মন হারালো মনোহরায়

পলাশ মুখোপাধ্যায়


কোথাও যাওয়ার সঙ্গে খাওয়ার একটা নিবিড় যোগ আছে৷ যে কোন রসিক মানুষই তা মানবেন৷ তাই আমাদের এই বিভাগে আমরা বেড়ানোর পাশাপাশি খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী৷রূপসী বাংলার আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে অপরূপ নানা জায়গা, সঙ্গে রয়েছে সেই এলাকার নাম করা অপূর্ব স্বাদের নানা খাবারও৷ আমাদের অনেকেরই হয়ত সেই মনোলোভা খাদ্যবস্তু বা নয়নাভিরাম সেই স্থানের নাম অগোচরে৷ ”যাওয়া মানেই খাওয়া” বিভাগে মিলবে এমনই কিছু জায়গার হদিশ৷ এই সংখ্যায় আমাদের গন্তব্য মনোহরার দেশ ”জনাই”৷

শিয়ালদা থেকে ডানকুনি লোকালে চড়ে বসলাম৷ গন্তব্য, হুগলির জনাই৷ না, ডানকুনি লোকাল সরাসরি জনাই যায় না৷ ডানকুনি থেকে ফের বর্ধমান কর্ড লাইনের ট্রেন ধরে মিনিট পাঁচেক গেলেই জনাই৷ বাসেও আসা যায় , তবে হ্যাপা বেশি৷ ডানকুনি থেকে চন্ডিতলা হয়ে যাওয়া যায়৷ হাওড়া থেকে তো ট্রেন যাচ্ছে সরাসরি জনাই৷ যাই হোক, মিনিট চল্লিশের মধ্যে জনাই স্টেশনে যখন নামলাম বিকেল তখন হবো হবো৷ শান্ত, ফাঁকা স্টেশন চত্ত্বর পার হয়ে এলাম গঞ্জের দিকে৷ নিরিবিলি পথ দেখে হাঁটতেই চাইল মন, স্টেশনের কাছাকাছি থাকা দোকান পাট ছাড়িয়ে আমি তখন পাড়ার পথে৷ মনোহরার লোভে এলেও জনাই তে কিন্তু ছোটখাটো বেশ কিছু দ্রষ্টব্য রয়েছে, আগে সেই দিকেই পা বাড়ালাম৷ বাজার ছাড়িয়ে একটু এগোতেই কালী বাবুর বাড়ি৷ প্রাচীন ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যের সাক্ষ্য বহনকারী এই মহলটি এলাকায় রাজবাড়ি নামেও খ্যাত৷

শোনা যায় ১২৩৪ সাল নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ান মহারাজা কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই বাড়ি তৈরী করেন৷ বার্ধ্যক্যের বলিরেখা স্পষ্ট রাজবাড়ির আনাচে কানাচে৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে সত্যজিত রায় বা অপর্ণা সেন কার পা পড়েনি এই বাড়িতে৷ হংসমিথুন, কিনু গোয়ালার গলি, দেবী প্রভৃতি ছবির শুটিং-এরও সাক্ষী জনাই রাজবাড়ি৷ দু মহলা রাজবাড়িতে রয়েছে নাট মন্দিরও৷ মহলের অধিকাংশটাই বসবাস অযোগ্য, তবে দূর্গা পুজোর সময় এই বাড়িই হয়ে ওঠে জমজমাট৷ আসেন অন্যত্র থাকা মুখোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা, যোগ দেন স্থানীয়রাও৷ দুশো বছরের কাছাকাছি বয়স্ক এই পুজোকে ঘিরে মুখর হয়ে ওঠে গোটা এলাকা৷ শান্ত , নিস্তব্ধ রাজবাড়িতে প্রবেশ করে কখন যে ইতিহাসের মাঝে ঢুকে গিয়েছি খেয়ালও নেই৷ সম্বিত ফিরল পায়রার বকবকম শুনে৷ ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের মায়া কাটিয়ে আবার পথে পা৷

কিছুদুর গেলেই বারো শিব মন্দির৷ বারোটি ছোট ছোট শিব মন্দির রয়েছে সারি দিয়ে৷ মন্দির সংলগ্ন এলাকাটি বড় মনোরম, নির্জন গাছপালা ঘেরা জায়গাটিতে গেলে মনে হয় দু দন্ড একটু বসি৷ সে আপনি বসতেও পারেন তার ব্যবস্থাও রয়েছে, স্থানীয় বিধায়ক তহবিল থেকে পূন্যার্থীদের জন্য করা হয়েছে বিশ্রামের জায়গা৷ বারো শিব মন্দির থেকে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই রঘুনাথ জিউ নবরত্ন মন্দির৷ স্থানীয়দের কাছে শুনলাম এই বারো শিব মন্দির এবং রঘুনাথ জিউ মন্দিরের আদলেই নাকি দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির তৈরী হয়েছে৷ জনাইয়ে রয়েছে বদ্যিমাতা কালী মন্দিরও৷ বারো শিব মন্দিরের সামনেই রয়েছে সুবিশাল জলাশয়, বসতে পারেন তার কাছেও৷ দিনের আলো কমে আসতে উঠে পড়লাম৷ হাঁটতে হাঁটতে ফের বাজারের দিকে৷

শোনা যায় বহু বছর আগে জমিদার বাড়ির কোন এক সদস্য নাকি স্থানীয় এক মিষ্টি প্রস্তুতকারককে সন্দেশ তৈরী করতে বলে কোন কাজে বেরিয়ে যান৷ কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই তিনি যখন ফিরে আসেন তখন সন্দেশ তৈরী মাঝপথে৷ সময়ের আগেই জমিদারবাবু চলে আসায় ওই মিষ্টি প্রস্তুতকারক তার তৈরী মিষ্টির মান নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন৷ তখন দ্রুত সন্দেশ বানিয়ে তার উপর দিয়ে চিনির গাড় রস ঢেলে সুস্বাদু এবং সুমিষ্ট করার চেষ্টা করেন৷ পরে সেই মিষ্টি খেয়ে জমিদারবাবু এতটাই খুশি হন যে তিনি ওই মিষ্টির নাম দেন মনোহরা৷ স্থানীয় এক বৃদ্ধের কাছ থেকে এই গল্প শুনতে শুনতে পৌছে গেছি বাজারে৷ বাজারে পৌছে আর দেরী নয়, সোজা মিষ্টির দোকানে ঢু মারলাম মনোহরার খোঁজে৷অবশেষে মিলল সেই কাঙ্খিত বস্তুটি৷ এলাকার সবকটি মিষ্টির দোকানেই মিলবে মনোহরা, স্বাদ এবং আকার ভেদে দামের পার্থক্য৷ যারা বাঁকুড়া গিয়েছেন তারা বুঝবেন মনোহরা দেখতে অনেকটা বেলিয়াতোড়ের মেচা সন্দেশের মত৷ হালকা চিনির আস্তরণে মোড়া এই সন্দেশ প্রজাতির মিষ্টির স্বাদ সত্যিই অপূর্ব৷ খানকয়েক খাওয়ার পর প্রিয়জনদের জন্য বেশ খানিকটা নিয়ে নেওয়া হল৷

শুধু মনোহরাই নয়, জনাই এসে জানলাম এখানে আরো দুটি মিষ্টিও বিখ্যাত৷ বড় বোদে এবং নিখুতি৷ না, এই দুটি মিষ্টির নাম আমাদের চেনা হলেও এখানে চেহারা এবং স্বাদ দুটিরই আলাদা৷ যারা ভাবছেন বড় বোদে মানে বড় আকারের গোল গোল বোদে তারা বড়ই ধাক্কা খাবেন জনাই এলে৷নিখুতির দুই পাশ সরু করে তা চিনির রসে ডুবিয়ে তৈরী হয়েছে বড়বোদে৷ শুকনো ল্যাংচা এখানে নাম পেয়েছে নিখুতির, তবে তার গায়েও চিনির আধিক্য৷মনোহরার যেমন দেশজোড়া খ্যাতি বড়বোদে এবং নিখুতির তা নেই বটে, তবে এ তল্লাটে এই দুটি মিষ্টিরও বেশ কদর৷ এ প্রসঙ্গে একটা কথা জানালে জনাই এর মিষ্টির কদর এবং আভিজাত্য বাড়বে বই কমবেনা, তা হলো বিখ্যাত মিষ্টি প্রস্তুতকারক ভীম চন্দ্র নাগ এবং পরান চন্দ্র নাগের আদি বাড়িও এখানেই৷ জনাইতে তাদের ছোট মিষ্টির দোকানও ছিল, পরে যা কলকাতার বউ বাজারে স্থানান্তরিত হয়৷ তবে শুধু মিষ্টিই নয় জনাইয়ে চপ-সিঙ্গাড়াও পাওয়া যায় দারুন৷ যেমন কম দাম, তেমন সেই তেলেভাজার অপূর্ব স্বাদ৷ একটাকা থেকে দু টাকা দামে এখনো এখানে চপ পাওয়া যায়, এই বাজারে যা অবিশ্বাস্য৷

খাওয়া দাওয়া সেরে এবার ফেরার পালা৷ রাত হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই, পথের পাশে ঝিঝিপোকার ডাক শৈশব ফিরিয়ে দিল৷এবারও হাঁটতে হাঁটতেই স্টেশন এর দিকে এগোলাম৷ দুপুরের নির্জন স্টেশন চত্বর এখন সরগরম৷বসেছে বাজার, এখানেও রয়েছে বেশ কয়েকটি মিষ্টির দোকান যেখানে মনোহরা মিলবে৷ তবে স্থানীয়দের মতে মনোহরা জনাই বাজার থেকে কেনাই ভালো৷ এসব দেখতে দেখতেই এসে গেল ট্রেন৷ আপাতত শেষ জনাই সফর, কিন্তু মনে রয়ে গেল ভালোলাগার রেশ৷ শান্ত গ্রাম্য পরিবেশে একটা বেলা বেশ কাটল৷ সঙ্গে নেওয়া মনোহরার বাক্সটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভালোলাগায় বুজে এলো চোখ৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen + 12 =