মাতৃদায়

মৌ দাশগুপ্ত (কাটনি, মধ্যপ্রদেশ)

– সুপ্রভাত। কেমন আছো আজ মনিমা,রাতে চলে আসার সময় তো দেখেছিলাম খুব কাশছো,তা ওষুধটা মনে করে খেয়েছো তো?
— হ্যাঁরে বাবা খেয়েছি, খেয়েছি!! উফফ এক্কেবারে আমার দাদামশাই।
— ব্রেকফাস্ট করেছো? সাধনামাসি এসেছে তো? নাকি আমায় আজ একটু আগে গিয়ে তোমায় হেল্প করতে হবে?
— না না, সাধনা সকাল সকাল-ই এসে গেছে। আমার বলে সকালের জলখাবার অবধি খাওয়া হয়ে গেল…
— কি খেলে আজ?
— একটা আটার রুটি। মুসুর ডাল সেদ্ধ। ছানা। কাল তুমি যে পেঁপেটা কিনে রেখে গেছিলে তার খানিকটাও খেয়েছি। খুব মিষ্টি। তোমার জন্যও খানিকটা ফ্রিজে রেখে দিয়েছি।
— আচ্ছা সে না হয় হল। ওষুধগুলো যে বেডসাইড টেবিলে রেখে এসেছিলাম, সেগুলো নিয়েছ?
— এই নিচ্ছি তো,
— গুড গার্ল, এবার কি করবে?
— পেপার পড়ব, সাধনার সাথে বসে গল্প করব, টিভি দেখব।
— হুমম। ঠিক আছে, তোমার গ্যাসের রিপোর্ট্ করে দিয়েছি মণিমা। ইলেকট্রিক বিলও জমা পড়ে গেছে। মিউনিসিপ্যালিটি ট্যাক্স, মোবাইল বিলও মিটিয়ে দিয়েছি, ডক্টর সিনহাকে রুটিন চেক আপের কথা বলে সোমবারের আগাম এপয়েন্টমেন্টটাও ফিক্স করে নিয়েছি। তোমার রুট ক্যানালিং এর নেক্সট ডেটটাও বুধবার ঠিক করে নেওয়া হয়েছে। তাহলে বাকি রইলো খালি ব্যাঙ্কের কাজটা। ওটা সেরে দুপুরের আগেই পৌঁছে যাবো।
— হ্যাঁ বাবা, হাতের কাজটাজ মিটিয়ে এসো না তোমার সময়মত। আজ সাধনাকে একটু মাটন করতে বলেছি। তুমি দুপুরে খাবে। তুমি তো আবার মাটন খুব ভালোবাসো। একদম আমার জিষ্ণুটার মত।
— তোমার না হাই কোলেস্টেরল মণিমা, মাটন একদম না।
— আমার জন্য চারাপোনার ঝোল বাবা, তোমার জন্যই একটু মাটন করতে.বলেছি।.
— না না মণিমা, আমার ওসব চাই না।.
— তা বল্লে কি হয় বাবা। সারাটাদিন এত খেয়াল রাখো আমার। জিষ্ণুটা কাছে থাকলেও কি আর এতটা সময় দিত আমায়। এটুকু করতে দাও, তুমি তো আমার জিষ্ণুর মতই বাবা,
গত ছয় বছর ধরে কানাডানিবাসী একমাত্র সন্তানের মুখটা মনে করে চোখে জল চলে এলো একালের বিখ্যাত অভিনেত্রী জিনিয়াদেবীর। জিষ্ণুর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল চার বছর আগে ওর বাবার শেষকাজে। কথাবার্তাও তো আজকাল অনেক কমে গেছে। বড্ড কাজের চাপ ছেলেটার। তবে রোজগারও সেরকমই করে। প্রতিমাসে মায়ের নামে যে মোটা অঙ্কের চেক ব্যাঙ্কে জমা করে তা থেকেই সেটা বোঝা যায়। এই ওল্ড পার্সনস কেয়ারিং সেন্টারের ব্যাবস্থাটাও জিষ্ণুই অনলাইনে করে দিয়েছে। তাই তো বেদাংশের মত একটা ছেলেকে পেয়েছেন দিনরাত দেখভালের জন্য। খুব ভালো ছেলেটা, মনেই হয়না এখানে দেখভাল করাটা ওর চাকরি। পেটের ছেলের মতই খেয়াল রাখে ওনার। মোবাইলটা কানেই লাগানো ছিল দেবাংশের গলার আওয়াজে সম্বিত ফিরলো।
–কিন্তু মণিমা…
– না না কোন কিন্তু টিন্তু নয়। কাজ মিটিয়ে সোজা চলে এসো তো। বিকালে ড্রাইভারকে গাড়ি বার করতে বলেছি, একটু দক্ষিণাপন হয়ে ভাইয়ের বাড়ি যাবো ঢাকুরিয়ায়। জানো তো হাঁটুদুটোয় কোন জোর পাইনা আজকাল, তুমি সাথে না থাকলে যাবো কি করে?
— হ্যাঁ মণিমা এই এলাম বলে…
মোবাইলে কথা বলা শেষ করে মোবাইলটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বসিয়ে বেদাংশ গলা তোলে
— মা চা-টা তো দাও, সকাল থেকে চা-ও তো পেলাম না। এই সুমি !
— পরশু থেকে বলছি চা-পাতা ফুরিয়েছে দাদা, তুই এনে দিয়েছিস?
— ঘরে পয়সা থাকে না? দু’পা হেঁটে জগার দোকান থেকে নিয়ে আসতে পারিস নি? জোছনও তো নিয়ে আসতে পারে। আর ওতো আমাদের ধারবাকি তে জিনিসপত্র দেয়ই, আনিস নি কেন?
— ঘরে তুই ছাড়া কেউ তো চা খায়না দাদা, আর তোদের কেয়ার সেণ্টার থেকে বালিগঞ্জের যে বাড়িতে তোকে ওল্ড পারসনস কেয়ারিং এর কাজ দিয়েছে আজকাল তো সেখানেই তুই খাওয়াদাওয়া করিস , তাই…
— তাই আমার খাওয়ার পাট এ বাড়িতে উঠে গেছে। সারাদিন মুখে রক্ত তুলে রোজগার করব আমি আর এ বাড়ীর কেউ আমার সামান্য সুখ-সুবিধাটুকুর কথাটাও ভাববে না। তাই তো? নিজেরা তো তিনবেলা গান্ডপিন্ডে গিলছিস তার বেলা?
উত্তরটা দিতে গিয়েও সামলে নিল সুমি, পাঁচবছরের জোছন, মা আর মামার জোরগলার কথা শুনে দিদিমার পাশ থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে, সেদিকে একঝলক তাকিয়ে বলল
— মার জ্বরটাতো কমছেই না। উল্টে গা হাত পা ব্যাথার সাথে পেটটা বেশ ফেঁপে শক্ত হয়ে উঠেছে। মধুজেঠার হোমিওপ্যাথিতে আর কাজ দিচ্ছেনা দাদা। অন্য ডাক্তার দেখানোর ব্যাবস্থা কর। আমার ভালো ঠেকছে না, গত তিনদিন ধরে কেমন আধা বেহুঁস হয়ে পড়ে আছে বিছানায়।
— সকাল থেকে প্যানপ্যানানি শুরু করলি তো, আজ কত তারিখ খেয়াল আছে? মাস ফুরাতে আরো চারদিন বাকি। মাইনে পাবো আরো তিনদিন পর, ততদিন অবদি কোনভাবে চালিয়ে নে।
— মাকে একবার দেখে আয় দাদা। তুই কোন সকালে বার হোস, ফিরতে ফিরতেও তো সেই মাঝরাত। তাই আর তোকে মায়ের অসুখের কথা বলিনি। গতকাল থেকে বেশ বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। মা জ্বরের ঘোরে খুব তোকে নাম ধরে ডাকাডাকি করছে রে। আমি ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না। কেমন ঝিম মেরে শুয়ে আছে। তুই গিয়ে ডেকে দেখনা একবার। আমার গতিক খুব একটা ভালো লাগছে না রে।
মায়ের ঘরে গিয়ে দেখল গা-টা বেশ গরম। চাদর ঢাকা দিয়ে ঘুমাচ্ছে, তবে সেই অবস্থাতেই গোঙানির মত কিছু একটা বলছে। মুখটা শুকিয়ে আরো শীর্ণ হয়ে গেছে। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল বেদাংশের। মাকে এই অবস্থায় ছেড়ে যেতে মন চাইছে না কিন্তু ক্লায়েন্টের স্যাটিশফিকশনের ওপরই ওর কাজটা টিঁকে আছে। এখনও পার্মানেন্ট হয়নি ও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাড়িয়ে পকেট হাতড়ে খুচরো টাকাপয়সা বার করছিল বেদাংশ। বাসভাড়া বাদে বাকি পয়সাগুলো সুমির হাতে দিতে দিতে বলল,
— আজ বড্ড দেরি হয়ে গেল রে সুমি, বিকালে তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করব, দেখি মণিমার থেকে কিছু যদি ম্যানেজ করতে পারি তো মাকে ডাক্তার দেখিয়ে আনবক্ষণ, ততক্ষণ অবদি তুই একটু সামলে দে লক্ষ্মীটি !
সুমি বোধহয় এতক্ষণ জলপটি দিচ্ছিল, সেগুলো সরিয়ে ওর শাড়ীর আঁচল দিয়ে মায়ের চোখের কোণ মুছিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলল
– মায়ের অবস্থাটা দেখলি তো দাদা। দেখিস দেরি যেন না হয়।
বাড়ি থেকে বেড়িয়েই মনে পড়ল বেদাংশের যে জিনিয়াদেবীর ব্যাঙ্কের দরকারী কাগজগুলো টেবিলে ছেড়ে এসেছে, দরজাটা খোলাই ছিল। ঢুকতে ঢুকতে শুনলো জোছন ওর মাকে বলছে,
— মা, আমি বড় হয়ে যখন অনেক টাকা মাইনে আনব তখন মামার অফিসে ওই টাকাগুলো দিয়ে বলব ওরা যেন মামাকে দিদুনের দেখভালের কাজটাই দেয়, তাহলে তো দিদুন আর মামার জন্য কাঁদবে না, তাই না মা?
ঘর আর রাস্তার মাঝের চৌকাঠে থমকে দাঁড়ালো বেদাংশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen − ten =