আত্মবিশ্বাস

সুনীল দাশ

এই বদলে যাওয়াটা খুব চোখে পড়ে। সবুজ আর হলুদ খুব কাছাকাছি রঙ। কিন্তু বাউন্সগ্রিনে অ্যাসফল্টের পথের দুধারে সার দেওয়া গাছগুলো যখন দ্রুত বদলে সবুজ ভেঙে হলুদ হয়- তখন মনে হয় চারপাশটা পুরোপুরি অন্যরকম হয়ে গেল। আরও একটা কথা মনে হয়, বড় বেশি করে মনে হয়। মনে হয় আরও একটা বছর ঘুরে গেল। দেখতে দেখতে আরও বেশি একটা পাতা ঝরার কালের মধ্যে এসে পড়তে হল। ভাল লাগে না হলুদ পাতার খসে যাওয়ার শব্দ বুঝিবা অনবরত গড়াতে থাকে বুকের ভেতর দিয়ে।
এই নিয়ে ত্রিশটা, ত্রিশটা অক্টোবর তার কেটে গেল এই লন্ডনে। চুল কালো থেকে সাদা। বয়স আটাশ থেকে আটান্ন। পারিবারিক ধারা অনুসারে গত বছরে অর্থাৎ সাতান্ন বছর বয়সে তার মরে যাওয়ার কথা ছিল। বহরমপুরে এবং কলকাতায় গত পাঁচ এবং দুপুরুষের ইতিহাসে তাই আছে। এক বছর বেশি কম নয়। ঠিক সাতান্ন বছরে এসে মারা গেছে সবাই। শান্তিবিধানের বেলা অন্যরকম হয়ে গেল। এমনটা যে হবে তা শান্তিবিধান জানতেন। সব কিছুই আলাদা হয়েছে, এটাও হল। নিজের ওপর আস্থাটা তার বরাবরই বেশি। এই ভারি বয়সে সেটা আরও মজবুত হল। কোথাও তার বাঙালি মার্কা সংস্কার নেই যখন তখন এখানটাতেই বা থাক কেন? জন্ম মৃত্যুতে মানুষের হাত নেই – তবু শান্তিবিধান মৃত্যুর ওপরেও হাত চালিয়ে দিলেন। সাতান্ন বছরটাতেও পিঠ সোজা করে লন্ডনে আন্ডার গ্রাউন্ডে ঘোরা ফেরা করেছেন – একেবারে যুবকদের মত না হলেও অনেকটা তাদের মত।
কদিন রোদের সাড়া শব্দ নেই। সকালে থেকে ময়লা স্যাঁতস্যাঁতে দিনগুলো ঘাড় কুঁজো করে এগোতে এগোতে রাতের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে রোদ। মাঝে মধ্যে হাওয়া টানছে জোরে। জার্মান বাড়িওয়ালী বুড়ি এর মধ্যেই বেরলো কোথাও। বুড়ির বয়স শান্তিবিধানের চেয়ে বেশি বই কম নয়। এ বয়সে স্মার্ট থাকাটা এখানে মোটেই চোখে পড়ার মত নয়। বুড়ি খাটে পর্যাপ্ত। তিনতলা বাড়িটাকে কেমন ঝকঝকে তকতকে রেখেছে। শান্তিবিধানের মত অন্য ভাইরা হতে পারেনি। তারা কেউ ইংলিশ মিডিয়মে পড়েনি। স্মার্ট হয়নি। বাঙালিপনাকে ঘেন্না করতে শেখেনি। তারা হেদিপেচি হয়ে বেঁচে ছিল।
শান্তিবিধান রায়কেও বেরতে হবে এবার। হিথরো এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় হয়ে এল। ন্যুইয়র্ক থেকে ভাইপো আসছে। বছরের পর বছর ধরে আসব আসব করে আজ সত্যি সত্যিই আসছে অনি।
অক্টোবরে বাউন্সগ্রিনকে বেশ লাগে। মিনিট চারেক হাঁটলে আন্ডার গ্রাউন্ড ষ্টেশন। শান্তিবিধান লংকোটের গলার বোতাম লাগালেন। লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে রেল টিকিটের। ব্রিটিশরা আর মুদ্রাস্ফীতি রুখতে পারছে না। এদের হয়ে গেছে।
আবহাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে হলেও তার মন চাঙ্গা। হাজার হলেও নিজের ফ্যামিলি বলে কথা। তার ওপর এতদিন পর, অনিকে দেখে চেনার উপায় নেই। অনি তাকে চিনতে পারবে তো। হন্সলো প্ল্যাটফর্মে নামতেই ট্রেন থেকে নামা এক তরুণী সহযাত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করল সুরেলা ইংরেজিতে – দয়া করে বলবেন এয়ারপোর্ট যাওয়ার বাস পাব কোনদিকে। ওই দেখ না – লেখা আছে বলে শান্তিবিধান একটা সাইন বোর্ডের দিকে আঙুল দেখিয়ে দেন, থামেন না। ওপরে ওঠার জন্য সিঁড়ির দিকে এগোতে থাকেন। মেয়েটি আসছে পেছনে। ব্রিটিশ নয়, ঢং দেখলেই বোঝা যায়।
‘আপনি কি এখানেই থাকেন – না বেড়াতে এসেছেন?’ মেয়েটি আবার কথা বলে। শান্তিবিধান বুঝতে পারেন মেয়েটির কথা বলা বাতিক আছে।
‘আমি এখানেই থাকি – বহুকাল আছি, তুমি বোধহয় বেড়াতে এসেছো?’ মেয়েটির দিকে না তাকিয়ে বলে যান শান্তিবিধান। মেয়েটি এবার রীতিমত শুরু করে দেয়। প্ল্যাটফর্মের সিঁড়ি বেয়ে ওভারব্রিজ দিয়ে বাইরে আসে দুজনে। বাসের কিউয়ে দাঁড়াতে হয়। তখনও বাস আসেনি। মেয়েটির কথা কিন্তু জারি রয়েছে। শান্তিবিধান শুনে যান চুপচাপ।
বাস এল। ড্রাইভারকে পয়সা দিয়ে টিকিট নিয়ে এগিয়ে এলেন একটা সিটে বসার জন্য। পাশের আসনটা ফাঁকা ছিল মেয়েটা বসতে পারে। সে বসল না। তার হাত দেখে একজন বলেছিলেন – ‘তোমার পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু যোগ আছে। তুমি কখনও গাড়ির বাঁদিকে বসবে না’, তারপর থেকে শান্তিবিধান সুযোগ পেলে বাঁদিকেই বসেন।
সিটটাতে বসল একটি অল্প বয়সী ছেলে, মেয়েটা বসল তার পাশে। শান্তিবিধান একটু ক্ষুণ্ণ হলেন। সমবয়সী ছেলে পেলে আর কিছু তাকিয়ে দেখে না এরা। একে বৃদ্ধ তার ওপর ভারতীয়? তা ভারতীয় তো তোর এত ঘেন্না কেন? তুই তো শালী ইংরেজ না। তাহলে? মেয়েটির দিকে আর দ্বিতীয়বার ফিরে তাকালেন না।
অনির চেহারাটা চিনতে আর যার দেরি হোক না কেন – শান্তিবিধানের হবে না। কেননা ওর তো তার নিজের যুবক বয়সের চেহারাটাই হুবহু বসানো। অনির ফটোর চেহারাটা মনে মনে ভাবতে ভাবতে হিথরো এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে এসে দাঁড়ালেন।
তিনি আশা করেছিলেন অনিকে গত বছরেই। গত বছর তো তার সাতান্ন গেছে। পারিবারিক সংস্কার অনুযায়ী গত বছরেই তার মরা উচিত ছিল ভেবেছিলেন – অন্তত সম্পত্তি টম্পত্তি যা করেছেন – এই গত ত্রিশ বছরে তার উত্তরাধিকার নিতে অনি একবারটি আসবে, আসেনি। চটে গেছিলেন শান্তিবিধান। দুদিন পরে মরে যাব জেনেও ছোঁড়াটা এলনা একবারটি। ক্ষেপে গিয়ে তিনি ঠিক করলেন – সমস্ত সম্পত্তি তিনি রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করে দিয়ে যাবেন। কিন্তু অনির চিঠিপত্রগুলি এতই মুগ্ধ করতে লাগল তাকে তিনি তা আর করলেন না। বুঝলেন অনি ব্যাপারটা জানেই না। এই সাতান্ন বছরের ব্যাপারটা। ভাবলেন লিখে জানাব। পরে মত বদলালেন। সংস্কার অনুযায়ী এ বছর আমার মরে যাওয়ার কথা – এ কথাটা আর লিখতে পারলেন না। তাছাড়া অনি তো লিখেইছে সামনের অক্টোবর আসবে।
এখন সেই সামনের অক্টোবর।
অনি ঠিক এল।
আপন লোক। এয়ারপোর্টের চেকিং মিটিয়ে বাইরে এসে ট্যাক্সি নিলেন দুজনে।
‘তোমার কাকু এতদিনে একটা গাড়ি কেনা উচিত ছিল।’ অনি যেন একটু সহানুভুতির স্বরে বলল।
‘আমার তো অফিস আর বাড়ি ছাড়া কিচ্ছুটি নেই। তাই আর ঝামেলা বাড়াইনি। তাছাড়া ড্রাইভিংটা শিখি শিখি করে ছোট বয়স থেকে আর শেখাই হয়ে উঠল না’
‘এ তুমি ঠিক করনি। আগে তো তোমার নিজের স্বাচ্ছন্দ্য’। অনির কথাগুলো শুনতে খুব ভাল লাগছিল শান্তিবিধানের। একেই বলে আপন মানুষ, রক্তের টান। আসলে ছেলেটা সত্যিই তাকে ভালবাসে, শুধুমাত্র সম্পত্তির টানে আসেনি। যদি আসতো – তা হলে তো আগের বছরেই আসতে পারতো।
লন্ডনের রাস্তাঘাট বৃষ্টিতে ভিজছে। রেইনকোট, হ্যাট পরে হেঁটে যাচ্ছে দু’একজন। গাড়ির স্পিড কমানো।
‘আর স্বাচ্ছন্দ্য’ অনির কথার উত্তরে শান্তিবিধান বললেন, ‘সাতান্ন পেরিয়ে আটান্নয় এলাম আর স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে কি হবে?’
‘এখনই তো স্বাচ্ছন্দ্য দরকার। কিন্তু তুমি সাতান্ন পেরিয়ে আটান্নয় পড়েছো – তোমায় কে বলল? এখনো সাতান্ন চলছে।’
শান্তিবিধান আঁতকে উঠলেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজের মধ্যে যুক্তি পেয়ে শান্ত হয়ে বললেন – ‘আমার নিজের বয়স আমি নিজে জানি না! আমি সংস্কারে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু সাতান্ন বছর বয়সটা সম্পর্কে সত্যিই খুব হুঁশিয়ার ছিলাম। শুধু আত্মবিশ্বাসের জোরে পার করে দিয়ে এলাম – বুঝেছো?’
‘কি করে জানলে তোমার বয়স সাতান্ন নয় – আটান্ন?’
‘বরাবর জেনে আসছি – আমার ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেট আছে।’
‘সার্টিফিকেটে তোমার এক বছর বয়স বাড়ানো আছে।’
‘অ্যা ?’
‘হ্যা, মা লিখেছে আমাকে।’
‘তোমার মা জানলেন কি করে?’
‘ঠাকুমা বলেছিলেন মাকে – মার স্পষ্ট মনে আছে। অনেক আগে একবার তোমা বিয়ের কথা উঠেছিল – তখন।’
‘ধ্যাৎ’ – এবার প্রতিবাদটা আগের মত জোরদার নয়। ‘কিন্তু সার্টিফিকেটে কেউ বয়স বাড়িয়ে লেখে না, বরং কমিয়ে লেখে।’
‘কেন বেড়ে গেছিল তাও ঠাকুমা বলে গেছিল। তোমার স্কুলের ক্লার্করাই কি রকম করে যেন বয়সের হিসেবটা সহজ করার জন্য ওই রকম করেছিলেন।’
বৃষ্টি ধরে গেছে। শীত আরও কামড়ে ধরল। শান্তিবিধান ট্যাক্সির বাঁদিকে বসেছিলেন। অনিকে বললেন – ‘এস তো জায়গাটা পাল্টাপাল্টি করে নিই।’

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen − seventeen =