবাব যতদিন না মেশিনগান দিয়ে ফেরত দিতে পারব, ততদিন হয়তো এই ক্ষত শুকোবারও নয়।
চলতি বছরেই আবারও বিশ্বকাপ। টিম নিয়েও যথেষ্ট আশাবাদী ব্রাজিল। অপেক্ষায় রইলাম নেইমার, পাউলিনহোদের হাতে বিশ্বকাপ দেখার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − 12 =

preload imagepreload image