জন্মদিন

শুভঙ্কর দে

আজ সারাদিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে। মনখারাপের বিকেল পেরিয়ে সন্ধে হতে চলল, তবু বৃষ্টি থামতে চায় না। কারেন্ট নেই। ঘর অন্ধকার। আবছায়া অন্ধকার বারান্দায় ইজিচেয়ারে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে বসে আছে অসিত। আলো জ্বালাবার প্রয়োজন মনে করেনি। এ যে তার বয়সের কুড়েমি তা ঠিক বলা যায় না। এখন তো তার বয়স মোটে চল্লিশ। তবে এই বয়সে যে একটা মানসিক অবসাদ ঘিরে ধরে , অসিতেরও সেই অবস্থা। কী হবে আলো জ্বালিয়ে ? অন্ধকারই ভালো। সেখানে মুখ আর মুখোশ চেনা যায় না। বাইরে সনসন করে হাওয়া বইছে, ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়ায় জলের ঝাপটা এসে লাগছে অসিতের মুখে; তবু তার মধ্যে কোনো বিচলতা নেই, চুপ করে বুকের উপর হাত রেখে বসে আছে, নিমগ্ন হয়ে শুনছে মোবাইলে বেজে চলা রবীন্দ্রসঙ্গীত— “আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে , যে কথা শুনায়েছি বারে বারে।…যে বাণী উঠিছে বাজি অবিরাম বর্ষণধারে।…” গানটি শুনতে শুনতে তারও গলা মেলাতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছে না। ভারাক্রান্ত মনে তার গলা কেঁপে কেঁপে উঠছে। আজ ষোলোই জুলাই। এই দিনটা এলেই তার মন ভারি হয়ে ওঠে, কোনো কাজে মন লাগে না। তারপর শেষ আষাঢ়ের ভরা বর্ষা । সারাটা দিন ধরে তার বুকটা চিনচিন করতেই থাকে। অনেক বছর তো হয়ে গেল, তবু এই মাসের তারিখটা এলেই তার মনটা খচখচ করে উঠে, প্রকৃতিও তাকে জানান দিতে থাকে। চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে পনেরো বছর আগের একটা স্মৃতি।
অসিত তখন পঁচিশ। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে পড়াশোনা ছাড়াও তার একটা ভালো গুণ হল সে ভালো গান করতে পারে। একদিন তার এক গানের প্রোগ্রামে শ্রোতার আসনে বসে গান শুনছিল রত্না। গান শুনে সে আলাপ করে অসিতের সঙ্গে। অসিত মেয়েদের তেমন পাত্তা দেয়না। তাই একটা সৌজন্যতা দেখিয়ে চলে যায়। কিন্তু অসিতের সঙ্গে গানের অনুষ্ঠানে রত্নার প্রায়ই দেখা হতে শুরু করে। আস্তে আস্তে গড়িয়ে তারা একে অপরের কাছে আসে। নিজেদের ভালোলাগা শেয়ার করে নিতে আরো ঘনিষ্ঠ হয়। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার মধ্যে অসিতের তরফ থেকে কোনো প্রেম ছিলনা। সে রত্নার সঙ্গে কোনো প্রেম পথে যেতে চায়নি। কারন অবশ্য সে রত্নাকে জানিয়েও ছিল। সে একবার প্রেমে পড়েছিল কিন্তু সাক্সেস হয়নি। রত্নাও বলেছিল যে, প্রেম কি জীবনে একবারই আসে? এক জীবনে বহুবার প্রেম আসে, প্রেম আছে বলেই আজও মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যায়নি। অসিত এর কোনো জবাব দেয়নি। সে শুধু লিভ্-ইন করে থাকতে চায় রত্নার সঙ্গে, রত্নাও অবশ্য মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তারা জানতো না শরীরের মধ্যে দিয়ে একদিন মনকে ভালবেসে ফেলা যায়। মেয়েদের ইন্দ্রিয় প্রখর হওয়ায় তারা চট করে বুঝতে পারে যে তারা প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে সেটা সহজে হয় না। একদিন রত্না বলল, “আচ্ছা আমরা তো অনেকদিন একসঙ্গে আছি, তোমার মনে আমার জন্য কোনো ফিলিংস হয় না?” অসিত এর উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করল না। কিন্তু রত্নার জোরাজুরিতে সে বলল, ‘না, বলেছি তো আমার ওসব ফিলিংস-টিলিংস কিস্সু আসে না। আমি আর প্রেম-ট্রেম বিশ্বাস করতে পারিনা।’
রত্না বলল, ”কেন?”
অসিত ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ” ধুর্! আমার ওসব ভাল লাগে না। প্রেম-ট্রেম শালা বহুত হ্যাপা। আর তাছাড়া আমি কারোর দায়িত্ব-ফায়িত্ব নিতে পারিনা। কেউ আমাতে ভর করুক তা আমি চাই না, আমিও কারোর উপর ভর পোষণ করতে চায়না।“
রত্না চুপ করে রইল। সে জানে অসিত এমনই। তবু এরকম অগোছালো ছেলেকে কি করে ভালোবেসে ফেলছে? মেয়েরা গোছালো ছেলেদের সঙ্গে সংসার করলেও প্রেমে কিন্তু এই অগোছালো ছেলেদের উপরেই পড়ে।
রত্না হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ” ষোলোই জুলাই কখন আসবে?”
প্রশ্নটা শুনে অসিত অবাক হয়ে বলল, ”কেন, সেদিন কি?”
রত্না রাগ করল না। সে জানে অসিত এরকমই। তাই সে শান্তভাবে বলল, ”আমার জন্মদিন।“
অসিত উদাসভাবে বলল, ” ও! তা সে দেখা যাবে। এখন তো বলতে পারছি না। তবে আসব।“
অসিত সেদিন এসেছিল। মনে তার সবকিছুই থাকে। কিন্তু তার খামখেয়ালিপনায় মনে করার চেষ্টা করে না। রত্নার জন্মদিনের সারাদিনটা ধরে ঘুরল, কলেজ স্ট্রীটে বই কিনল। বই গিফ্ট করল রত্নাকে। বেলাশেষে যখন বাড়ি ফিরবার জন্য অসিত হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছল তখন সে অনেকদিন ধরে যে কথাটা ভাবছিল তা রত্নাকে বলে ফেলল, ” আমাদের এখানেই থেমে যাওয়া উচিত। আমার আর ইচ্ছে করছে না এ সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে। “
তার এ কথায় আঘাত পেলেও রত্না কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সে জানত যে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো স্থিরতা নেই। আসলে একজন মানুষকে সত্যিকারের জানার জন্য আগে জানতে হয় তার আশা, তার স্বপ্নকে। অসিত কোনো দিনই তা জানার প্রয়োজন মনে করে নি।
কিছুক্ষণ পর রত্না বলল, ” এমন অভদ্রের মতো বলতে পারলে?”
অসিত জবাব দিল, ” অভদ্রকে ভালবেসে ফেলছিলে কেন? ভদ্র ছেলেদের জন্য তোমাদের শুধু সহানুভূতি থাকে। প্রেমটা যদি ওদের জন্য একটু জাগাতে ওদের কতো ভালো হতো। এনিওয়ে পারলে ক্ষমা করো। আমরা কি আর বন্ধু হয়ে থাকতে পারি না?”
রত্না বলল, “ ভুলকে ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু অন্যায়? তাকে কী আর ক্ষমা করা যায়? আর বন্ধুত্ব? যতটুকু প্রেম পেলে বন্ধু বা শত্রু হওয়া যায়, ঠিক ততটুকু প্রেম তো তোমার কাছে পেলাম না।“
অসিত চুপ করে রইল। সত্যিই তো সে রত্নাকে কোনোদিন ভালোবাসেনি । হঠাৎ লক্ষ্য করল রত্না কাঁদছে। এতদিন তার দৃষ্টি শুধু শরীরের উপর ছিল। আজ প্রথম সেই দৃষ্টিতে মনের যোগ ঘটতেই অসিত বুঝতে পারলো রত্নার মনের কথা।
সে বলল, ” রত্না দুঃখ পেওনা।“
“আমার দুঃখ তুমি বোঝো? যারা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে তারা অন্যের দুঃখ বুঝতে পারেনা।“
“কিন্তু রত্না…
রত্না হাত তুলে থামিয়ে বলল, “ আর কী বা বলার আছে?”
অসিত শান্ত হয়ে বলল, “ তোমাকে আগেও বলেছি, আবার বলছি, আমি জাস্ট লিভ-ইন করতে চেয়েছিলাম, তুমি তো জানোই আমি বিয়ে কোনোদিন করবো না। এমনকি…
ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। ট্রেন যতই এগোতে লাগলো, অসিতের দিকে তাকিয়ে থাকা রত্নার দৃষ্টি ততই ঝাপসা হতে লাগলো।
আজ পনেরো বছর পর সেই দিনের কথা মনে করে অসিত ডুকরে উঠলো। বিয়ে সে করেনি। রত্নার সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ নেই। কী জানে, আজ রত্না কী করছে?
রত্নার বাড়িতে আজ বেশ ধুমধাম। জন্মদিনে অনেক বন্ধু-বান্ধব এসেছে। তবু রত্নাকে কেমন ম্রিয়মান লাগছে। সে কি এখন সুখী নয়? না সে সুখী। আজ যে তার মেয়ের জন্মদিন। কিন্তু তার মন কিছুতেই খুশি হতে চাইনা। তার মেয়েরও যে জন্মদিন ‘ষোলোই জুলাই’।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 − four =