অপ্রকাশিত

অর্পণ কুমার মাজি (শালিহান, বাঁকুড়া)

-অনুপমের গানের মতো হয়ে যাচ্ছে ভাই জীবনটা! কিছু বুঝতেই পারছিনা কী হচ্ছে! ক্যারিয়ারটা পুরো লারালাপ্পা হয়ে গেলো মাইরি।
-শোন ভাই! রাজনীতি করি চল। চাকরী বাকরী হবেনা আমাদের। বাবা আর ফর্ম ফিলাপের টাকাও দেবেনা বলেছে।
-রাজনীতি তো আমাদের হবেনা বন্ধু। আমরা যে শিক্ষিত।
-তাও তো বটে! আমার আবার পরীক্ষায় টুকলি করতেও হাত কাঁপে। নেতা মন্ত্রী হবো কী করে!
-ওরে শালা! সেই দিলি তো! ওরা শুনলে জেলে পুরে দেবে ভাই, আস্তে বল।
-জেল থেকেই তো রাজনীতির শুরু মামু।
-ফর্মে আছিস দেখছি আজ! কি ব্যাপার?
-ব্রেকআপ হয়ে গেছে দিশার সাথে। যাই বল চাপটা কমলো বুঝলি। চাকরী বাকরী নেই একেই, একদিন না একদিন তো কোনো সরকারি চাকরী করা মাল এসে আমার সস্তা পাছায় বুটের লাথি মেরে দিশাকে নিয়ে ফুর হয়ে যেতোই।
-কষ্টটা চেপে আছিস জানি। আর কেও না চিনলেও আমি তোকে ভালো করে চিনি। তুই শুধরোবি না জীবনে।
-আগে জীবনটা তো শুধরে যাক বন্ধু। ভাই একটা বিড়ি হবে?
-একটাই আছে, আমি একটা সিগারেট পাই কিন্তু তোর কাছে।
-দিয়ে দেবো নে। আজ রাত্রেই বাবার পকেট থেকে ঝেড়ে দেবো।
-নে ধরা।
-ঘর যাবিনা?
-যাবো একটু বস না, সন্ধ্যাটা হোক।
-টিউশনটা পড়াতে যাচ্ছিস আর।
-না না, ভালো লাগেনা টিউশন করতে। বড্ড বকবক করতে হয়।
-ভালো না লাগলেও কিছু করতে হবে তো।
-জ্ঞান দিসনা বে, মানায় না তোর মুখে। চল উঠি আজ।
-চল টাটা।
*********
-কি মনা দা! ভালো তো ?
-হ্যাঁ রে ভাই। শোন একটা কাজ আছে। ডাটা এন্ট্রির, স্টুডেন্ট ইনফরমেশন। পার স্টুডেন্ট আশি পয়সা। করবি?
-করবো। কতগুলো আছে ?
-পাঁচ ছশো হবে। কাল আমার বাড়ি এসে নিয়ে যাবি তাহলে কাগজগুলো। চা খাবি কী ?
-বলো। দুটো বিস্কুটও বলবে।
-এভাবে কদিন চলবে রে শানু। কিছু কর এবার। এতদূর পড়াশুনো করে যদি বসে থাকতে হয়!
-চেষ্টা করিনি বলছো? হাজার কুড়ি টাকার পরীক্ষাই দিলাম। রিটিনে পাশ হয়। ব্যাস এর বেশি হয়না কিছু।
(চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়েই)
-চললাম গো। কাল বিকেলে যাচ্ছি তোমার কাছে কাগজগুলো নিতে।
***********
-এসছেন মহারাজ? আড্ডা মেরে চাকরী হয় বলে জানা নেই। একটু বইগুলো নিয়ে বসতে হয় তো নাকি। টিউশন টাও তো ছেড়ে দিলি।
-উফ্ আবার শুরু করলে তো মা।
-তোর থেকে গবেট সোমনাথটা চাকরী করছে, আর তুই!
-ওর বাপ্ জেলা সভাপতি, আর আমার বাপ্ মশলাপাতি, ওর সাথে তুলনা করোনা।
-নিজের বাপকে কেও এরকম বলে? ওই মশলাপাতির দোকানটার জন্যেই সংসারটা চলছে।
-থামো এবার। খেলা দেখবো আমি, খেতে দাও দুটি।
-কেন? ছাইপাশে পেট ভরেনি ?
-কে! কি ? কি যে বলছো?
-শোন বাবা, বিড়ির গন্ধ লুকোনোর নয়। আর ভুলে যাসনা আমি তোর মা।
********
-কিরে মনাদা বলছিল ডাটা এন্ট্রির কাজ করছিস নাকি?
-হুম রে। কালই বললো।
-আমাকে বিয়ার খাওয়াতে হবে কিন্তু টাকা পেলেই।
-নিশ্চয় বস্। তুমি ছাড়া কে আছে আমার। কথা হল দিশার সাথে আর?
-না আর কথা হয়নি। ছাড় না।
নে সিগারেট খা।
-উফফ্! কাকুর পকেট জিন্দাবাদ!
-একদম। বুঝলি মিলুর বিয়ের কথা হচ্ছিল কাল। কিন্তু আশি হাজার টাকা নগদ লাগবে বলছে ছেলের ঘর থেকে।
-মিলির বিয়ে? মিলিকে অনেক দিন দেখিনি। এতো বড় হয়ে গেলো তোর বোন?
-বিয়ের বয়স হয়তো হয়নি, তবু যা হয় আর কী আমাদের মত পরিবারে। না আছে বেশিদূর পড়ানোর ক্ষমতা, না আছে….
-ভাবিস না এত। সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল তোর বাড়ি যাব। অনেক দিন যাইনি। চিকেন রেডি রাখতে বলিস কাকিমাকে।
********
-না শানু দা, আমি একটা কোচিং নেবো ভাবছিলাম। কিন্তু জানোই তো বাড়ির অবস্থা। বাবা বিয়ের জন্য জমানো টাকা দিয়ে কিছুতেই পড়াবেনা আমাকে। ছেলের বাবা যদিও বলছে বিয়ের পর পড়াবে।
-ধুর, বোকা। ওরকম বলে ছেলের বাপেরা। ওরাও রাজনৈতিক নেতাদের থেকে কোনো অংশে কম হয়না। অনেক কথা টথা দিয়ে থাকে। ওসবে ভুলিস না।
-তাহলে কী করবো। আমার আরো পড়ে চাকরী করার ইচ্ছে খুব।
-তোর দুটো দাদা আছে মনে রাখিস। তারা ঠিক ব্যবস্থা করবে। তুই চিন্তা করিস না।
********
-বাবা রাজি হবেনা শানু।
-রে চল না। আমি বলবো তুই শুধু সাথে থাকিস।
-চল, তবে লাভ কিছু হবেনা।
-কাকু, আমি আর সঞ্জু ভাবছিলাম একটা ব্যবসা শুরু করবো। তো ষাট হাজার মতো দরকার শুরুতে, বাবা তিরিশ দিচ্ছে। আপনি যদি তিরিশ….
-দ্যাখো বাবা, মিলুর বিয়ের কথা চলছে শুনেছ নিশ্চয়। কোনোরকম টাকা জোগাড় করেছি কিছু। আবার যদি ব্যবসায়….
-মিলু চাকরি করতে চায়, কোচিং নিতে চায়। ওকে একটা বছর দিন না। তারপর না হয় দেবেন বিয়ে। বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে না ওর। আর টাকাটা ভাববেন না। আমি আর সঞ্জু আছি তো।
-তোমার ওপর আমার অনেক বিশ্বাস বাবা। তুমি বলছো যখন আমি রাজী কিন্তু….মিলুর কোচিং এ ভর্তির টাকা তো আমি দিতে পারব না…কোনোরকম তিরিশ….
-ও আপনি ভাববেন না। মিলুকে আমি দেখিয়ে দেবো চাকরীর জন্য কী কী পড়তে হবে। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি যাবে ও।
-তাহলে তো ভালোই হয়। সঞ্জুটাকে একটু বোধবুদ্ধি দিও বাবা। বাপের পকেট থেকে সিগারেট মেরে কী জীবনটা কাটিয়ে দেবে?
********
-শালা তোর বাপ্ তো ব্যোমকেশ রে, তুই যে কাকুর সিগারেট ঝাড়িস সেটা কাকু দিব্বি জানে।
-তুই বাবাকে কি করে মানালি সেটাই ভাবছি। বাই দা ওয়ে কী প্ল্যান সেটা তো বল ।
-কী আর! টাকাটা নিয়ে মিলির আ্যডমিশনটা করিয়ে দে কোচিংএ। আমার বাড়ি আসার নামে কোচিং যাবে।
-আর ব্যবসা করবি বললি যে? বাবা জানতে চাইলে কী বলব?
-ও ম্যানেজ হয়ে যাবে।
-ব্যবসার কথা না বলে তো সরাসরি মিলুর জন্য টাকাটা চাইলে এতো মিথ্যে নাটক করতে হতো না।
-কিছু বুঝিসনা তুই। ব্যাবসার কথা বলতে কাকু তোর দিকটাও একটু নিশ্চিন্ত হলেন। মিলির কোচিং এর জন্য ডাইরেক্ট টাকা চাইলে হয়তো রাজী নাও হতে পারতেন। মোটকথা যা হোক বলে একটা বছর কাটাতে হবে। দু একটা ব্যাচ করবো ভাবছি পরের মাস থেকে। কাকুর টাকাটা ফিরিয়ে দিতে হবে তো। তবে শর্ত আছে একটা।
-কি?
-তুই কি বে! তুইও তো টিউশন করতে পারিস। তুইও টিউশন কর, এটাই শর্ত। দুজন মিলে করলে টাকাটা জলদি ফিরিয়ে দেওয়া যাবে কাকুকে।
-তুই পারছিস আর আমি পারবো না নিজের বোনটার জন্য এটুকু? ভাই, তোর মত বন্ধু হয়না রে। আমি চিরঋণী…..তবে সন্দেহ যে হচ্ছেনা আমার তা নয়…
-কি সন্দেহ?
-লাইন মারার চেষ্টা করছিস নাতো আমার বোনের সাথে?
-শালা কুকুর! ফালতু বকবি এরকম?
-কি করবো ইমোশনাল হলে আমার সিস্টেমটা এরকম উল্টোপাল্টা হয়ে যায় অটোম্যাটিক। সরি সরি।
-ন্যাকামি ছাড়, সিগারেট খাইয়ে ঋণ শোধ করে দিস।
**********
এই একটা বছরে মিলির বাড়ি যাওয়া আসাটা বেড়ে গেছে শানুর। মিলিও কোচিং থেকে ফেরার পথে শানুর বাড়ি হয়ে আসে। শানুকে দেখার জন্য পড়া বুঝতে যাবার বাহানায় প্রায়ই শানুর বাড়ি যেত মিলি। তার মনে শানুর জন্য সেই বিশেষ জায়গাটা তৈরি হয়েছিল যে জায়গাটা বিশেষ একসময় বিশেষ একজন অনেকদিন ব্যবহার করে, আর সেই বিশেষ মানুষটি চলে যাবার পর গেস্ট হাউসের মতো পড়ে থাকে। অনেক অস্থায়ী মানুষজনের আসা যাওয়া লেগেই থাকে তখন সেখানে।
***********
-কাকিমা! ও কাকিমা!
-কে? ও তুই? আয় মিলি। ভালো আছিস মা?
-আমি চাকরী পেয়েছি কাকিমা।
-থাক আর প্রণাম করতে হবেনা।
-শানুদার জন্যেই সম্ভব হয়েছে এটা। শানুদাকে দেখছি না!
-ও এখুনি এসে যাবে। তুই বস্ ভেতরে একটু। আমি একটু ঝাঁটটা দিয়ে দিই।
-মা! ওষুধটা পাইনি। কাল এনে দেবে বলল।
-আচ্ছা। কাল আনিস মনে করে। মিলি এসেছে দ্যাখ ভেতরে বসে আছে।
-কিরে মিলি! ওই! ডায়ারিটা দে।
-তুমি ডায়ারিও লেখো শানু দা?
-তুই দিবি ডায়ারিটা? অন্যের ডায়রি পড়তে নেই জানিস না!
-নাও বাবা নাও। কিছু পড়ে নিইনি আমি। এই রাখলাম তোমার ডায়রি। মিষ্টি খাও। আমি চাকরী পেয়েছি। আর সবটা তোমার আর দাদার জন্যই।(বলেই হঠাৎ শানুকে জড়িয়ে ধরলো মিলি, যেটা একদম অপ্রত্যাশিত ছিল শানুর কাছে। কেমন যেন অচেনা, অন্যরকম লাগলো মিলিকে।)
মিলি চলে যাবার পর ডায়রিটা তুলে রাখতে গিয়ে শানু দেখল প্রায় এক বছর আগের 13th January পেজ টা একটু মোড়া। যেখানে লেখা ছিল-
“মিলিকে দেখে আমার মনে পড়ে গেলো আমার বোন শ্রুতিকে।ও বেঁচে থাকলে মিলির থেকে একটু বড়ই হতো এতদিন। বাবা মা বিয়ের জন্য জোর করায় রাগ করে একদিন নিজেকে শেষ করে দিয়েছিল শ্রুতি। পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল শ্রুতি। ওর ইচ্ছে ছিল চাকরী করবে বড় হয়ে। কিন্তু সেই একই সমস্যা। অভাবের সংসার,একটা ছোট্ট দোকান, অসহায় বাবা, বেকার দাদা, আর সর্বোপরি মেয়েদের জন্য বানানো অদ্ভূত সমাজের অদ্ভূত সব নিয়ম। এসব থেকে সেদিন বাঁচাতে পারিনি আমার বোনটাকে। আজ আরেকটা বোনেরও একই পরিস্থিতি। তবে আজ আমি সেটা করবো যেটা সেদিন করতে পারিনি। মিলির স্বপ্নটা পূরণ করতে পারলে হয়তো শ্রুতি আমাকে ক্ষমা করে দেবে। মিলির মধ্যে দিয়েই আমি শ্রুতিকে দেখবো।”
সেই পাতার নীচে এক ফোঁটা চোখের জল। সেটা একটা মিষ্টি বোনের কৃতজ্ঞতার, নাকি কোনো প্রেমিকার অপ্রকাশিত ভালোবাসার, সেটা কেবল মিলিই জানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × two =