সম্পাদকীয়

ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ি। বাড়িতে টেলিফোন এল। সে এক ভারি গর্বের বিষয়। আমার তো ভারি রেলা তখন। বাড়িতে টেলিফোন থাকা মানে বেজায় ভিআইপি ব্যাপার স্যাপার। কারন টেলিফোন কানেকশন পাওয়াটাই দুষ্কর তখন। মোবাইলের কথা তো শুনিইনি, আমার শহর গোবরডাঙ্গায় টেলিফোন ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। কাউকে টেলিফোন করাটা যেমন স্ট্যাটাসের তেমনই ঝঞ্ঝাটের। বছর তিনেক আগে থেকে দরখাস্ত করতে হত টেলিফোন কানেকশন নেওয়ার জন্য। ভিআইপি কোটাতে নিতে গেলেও মাস ছয়েকের আগে কোন গল্প নেই। এ হেন এক পরিস্থিতিতে আমাদের বাড়িতে এল ফোন, আর এক ধাক্কায় মনে মনে বেশ খানিকটা ভিআইপি হয়ে গেলাম নিজেই নিজের কাছে। অযাচিত নম্বর বিতরণ, অকারণে যাদের ফোন ছিল গুটিকয়েক পরিচিত তাদের ফোন করা, এসব চলল কয়েকদিন। ১৯৯৯ সালে দুর্গাপুরে গিয়ে হাতে এল মোবাইল। কিন্তু তখন মোবাইলের যা দাম দর এবং কলরেট তাতে ফোন করা বা ফোন আসা দুটিতেই আতঙ্ক ছিল সমান। আমার মনে আছে যখন মোবাইল নিই তখন ফোন করলে এক মিনিটে লাগত প্রায় পনেরো টাকা। ফোন এলে সেই ফোনটি ধরে কথা বললে এক মিনিটে উঠত সাত টাকা চল্লিশ পয়সা, এটা ছিল রিলায়েন্সের কানেকশন। তাই তখনও ল্যান্ডলাইন ফোনের কদর ছিল ভালই। ২০০২ থেকে বিএসএনএল মোবাইল আনার পর থেকেই দরটা পড়তে শুরু করে। কমতে কমতে এখন জিওর ধাক্কায় প্রায় সবই কমের দিকে। কিন্তু বিএসএনএল এর ল্যান্ডলাইন রেট কমেনি সেভাবে। তাই আমার পরিচিত প্রায় কারোরই আর ল্যান্ডলাইন ফোন নেই বললেই চলে।
উদাহরণ স্বরূপ বলি আমি যে আবাসনে থাকি সেখানে চল্লিশটি পরিবারের কারোরই ল্যান্ডলাইন ফোন নেই। শুধুমাত্র আমি গোটা আবাসনে শক্তহাতে বিএসএনএল ল্যান্ডলাইনের হাল ধরে রেখেছিলাম। সমস্যা লেগেই থেকেছে, টেলিফোন প্রায়শই খারাপ হয়, ব্রন্ডব্যান্ডের লাইন প্রায়ই কেটে যায়, অফিসে বা কাস্টমার কেয়ারে কেউ ফোন ধরবার থাকে না। তা সত্বেও লাইনটি রেখে দিয়েছিলাম। একবার তো প্রায় একমাস খারাপ হয়ে পড়েছিল, বার বার বলা সত্বেও ঠিক হচ্ছে না দেখে শেষমেস এক বড় কর্তাকে বিষয়টি জানালে তার এক সপ্তাহ পরে ঠিক হয়। তবুও লাইনটি রেখে দিয়েছিলাম। টেলিফোন খারাপ হলে প্রায়ই আমার কাছে একটি এসএমএস আসত যে আমার টেলিফোন কানেকশন মেরামতির বিষয়টি দেখছেন অমুকবাবু। তার মোবাইল নম্বরও দেওয়া থাকত। বেশ কয়েকবার ফোন খারাপের পর সাহস করে একবার অমুকবাবুর নম্বরে ফোন করে বসলাম। খুব আস্তে জানতে চাইলাম বার বার আমার ফোনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে এ ব্যাপারে ঠিক কি করা যায়। প্রথমেই উচ্চকন্ঠে জানতে চাইলেন তার নম্বরটি আমি কোথায় পেলাম? কেন তাকে এই প্রশ্ন করা হচ্ছে? বিনয়ের সঙ্গে বললাম যে বিএসএনএল-ই দিয়েছে। সাফ জানালেন এসব কোম্পানির ভুল ব্যাপার স্যাপার তিনি এসব কিছু জানেন না। কিছু বলতে গেলে অফিসে এসে কথা বলতে হবে। অফিস কোনটা জানতে গিয়েই আবার ধমক খেলাম। ধমক না বলে অপমানও বলা যায়। বললেন আমি নাকি বাড়ি থেকে বেরই হই না, চোখ কানও খোলা রাখিনা, শুধু নিজেদেরটা নিয়েই থাকি। তাই যারা পরিষেবা দিচ্ছে তাদের অফিস চেনাটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মাথাটা যতটা পারা যায় ঠান্ডা রেখে গলাটা আরও ঠান্ডা করে জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ি গিয়ে টিভি দেখেন? প্রিয় চ্যানেল কি? কাজ হল, একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলেন কেন? বললাম প্রিয় চ্যানেলের অফিস চেনেন? যে এমএসও আপনার বাড়িতে সার্ভিস দেয় তাদের অফিস চেনা? যথারীতি নেতিবাচক উত্তর। বললাম, আপনার অফিস চেনাটা যদি আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে তবে আপনাকে যারা পরিষেবা দেয় তাদের সকলের অফিস চেনাটাও আপনার দায়িত্ব। জিজ্ঞেস করলেন আমি কি করি? আলগোছে বললাম, ছোটখাটো ব্যবসা করি। তার পরেই তার পরামর্শ, ‘ছেড়ে দিন ল্যান্ডলাইন। এখন তো সব সুবিধা বন্ধ, কেন রেখেছেন?’ বিশ্বাস করুন এবার সত্যি মনে হল কেন লাইনটা রেখেছি। কর্মীরাই চাইছে দায়িত্ব নিয়ে কোম্পানিটাকে তুলে দিতে, আমরা কি করতে পারি। ভবিষ্যতের জন্য তাদের কিছুই কি রেখে যাওয়ার নেই!
এখানেই শেষ নয়, বিএসএনএল অফিসে গিয়ে ফোন সারেন্ডার করব বলাতে একটা লোক খুব হাসিমুখে উৎসাহ ভরে ফর্মটা দিয়ে দিল। খুব ভাল করে বুঝিয়ে দিল কিভাবে ফর্মটা ফিল আপ করতে হবে, জমা দেওয়ার সময় কি কি সঙ্গে দিতে হবে। যেন আমি নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ার ফর্ম চাইতে এসেছি। যে জমা নিল, সে আরও হাসি মুখে জমা নিয়ে একটা রসিদ দিয়ে দিল। কেউ কিছুই জানতে চাইল না। পরে অবশ্য জমা দেওয়ার লাইন দেখে মনে হল আর কিছু জানতে চাওয়ারও নেই। ছেড়ে দেব শুনেও কোন একজন কর্মী একবারও জিজ্ঞাসা করল না কেন ছাড়বেন? কি অসুবিধা? আশ্চর্য !!! নিজেরই ঘেন্না হচ্ছিল কেন এতদিন রেখেছিলাম। অথচ এমটিএস মোবাইল উঠে যাচ্ছে ঘোষণা হওয়ার পরে ওই কানেকশন ছেড়ে দিতে চাইলে তার কর্মীরা অন্তত দশবার জানতে চান কেন ছেড়ে দিতে চাইছি। গত ছমাসে কতবার টেলিফোন খারাপ হয়েছে তার একটা হিসেব রেখেছিলাম। সেই ছবিটাও সঙ্গে দিয়ে দিলাম।
ফেসবুকে ফোন ছেড়ে দেওয়ার পোস্ট দিতেই বুঝলাম আমি প্রাগৈতিহাসিক যুগে ছিলাম। অধিকাংশ মানুষই এতদিন আমি বিএসএনএল-এর ল্যান্ডলাইনের গ্রাহক ছিলাম দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। আমার খুব খারাপ লাগল ছেলেবেলার সেই দিনগুলির কথা ভেবে। বাড়িতে ল্যান্ডলাইন এসেছে বলে গর্বিত ছিলাম, এখন ল্যান্ডলাইন রেখেছি বলে লজ্জিত হতে হচ্ছে। খবরের কাগজে মাঝে মধ্যে পড়ি বিএসএনএল গ্রাহক টানতে নানা কর্মসূচী নিচ্ছে। আমার মনে হয় এই সব কর্মসূচী বাদ দিয়ে কর্মীদের একটু কোম্পানিটাকে ভালবাসতে শেখানোটা বোধহয় বেশি প্রয়োজন। সব অফিসে বা কোম্পানিতে ভাল খারাপ দু ধরনের কর্মীরাই থাকেন। এখানে ভাল(কাজ করতে চাওয়া) কর্মীদের সংখ্যাটা কত, সেটা প্রশ্নবোধক। গুটি কয়েকজন যারা চান বিএসএনএল বেঁচে থাকুক, তাদের প্রতি রইল সমবেদনা থুড়ি শুভ কামনা। আমি খুব ইচ্ছে থাকা সত্বেও রাখতে বা থাকতে পারিনি, শুভ কর্মীরা আপনারা যদি পারেন বিএসএনএল(Bhul Se Na Le) কোম্পানিটাকে ফের বিএসএনএল(Bharat Sanchar Nigam Ltd) বানিয়ে তুলতে।
একটা অভিজ্ঞতা এবং নস্টালজিয়ার কথা বলতে বলতেই দিন কাবার। আপনাদের খোঁজ নেওয়াই হল না। সকলে ভাল থাকবেন। সামনের সংখ্যা থেকে অবেক্ষণ আসছে নতুন সাজে, নতুন রূপে। অপেক্ষায় থাকুন। পড়ুন, পড়ান, এমনি করেই ভালবাসুন আমাদের।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
সম্পাদক
অবেক্ষণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

six + nineteen =