শুধু তুমি প্রেমিক থেক

ময়ূমী সেনগুপ্ত, কলকাতা

কৈলাস পর্বত তো সারা বছর-ই বরফে ঢাকা, আর এ সময় তো অনবরত তুষারপাত হচ্ছে। তার-ই মধ্যে নন্দী আগুন জ্বালিয়েছে। এদিকে শিব ঠাকুরের তো ওসব শীত বোধের বালাই নেই। তিনি তো শীত গ্রীষ্মে সদা নির্বিকার। কিন্তু পার্বতী মায়ের তো শীত লাগে রে বাবা। যতই তিনি মুখে না বলুন। রাজার মেয়ে। ছেলেবেলা থেকে কত আরামে আদরে বড় হয়ে উঠেছেন। এরপর না হয় শিবঠাকুরকে ভালোবেসে সব কষ্ট স্বীকার করে নিয়েছেন হাসিমুখে। তাই মা মুখে না বললেও মায়ের যে ভেতরে ভেতরে কষ্ট হচ্ছে , তা বুঝতে অন্তত নন্দীশ্বরের অসুবিধে হয় না। আরে বাবা শিবের ভক্ত হলেই বা। শিব-পার্বতী কি আলাদা নাকি !

তা কৈলাসের চিত্রটা কেমন ? ঝির ঝির করে তুষারপাত হচ্ছে। এদিকে কার্তিক -গণেশ বসে নিজেদের মধ্যে কি জানি বলছে। আর থেকে থেকে মা-বাবার দিকে তাকাচ্ছে। এদিকে দেবসেনা-সিদ্ধি-বুদ্ধি বসে বাটনা বাটছে, কুটনো কুটছে। কিন্তু তাদের নজরও শাশুড়ির দিকে। সকাল থেকেই মায়ের মিষ্টি মুখখানা বেজায় গম্ভীর। এমনকি সাতসকালে শিবঠাকুর গাঁজার কলকে হাতে নিয়েছেন। সেদিকেও মায়ের নজর নেই। বৌমারা ভয়ে ভয়ে নিজেদের ইচ্ছেমত রান্না চাপিয়েছে। সেদিকে অবশ্য বিশেষ চিন্তা নেই। ঘরকন্না নিয়ে দূর্গা মা কোনদিনই তাঁদের কিছু বলেন না।
এমনিতে তাঁদের শ্বশুর -শাশুড়িকে নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে হয় না। শাশুড়ি মা যে জগজ্জননী। আর শ্বশুর মশাই আশুতোষ ভোলানাথ। কিন্তু আজকে বিষয়টা একটু অন্যরকম ঠেকছে। এমনিতে শাশুড়ি ভীষণ ভালো। কিন্তু রেগে গেলে একেবারে প্রলয়ংকরী। আর বাবা মানে শ্বশুর মশাই-ও হয়েছেন তেমন। একটু জিজ্ঞাসা করলেই তো হয়। কিন্তু যা উদাসীন ভাবে বসে রয়েছেন, তাতে মনে তো হয় না মা দুর্গার রাগত ভাব তাঁর চোখে পড়ছে। বৌরা মনে মনে প্রমাদ গোনে। বরদের ইশারা করে , দেখো দেখি মায়ের কি হলো। কার্তিক মায়ের কাছে গিয়ে ঘুরঘুর করতেই এক ধমক, ‘বৌমার কথায় ব্যস্ত না হয়ে নিজের কাজে মন দাও দেখি। ‘

গণেশ সাহসে ভর করে মিনিট দশেক বাদে এগোতেই মায়ের দৃঢ় গলা, ‘ তোদের দু ভাইয়ের পাকামিটা আমি শুধু দেখছি। বিয়ে করে মনে হচ্ছে সাপের পাঁচ পা দেখেছিস দু ভায়ে।’ আর সেই সঙ্গে বৌমাদের উদ্দেশ্যে , ‘ দেখো মায়েরা তোমাদের শাশুড়ির জন্য উদ্বেগ দেখে ভালো লাগছে । কিন্তু সব তোমাদের হাতে নেই।’ বৌরা আশ্বস্ত হলো। যাক বাবা ! মা মৃদু ধমক দিলেও কথা তো বলেছেন।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। মা দুর্গা দুপুরেও কিছু খাননি। উল্টে বৌদের বলেছেন , দেখো আমার না খাওয়া নিয়ে আবার বৈকুন্ঠে তোমাদের বড় ননদকে ফোন করতে যেও না। এই এক ঢং হয়েছে সেলফোন হয়ে। এদিকে দেবসেনা ভাবছে বড় ননদ তো বটেই সে তো ব্রহ্ম লোকে ছোটো ননদকেও ফোন করে সব বলেছে। আর সিদ্ধি ভাবছে সেও তো মাসিমনি-কে গঙ্গোত্রী-তে কল করে সব বলেছে। যদিও গঙ্গোত্রী-তে লাইন ভালো পাওয়া যায় না।
বুদ্ধি কিন্তু চুপচাপ। সন্ধ্যে হতে সে আর কোনো অপেক্ষা না করে সোজা চলে গেল শিবঠাকুরের কাছে। ‘ বাবা তুমি একটু মায়ের সঙ্গে কথা তো বলতে পার. মা সকাল থেকে কিছু মুখে দেননি। জানা তো যায় অন্তত কি হয়েছে। সত্যি, তোমার যেন কোনদিকে খেয়াল নেই বাবা। দিন দিন তুমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছ।’
বৌমার ধমকেও শিব ঠাকুর নড়েন না. উল্টে হাতছানি দিয়ে বৌমাকে কাছে ডেকে কানে কানে কিছু বলেন। ধীরে ধীরে বুদ্ধির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের কাজে যেতে যেতে মনে মনে বলে,’ বাবা পারেও বটে। ‘
উমা এদিকে চুপ করে বসে কৈলাসের এক দিকে। মনে মনে ভাবছেন, শিব আসলে আমাকে আর একটুও ভালবাসেন না। না হয় গাঁজা খাওয়া নিয়ে একটু খিটখিট করি। তা বলে কি বউ-এর পছন্দ অপছন্দের দিকে একটু চোখ রাখতে নেই? দূর দূর সোজা চলে যাব হিমালয়ে। থাকুক একা একা। কিছুদিন সতীর মত দুরে না থাকলে আমার কথা মনে পড়বে না। সাত পাঁচ ভাবেন মা আর নিজের মনে হা হুতাশ করেন ।

আসলে হয়েছেটা কি , সেদিন বড় মেয়ে-জামাই এসেছিল বৈকুন্ঠ থেকে। মেয়ের গায়ে একটা অপূর্ব কাজ করা জামার মত দেখে মা শুধিয়েছিলেন, ‘এটা কি পরেছিস লক্ষ্মী ?’ মেয়ে জানিয়েছিল জামাই এটা তাঁকে মর্ত থেকে কিনে দিয়েছে নিজে হাতে। এটাকে বলে ফিরহন। খুব ভালো লেগেছিল মায়ের। শিব-ও সেখানে ছিলেন। মেয়েকে পরে যে খুব ভালো লাগছে সেকথাও বার বার বললেন তিনি। অথচ একবারও মনে পড়ল না বেচারী উমার কথা।
হঠাত চমকে ওঠেন উমা। কে যেন এসে বসেছেন পাশে। না তাকিয়েও অনুমান করতে পারেন উমা স্বামীর উপস্থিতি। তারপরেই শিবের গলা,’ কি গো গিন্নি সকাল থেকে অমন মন উদাস কেন? আর এদিকে যে মর্তে তোমার মনখারাপের প্রভাব পড়তে শুরু করে দিয়েছে।’ চমকে ওঠেন দুর্গা। আর তো চুপ করে বসে থাকা চলে না। তিনি যে মা। এবারে মর্তের দিকে একটু দৃষ্টি দিতেই হয়। উঠতে যেতেই আঁচলে টান পড়ে উমার।’যাচ্ছ কোথায়?’ উত্তর না দিয়েই উঠতে যাচ্ছিলেন মা। কিন্তু আর ওঠা হয় না তাঁর। ততক্ষণে শিব স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন একটা কিছু। এদিকে পরমপুরুষ আর পরমাপ্রকৃতির উপস্থিতিতে তো কৈলাস রাত্রির অন্ধকারেও আলোয় ভরা। মা অবাক হয়ে দেখেন তাঁর হাতে একটা লাল টুকটুকে ফিরহন।
অবাক উমার মুখে কোনো কথা ফোটে না আর। বিস্ময়ে স্বামীর দিকে তাকান তিনি। মনে হাজার প্রশ্ন।না বললে কি আদ্যাপুরুষ বুঝবেন না আদ্যাশক্তির মনের কথা!উমার চোখে চোখ পড়তেই ফিক করে হেসে ফেলেন শিব।”কি খুব অবাক করে দিলাম তো? সেদিন বড় মেয়ের ফিরহনটা দেখা ইস্তক ভাবছি তোমাকে এমন একটা কিনে দেব। তা তুমি তো সকাল থেকে গাল ফুলিয়ে বসে আছ। সতীজন্ম ত্যাগ করলেও সতীর অভিমান যাবে কোথায়! তুমি এখনো ঠিক সেইরকমই রয়ে গেলে গো।” বলে চলেন শিব, ”তুমি ভাবছ কি করে জানলাম, তোমার মনের কথা? ফিরহনটা তোমার কতটা ভালো লেগেছে তা কি আমি বুঝিনি ভেবেছ ! তুমি-আমি কি আলাদা? অর্ধনারীশ্বর রূপের কথা কি ভুলে গেলে? নাও চল ওঠ দেখি।”
শিবের হাত ধরলেন উমা। শিবের মুখেও মৃদু হাসি। উঠলেন তাঁর উমার হাত ধরে।
পৌষের কৈলাসের হিমেল হাওয়ায় উমার নূপুরের রিম ঝিম ধ্বনি। তাও যেন না বলেও বলে দিচ্ছে ‘শুধু তুমি প্রেমিক থেক। ‘ ‘শুধু তুমি প্রেমিক থেক। ‘

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight + twenty =