পাথুরে চিকিৎসা

পাথুরে চিকিৎসা

ডাঃ তাপস সরকার

আমাদের দেশে তথা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, ন্যাচারোপ্যাথি, ফিজিওথেরাপি, ম্যাগনেটোথেরাপি ইত্যাদি নানাবিধ মানব চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্টোনপ্যাথি(আমার ভাষায়) বা জেমথেরাপির জনপ্রিয়তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললে ভাগ্যগণনা এবং ভাগ্য পরিবর্তনের গাদাগাদা বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আমাদের মত বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যা জর্জরিত দেশের অদৃষ্টবাদী অসহায় মানুষজন দলে দলে ভাগ্য বিশারদের কাছে হাজির হচ্ছেন সৌভাগ্যলাভের আশায়। এইসব বিশেষজ্ঞরা শুধুমাত্র মানুষের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যবিধানই দেন না, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক, পারিবারিক, দাম্পত্য, বন্ধ্যাত্ব, শিক্ষা, চাকরী ইত্যাদি সব বিষয়ের সমস্যারই সমাধান করতে পারেন বলে দাবি করেন। চিকিৎসার এই পদ্ধতিতে সহায়ক হিসাবে তাদের দরকার হয় ঠিকুজি, কুষ্ঠি, হস্তরেখা, রাশিফল ইত্যাদি। ওষুধ হিসাবে প্রয়োগ করেন বিভিন্ন বর্ণ ও আকৃতির নানা ধরনের রত্ন বা পাথর, যেগুলির বেশির ভাগই ধারন করতে হয় আঙুলের আংটি বা তাবিজে-কবচে। কর্মসংস্থানের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে পেশা হিসেবে চিকিৎসার এই বিশেষ পদ্ধতিটি বেশ কিছু মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যথেষ্ট সফল হলেও পরিষেবার ক্ষেত্রে বা মানুষের সমস্যা সমাধানে কতটা ফলপ্রসূ তা নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। ডটকম-এর এই যুগে সাইবার শাসিত পৃথিবীতে মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপে যখন বিজ্ঞানের জড়িয়ে থাকা, তখন রত্ন চিকিৎসার এই ব্যাপারটি একেবারেই বিজ্ঞানের ধারে কাছ দিয়ে যায় না, বরং কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিছু মানুষের অন্ধবিশ্বাস এবং অজ্ঞতাকে পুঁজি করে একশ্রেণীর মানুষের অর্থ উপার্জনের একটি মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়। জেমথেরাপি বা রত্নচিকিৎসার অসারত্ব সহজেই বোঝা যায় ‘রত্নবিজ্ঞান’ সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধ্যান ধারণা থাকলে।

রত্ন বিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা যেখানে বিভিন্ন রত্নের গঠন, আকৃতি, প্রকৃতি ধর্মের উপর বিভিন্ন যুক্তি নির্ভর পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণা করা হয়। আক্ষরিক অর্থে রত্নের সঙ্গে পাথরের বর্ণ বা ধর্মের কিছুটা পার্থক্য থাকলেও মূল উপাদানের কোন পার্থক্য থাকে না। কারণ দুটোই কোন না কোন খনিজ বা জৈব পদার্থ দিয়ে তৈরি। বিশেষ বিশেষ ধরনের কিছু পাথরকে পরিষ্কার করে অশুদ্ধি রেখে বা দূর করে, ফাটকতল(cleavage plane) অনুযায়ী বিভাজিত করে সুনিপুণ ভাবে কেটে ছেঁটে বহুতল বিশিষ্ট আকৃতি দান করে রত্ন প্রস্তুত করা হয়। ফলে পাথর যখন রত্ন হয় তখন নানা আকৃতির এবং বর্ণময় হয়ে ওঠে। রত্নের বর্ণ তার ভিতরকার অশুদ্ধির জন্য। এই অশুদ্ধির বৈচিত্রের জন্যই চুণীর রঙ লাল, পান্না সবুজ, নীলা নীল বা পোখরাজ হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে। আবার অশুদ্ধি একেবারেই না থাকার জন্য হীরা ও জারকন বর্ণহীন। বৈদূর্যমণি বা ক্যাটস আই নামক রত্নের ভিতরে বিশেষ ধরণের অশুদ্ধির জন্য এই পাথরটিকে আড়াআড়ি ভাবে নাড়ালে এটি বেড়ালের চোখের মত জ্বলজ্বল করে। ‘ক্রাইসোবেরিন’-কে বিভিন্ন দিক থেকে দেখলে লাল, হলুদ, কমলা ইত্যাদি রঙের বলে মনে হয়।‘অগ্নিউপল’ পাথরের ভিতরকার সূক্ষস্তর বিন্যাসের জন্য মনে হয় আগুন লকলক করছে। আবার ‘টুসবোমালিন’-এর বিশেষ কেলাস গঠন তাকে তাপ ও চাপের প্রভাবে দুই মেরুতে বিপরীত বিদ্যুৎ আধানযুক্ত হতে সাহায্য করে, ফলে বাতাসের ধূলিকণা দু-প্রান্তে ধরে রাখে।

রত্ন পাথরের এই চমকপ্রদ ধরম ও বর্ণ বৈচিত্র যুগ যুগ ধরে মানুষকে আকৃষ্ট করেছে আর এই দুর্বলতাকে পরিপূর্ণ ভাবে কাজে লাগিয়েছে রত্ন জ্যোতিষের দল। তারা মানুষের দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিপত্তি, উন্নতি-অবনতির জন্য দায়ী করেছে বিভিন্ন গ্রহকে। সেই গ্রহদের তুষ্ট করতে পরামর্শ দিয়েছে বিভিন্ন রত্ন পাথর ধারণের। তাদের দাবী প্রত্যেক বস্তু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হারে ইলেকট্রন বিকিরণ করে এবং গ্রহদের চারপাশে তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র বিদ্যামান, ফলে গ্রহ-নক্ষত্রগুলি থেকে নির্গত বিকিরণ উক্ত পাথরের উপর পড়ে মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু পদার্থবিদ্যার আধুনিকতম যন্ত্রপাতির সাহায্যে এখনও পর্যন্ত গ্রহ নক্ষত্র থেকে ইলেকট্রন নির্গমনের কোন সঠিক সন্ধান পাওয়া যায় নি বা সামান্য পাওয়া গেলেও তা পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়নি। এই প্রসঙ্গে জ্যোতির্বিদ ডিন্সমার অল্টার, ক্ল্যারেন্স ক্লোমিনিশ ও জন ফিলিপস্‌ লিখেছেন – “গ্রহ-নক্ষত্র থেকে যে পরিমাণ বিকিরণ পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় তা অত্যন্ত ক্ষীণ, এদের মহাকর্ষ জনিত প্রভাব এতই কম যে কাছাকাছি বহু বস্তুর তুলনায় সে পরিমাণ নেহাতই নগন্য”। প্রকৃত পক্ষে রত্ন পাথরগুলি যে বিভিন্ন রাসায়নিক খনিজ বা জৈব পদার্থ ছাড়া আর কিছুই নয় তা সঙ্গের তালিকাটি এবং তাদের বৈজ্ঞানিক পরিচয় দেখলে পরিস্কার বোঝা যায়। তাই অনেক জ্যোতিষী আবার এ কথাও প্রচার করেন যে মানুষের শরীরের সংস্পর্শে থাকার ফলে এই সব রত্ন পাথরগুলি রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিরূপ গ্রহের প্রতিকার করে। কিন্তু এও অত্যন্ত হাস্যকর যুক্তি, কারণ রত্ন পাথরগুলি কি ধরণের রাসায়নিক বিক্রিয়া করে বা তার সঙ্গে আকাশের গ্রহদের কি সম্পর্ক তা জ্যোতিষীরা বলতে পারেন না বা জানেন না। জ্যোতিষীরা বলেন যে বিভিন্ন রত্ন বিভিন্ন অশুভ গ্রহের অশুভ বা ক্ষতিকারক রশ্মি শোষণ করে। কিন্তু এই ব্যাখ্যাও সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। যেমন, জ্যোতিষীরা বলেন লাল রঙের প্রবাল, মঙ্গলের লাল রঙের অশুভ রশ্মি শোষণ করে নেয়, কিন্তু আদতে ব্যাপারটি ঠিক উল্টো কারণ লাল রঙের কোন বস্তু লাল ছাড়া অন্য সব রঙ শোষণ করে লাল রঙটিকেই ছাড়ে দেয়। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষতিকারক রশ্মি পৃথিবীর ওজন মণ্ডল পেরিয়ে সরাসরি পৃথিবীতে আসতেই পারে না।

কিছু জ্যোতিষী বলেন, বিভিন্ন রত্ন পাথরের মধ্য দিয়ে সূর্যরশ্মি প্রতিসৃত হয়ে শরীরে প্রবেশ করে গ্রহ শান্তির কাজ করে। সেক্ষেত্রে প্রবাল, মুক্তা, রাজপেট, সূর্যকান্ত মণি ইত্যাদি অস্বচ্ছ পাথর কোন কাজেই লাগবে না কারণ এদের মধ্য দিয়ে সূর্যরশ্মি প্রতিসৃত হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। এক শ্রেণীর রত্ন চিকিৎসকরা বলে থাকেন, রামধনুর সাতটি রঙ নাকি মানুষের দেহের সাতটি স্নায়ুচক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই সাতটি রঙের কোন একটি বা একাধিক রঙের ঘাটতিতে নানা রোগ দেখা দেয়, যেমন নীল রঙের অভাবে মৃগী, হলুদ রঙের অভাবে অর্শ ইত্যাদি। রঙের অভাব অনুযায়ী সেই রঙটিকে দেহে সরবরাহ করলেই রোগমুক্তি। যেমন মৃগী হলে নীলা বা অর্শ হলে পোখরাজ। আবার দেহে রত্ন ধারণের পরিবর্তে নির্দিষ্ট রঙের পাথরকে সুরাসারে ডুবিয়ে রাখলে ঐ সুরাসার প্রয়োজনীয় রঙ শোষণ করবে এবং তা সুগার অফ মিল্কের সঙ্গে বড়ি আকারে নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যবহারে আরোগ্যলাভ অবশ্যম্ভাবী। যদিও এই সব বক্তব্যের সমর্থনে জেম থেরাপিস্টরা কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আজও দাখিল করতে পারেননি। আজকাল আবার গ্রহের গ্রহের কু-প্রভাব কাটানোর জন্য অষ্ট ধাতুর আংটি ও মেটাল ট্যাবলেট গ্যারান্টি সহকারে এই সব জ্যোতিষীরা বিক্রী করছেন বহু অর্থের বিনিময়ে। অথচ তারা জানে না যে, প্রধানত তামা, টিন, রূপা ও পারদের আস্তরণ সহ তৈরি এই আংটি( এতে লোহা বা সোনা থাকেই না) বা ট্যাবলেট মানব দেহে কোন উপকার তো করেই না বরং কখনও কখনও বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কারণ ঐ প্রত্যেকটি ধাতুই খুবই কম পরিমাণে প্রয়োজনীয় এবং সেটা মৌল হিসাবে নয়, যৌগ হিসাবে শরীরে শোষিত হয়। প্রয়োজনাতিরিক্ত দস্তা, তামা, পারদ, সীসা ইত্যাদি মৌল রোগ নিরাময় বা স্বাস্থ্যোদ্ধার তো করেই না বরং তা থেকে সাধারণ চর্মরোগ এমনকি দুরারোগ্য ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

সুতরাং গ্রহ-রত্ন-আংটি-তাবিজ-কবচের এই রত্ন চিকিৎসায় আর যাই থাকুক মানুষের মঙ্গলকারী কোন কিছু নেই। আছে অগণিত মানুষের অশিক্ষা-কুশিক্ষা-অজ্ঞতা-অদৃষ্ট নির্ভরতা। আর আছে এক শ্রেণীর ক্ষমতাশালী মানুষ এবং শাসকের শোষণের হাতিয়ার। তাই দেখা যায় বিগত দিনে যে যখন দেশের ক্ষমতার মসনদে বসেছেন কেউই এর বিরোধিতা করেননি উল্টে উদ্যোগী হয়েছেন জ্যোতিষ তথা অদৃষ্টবাদের প্রচার এবং প্রসারে। কারণ রাষ্ট্রশক্তি জানে মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, বেকারি, স্বাস্থ্যহীনতার কারণ হিসাবে যদি গ্রহ নক্ষত্রকে বা তাঁর ভাগ্যকে দায়ী করা যায়, তবে রাষ্ট্রের কোন দায় থাকে না। শোষণ বা শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকার পথ হয় মসৃণ ও দীর্ঘস্থায়ী। সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন দেখা যায় তথাকথিত শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় – ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের স্বনামধন্য ব্যাক্তিবর্গ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও গণ সংগঠনের কর্মী হাতের পাঁচ আঙুলে পাঁচটি রত্ন পরে প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেন। কার্যসিদ্ধির জন্য জ্যোতিষীর কাছ থেকে ঘুরে এসে বিতর্কের ঝড় তুলে নিজেদের আধুনিক ও বিজ্ঞান মনস্ক বলে প্রমান করার চেষ্টা করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four + eight =