মণ্ডা টানল মনটা

পলাশ মুখোপাধ্যায়

##

কোথাও যাওয়া মানেই যে খাওয়াটাও চাইই চাই সেটা এত দিনে আমাদের পাঠকরা তো নিশ্চয় বুঝে গিয়েছেন। এবারেও তাই আমরা এমন একটা জায়গায় যাব যেখানে খাওয়া তো থাকবেই পাশাপাশি থাকবে সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম, ইতিহাস এবং অবশ্যই অপরূপ প্রকৃতি। কি ভাবছেন? এমন মেলবন্ধন কোথায় মিলবে। মিলবে মিলবে, এই বাংলাতেই ছড়িয়ে আছে এমন নানা মণি মাণিক্য। তবে কলকাতা ছেড়ে একটু দূরে যেতে হবে। সে… এত কিছু ভালর জন্য এটুকু কষ্ট করতে আমার তো দ্বিধাই নেই। এত দিনে আমিও ভাল করেই জেনে গিয়েছি আপনারাও প্রস্তুত।
দূরে তো, একটু সকাল সকাল বেরনোই ভাল। ধর্মতলা থেকে বাস ধরলাম আমি, গন্তব্য লাভপুর এবং কীর্ণাহার। কলকাতা থেকে ৭ টা ২৫ এর বাসটি কীর্ণাহার হয়ে লাভপুর যায়, সেটাতে যাওয়াই ভাল। বীরভূমের এই দুই গঞ্জের নাম বাংলার মানুষ নানা ভাবে জানেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে তো কীর্ণাহারের নাম গোটা ভারত জেনে গিয়েছে। যাই হোক প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টার যাত্রাপথ। তবে বর্ধমান পেরনোর পর নানা নাম না জানা গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাওয়া আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে যেতে মন্দ লাগে না। রাস্তাও বেশ ভাল। সরাসরি ট্রেনে যাওয়ার ব্যবস্থা এখনও হয়ে ওঠে নি। আহমেদপুর থেকে কাটোয়া ছোট লাইন এখন বড় হচ্ছে। সেই কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেই লাইন তৈরি হলে অবশ্য কাটোয়া বা আহমেদপুর হয়ে ট্রেনেও লাভপুর বা কীর্ণাহারে আসা যাবে। তবে তা এখনও কিছুটা দেরী। তবে আহমেদপুর পর্যন্ত ট্রেনে এসে সেখান থেকে বাসেও আসা যায়।

এগারোটা নাগাদ বাস নামিয়ে দিল লাভপুরে। মূলত কীর্ণাহারে বাস আসে, একটি বাস লাভপুর অবধি আসে। নামতেই দেখি আমার এবারের সফর সঙ্গী তথা স্থানীয় সাংবাদিক পরিতোষ দাস দাঁড়িয়ে। দীর্ঘদিনের আলাপ, বহু বছর পরে দেখা স্বভাবতই দুজনেই কিছুটা নস্টালজিক। প্রাতরাশের পর পরিতোষই বলল প্রথমে হাঁসুলী বাঁকের দিকে যেতে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিধন্য এই লাভপুর। বাংলা সাহিত্যের এই স্মরণীয় লেখকের বাড়িও এখানেই। লাভপুরের পরতে পরতে জড়িয়ে তারাশঙ্করের স্মৃতি, তাঁর লেখার নানা অঙ্গ-উপাদান।
বিখ্যাত উপন্যাস হাঁসুলী বাঁকের উপকথা পড়েননি এমন মানুষ মেলা ভার। কিন্তু বাস্তবে হাঁসুলী বাঁক বলে যে একটি জায়গা আছে সেটা আমি জেনে ছিলাম বহু বছর আগে। দুর্গাপুরে থাকা কালীন ভূমী রাজস্ব দফতরের এক আধিকারিক তথা আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীর বাবা কাজি খায়রুল আনম সিদ্দিকী সাহেব প্রথম আমাকে এই জায়গার কথা জানান। সেই থেকে এখানে আসার একটা লোভ ছিলই। এতদিনে সেটা পূরণ হল বলে বেশ খুশি খুশিই ছিলাম। লাভপুরে এখন প্রচুর টোটো, একটা ভাড়া করে নিলে ঘুরতে সুবিধা হয়। সময় এবং অর্থ দুই বাঁচে। বড় রাস্তা ছেড়ে এবার টোটো পড়ল মোরামের পথে। লাল রাস্তার দুপাশে তালের সারি, বড় অপূর্ব সে পথ।

সেই পথ ধরে প্রায় চার কিলোমিটার গেলে পড়বে একট ইট ভাঁটা। টোটোর যাত্রা সে পর্যন্তই। বর্ষা হলে আরও আগে কাহার পাড়াতেই নেমে যেতে হবে কিন্তু। এবার হাঁটা। কিন্তু সে হাঁটা মালুম হয় না চারপাশের দৃশ্যাবলীর জন্য। ঘন সবুজ মাঠ, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বক্রেশ্বর নদী। তার তিরতিরে বয়ে চলার শব্দ আপনার পথা চলার সঙ্গী। নির্জন – নিরিবিলি জায়গাটিতে শব্দ বলতে শুধুই নদীর আওয়াজ, মাঝে মধ্যে তাতে যোগ্য সঙ্গত করে পাখির কুজন।

বক্রেশ্বর নদী বড় সুন্দর, তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই তো বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কোপাই। আরও খানিকটা এগিয়ে একটা ঢিবির উপর এসে বসলাম। এইখানটাতে সেই ‘দহ’। যেখানে চঞ্চলা কোপাই এসে বক্রেশ্বরে মিলেছে। সদ্য বর্ষায় পু্ষ্ট দুই নদীর স্রোত পরস্পরে মিশে এক ঘূর্ণীর সৃষ্টি করেছে। অথচ এত সহজে মিলন হয়নি কোপাই-বক্রেশ্বরের। পরস্পরের কাছে আসতে কমপক্ষে ১৮ বার হাঁসূলীর মতো বাঁক নিতে হয়েছে তাদের। হংসগ্রীবার মত সেই বাঁকের কারনেই এই গোটা এলাকার নাম হাঁসুলী বাঁক। যাত্রাপথে কখনও কাছে এসেছে, কখনও দূরে সরে গেছে। কাহার পাড়ার পাখি আর করালীরও তো এত সহজে মিলন হয়নি।

তারাশঙ্করের এ তল্লাটে ছিল নিয়মিত বিচরণ। তাঁর লেখনীতেই তা স্পষ্ট। বীরভূমের লাভপুর থেকে সাড়ে চার কিমি দূরের এই কোপাই-বক্রেশ্বরের মিলনভূমি হাঁসূলীবাঁকের উপকথা আজ ভিন্ন। বাঁশবাদি থেকে বাবাঠাকুরের বাহন আজ আর শিষ দিয়ে ডাকে না। সামান্য দূরের কাহারপাড়ার বনোয়ারীর উত্তরপুরুষ কয়েকঘর আছে বটে, তবে তাদের ঘরের ছেলেরা আজ কেউ আমেদাবাদ, কেউ মুম্বাইতে কাজ করে। তাদের অবশ্য বাহিরমুখো করেছে করালীই; কারণ সে-ই প্রথম কাহারপাড়ার প্রথা ভেঙে চন্ননপুর রেল ইয়ার্ডে কাজে গিয়েছিল। তবে হয়ত আজও কাহারপাড়ায় অমলিন আছে মেয়েদের মনের ‘অঙ’! আজও ওরা রঙকে অঙই বলে। আজও কাহার মেয়েদের মনে ‘অঙ’ ধরলে ওরা করালিদের জন্য অপেক্ষা করে দাওয়ায় বসে থাকে।

হাঁসুলী বাঁকের এ চত্বর ছেড়ে যেতে চাইছিল না মন। কিন্তু সময় যে কম, উঠতেই হল। এবার আমাদের গন্তব্য তারাশঙ্করের বাড়ি। স্টেশনের ওপাশে বিখ্যাত বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ি। বাড়িতে কেউ সেই সময় ছিলেন না। তবে দরজা খোলাই ছিল, ঢুকে গেলাম আমরা। বাড়ির একটা দিকে তারাশঙ্করের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী, চিঠিপত্র, বংশলতিকা, শংসাপত্র রাখা আছে। দেওয়ালে তাঁর নানা সাহিত্য থেকে নানা উদ্ধৃতি। এই ঘরেই জন্মেছিলেন তিনি। গোটা ঘর তাঁর স্মৃতির গন্ধ মাখা। কেমন যেন একটা বিষাদ ছড়িয়ে পড়ল মনে, লেখক চলে যান, রয়ে যায় তাঁর শব্দকীর্তি।

এই গলি দিয়েই একটু এগোলে ধাত্রীদেবতা। কাছারি বাড়ি তথা সংগ্রহশালা এবং গ্রন্থাগার। বর্তমানে বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী নামে একটি সংস্থা এই সংগ্রহশালা দেখভালের দায়িত্বে। এই চত্বরে এখন থাকার জন্যও একটি ছোট অতিথিশালা তৈরি হয়েছে। যারা রাত্রিবাস করতে চান এখানে থাকতে পারেন।

স্টেশন থেকে সওয়া ১ কিমি উত্তর-পূর্বে ফুল্লরা পীঠ। দেবীর অপর নাম অট্টহাস। গাছপালা পরিবেষ্টিত পীঠের পরিবেশ ছায়াময় এবং বেশ সাজানো গোছানো। কথিত আছে, এখানে সতীর নীচের ঠোঁট পড়েছিল। দেবী এখানে ফুল্লরা, আর ভৈরবের নাম বিশ্বেশ। বিশ্বেশ পীঠ চত্বরেই আলাদা একটি ছোট মন্দিরে অবস্থান করছেন। মূল মন্দিরে কোনও বিগ্রহ নেই। আছে একটি কচ্ছপাকৃতি শিলাখণ্ড জবা, বেলপাতা, রক্তবস্ত্র আর সিঁদুরে চর্চিত। ভালো করে দেখলে মনে হয়, পাথরের সামনের ভাগটা ঠোঁটের মতো। মন্দিরের সামনে দুটো শিবমন্দির, মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে বিরাট এক দিঘিতে। নাম দেবীদহ বা দলদলি। প্রবাদ আছে, দিঘির জল কোনও দিন শুকোয় না। মন্দির চত্বরটি বেশ, সাধারণ দিনে ভিড়ও কম। তবে মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে মেলা বসে এখানে, তখন ব্যাপক জনসমাগমও হয়।

লাভপুর থেকে এবার আমরা কীর্ণাহারের উদ্দেশে রওনা হলাম। দশ কিলোমিটার মত পথ। কীর্ণাহারে আমার যাওয়া দুটি কারনে, প্রথম কারনটা খাওয়া। দ্বিতীয়টা বাস ধরা। এখানে বিখ্যাত দাদুর মণ্ডা এবং বরফি একবার না খেলে জীবন বৃথা। দেড়শো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি এই বরফি খাব বলেই। তবে সমস্যা আছে, এই বরফির এত চাহিদা যে মেলা ভার। কারন সকালে তৈরি হতে না হতেই মণ্ডা এবং বরফি শেষ হয়ে যায়। এতটাই কাটতি যে এই মিষ্টির ছবি নেওয়ার জন্য পরিতোষকে চার দিন যেতে হয়েছে।

দোকানের একটা গাল ভরা নাম আছে বটে, সুষমা ভান্ডার। তবে ওই নামে কেউ চেনেন কিনা সন্দেহ। কীর্ণাহার বাসস্ট্যান্ডের কাছে পোস্ট অফিসের সামনে এই দোকান। আপাত দৃষ্টিতে এই দোকান দেখলে বোঝার উপায় নেই তার এত জনপ্রিয়তা আছে। রাস্তার ধারে আর পাঁচটা গঞ্জের মতই ছোট্ট একটা দোকান। কিন্তু সকালের দিকে গেলে মালুম হয় এই মণ্ডার নাম ডাক কতখানি। আমার জন্য অবশ্য পরিতোষ আগে থাকতে বলে রেখেছিল তাই বিকেলে গেলেও আমার বরফি পেতে অসুবিধে হয়নি।

কথা হচ্ছিল দোকানের বর্তমান মালিক দীনবন্ধু মণ্ডলের সঙ্গে। দোকানের বয়স নয় নয় করে পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে বছর তিনেক আগেই। দীনবন্ধু বাবুর বাবা মহাদেব চন্দ্র মণ্ডল এই দোকানের প্রতিষ্ঠাতা। মণ্ডা এখানে প্রায় সব দোকানেই পাওয়া যায় কিন্তু মহাদেব বাবুর হাতের জাদুতে এই সুষমা ভাণ্ডারের মণ্ডা – বরফির সুনাম অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে। নামই হয়ে যায় দাদুর মণ্ডা বা বরফি। বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন দোকানের ভার ছেলে দীনবন্ধু বাবুকে দিয়ে অবসর নিয়েছেন অশীতিপর মহাদেব বাবু।

মূলত ছানা থেকে এই মণ্ডা তৈরি হয়। তবে তার পদ্ধতি বেশ সময় সাপেক্ষ। দীনবন্ধু বাবুর কথায় তৈরির সময় মণ্ডাই তাদের চালিত করে। মণ্ডার সময় মেনেই তাদের পাক দিয়ে যেতে হয়। ছানা ভাল করে মেখে চিনি দিয়ে পাক দেওয়ার পর তা হাওয়ায় রেখে অপেক্ষা করতে হয়। একটু শক্ত হলে ছোট ছোট মণ্ডা তৈরি হয়। বরফি তৈরিতে অবশ্য আরও সময় লাগে। বারকোসে ফেলে আরও বেশ কিছুক্ষণ হাওয়ায় রাখতে হয়। শক্ত হওয়ার পর তা ছুরি দিয়ে কেটে আয়তাকার দেওয়া হয়।

বেশি সময় হাতে নেই। বসে খেলাম তো বটেই। সত্যিই অপূর্ব স্বাদ সেই বরফির, মুখে দিয়ে বুঝলাম রোজই কেন তৈরি হওয়ার আগেই লাইন পড়ে যায় দোকানে। বাড়ির জন্যও বেশ খানিকটা নিয়ে রেখেছিল পরিতোষ। দীনবন্ধু বাবুকে বিদায় জানিয়ে এবার ফেরার পালা। সময়াভাবে আমি যেতে পারলাম না বটে তবে এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মিরিটি গ্রাম। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি সেখানে। ইচ্ছে হলে আপনি বা আপনারা কিন্তু ঘুরে আসতে পারেন সেখান থেকেও। তবে ওই বাড়িতে প্রণববাবু পুজোর সময় আসেন, তখনই তা গমগম করে।
এবার ফেরার পালা। বিকেলে সরাসরি কলকাতা যাওয়ার বাস নেই। তাই আমি ঠিক করলাম বাসে বর্ধমান চলে গিয়ে সেখান থেকে ট্রেন ধরে নেব। সময়ও প্রায় একই লাগবে। আহমেদপুর দিয়েও ফেরা যায় অবশ্য। একটু দাঁড়াতেই এসে গেল বাস ফুঁটিসাঁকো, নতুনহাট হয়ে বর্ধমান। উঠে পড়লাম বাসে, ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই বর্ধমান স্টেশনের কাছে নামিয়ে দিল বাস। আমার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিল কর্ড লাইন হাওড়া লোকাল। ছুটে গিয়ে উঠতেই ছেড়ে দিল ট্রেন।
এই লেখাতে ছবিগুলির জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য আমার দুই ভাতৃপ্রতিম পরিতোষ দাস এবং অভিজিৎ বিশ্বাসের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × three =

preload imagepreload image