অঞ্জনা 

অচেনা অথচ গুরুত্বপূর্ণপুরাণে রয়েছে এমন অসংখ্য নারী চরিত্র। তাদের নিয়ে ধারাবাহিক লেখা থাকছে অবেক্ষণএ। বড়দিন সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে  হনুমানের মা অঞ্জনার কাহিনী। এবারে  তৃতীয় পর্বলিখছেন  ময়ুমী সেনগুপ্ত।

(পূর্ববর্তী পর্বের পর )

সরাসরি মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন তারা, এ সব কি শুরু করেছো মামনি! তোমার সম্পর্কে লোকে নানা কথা বলছে। তুমি বুঝতে পারছো না, যে এতে তোমার পিতার সম্মানহানি ঘটছে। তেমন হলে তুমি বল, আমি আর তোমার পিতা পবনদেবের কাছে তোমার সম্বন্ধ নিয়ে যাবো। কিন্তু এ ভাবে গোপনে তোমরা সাক্ষাৎ করছো, যা সঠিক নয়। তাছাড়া তোমার পিতা কিন্তু প্রেমজ বিবাহের একেবারেই বিরুদ্ধে। আবার তুমি পবন দেবকে ছাড়া থাকতে পারবে না, আমি বেশ বুঝতে পারছি। তাই আমি চেষ্টা করবো তোমার প্রেমজ সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দেয়ার।

কিন্তু তারার এই কথা ভালো লাগলো না পুঞ্জীকস্থলার। একটু বিরক্ত হয়েই বলে উঠলো সে পালিত মায়ের উদ্দেশ্যে, মা আমি এখন বড় হয়েছি। আমাকে অহেতুক উপদেশ দেয়া বন্ধ করো তুমি এবার। আর তাছাড়া আমার ভালো-মন্দের বোধ হয়েছে। আমি সঠিক আর বেঠিকের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করতে পারি। আর তাছাড়া তুমি নিজেও তো একদা পিতাকে ত্যাগ করেছিলে। তুমি সেদিন যে পথের পথিক ছিলে, আজ আমি সেই পথের পথিক। আর তাছাড়া তুমি বিবাহিত হয়েও যখন প্রেমের পথ বেছে নিয়েছিলে, তা সত্ত্বেও পিতা তোমাকে যখন ক্ষমা করেছেন, আমাকেও তিনি ঠিক ক্ষমা করবেন।

তারা স্তম্ভিত। এ কি শুনছেন তিনি। তিল তিল করে যে মেয়েকে ছোট থেকে বড় করে তুলেছেন এতো দিন ধরে, নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে না তাকিয়ে, সে কিনা আজ এতো বড় কথা মাতাকে অতি অনায়াসে বলে দিলো! এ কি সেই মেয়েটা! যে মায়ের কোলের কাছে না শুলে ঘুমোতে পারতো না, যে সারা বাড়ি ঘুরতো মায়ের পিছু পিছু। সব কিছুকে মা-কে চাই তার। মা খাইয়ে না দিলে খাওয়া হবে না। সব কিছু ছিল তার মা-ময়। কবে এতো বড় হয়ে গেলো সেই ছোট মেয়েটা, যে মাকে ছাড়া থাকতে পারতো না।

হায় রে মেয়ে, তুই বুঝলি না আসল সত্য। দেবগুরু বৃহস্পতি আমাকে ক্ষমা করতে চান নি, ক্ষমা করতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ চন্দ্রের সঙ্গে আমার গৃহত্যাগ ছিল বৃহস্পতির পৌরুষত্বের অপমান। দেবতাদের গুরু হয়ে কিনা তিনি তুচ্ছ চন্দ্রদেবের কাছে হেরে যাবেন। আর তাও কিনা এক রমণীর জন্য! হোক না সে স্ত্রী। কিন্তু নিজের পৌরুষত্বের সঙ্গে সমঝোতা কোনো ভাবেই করা সম্ভব নয়।

তাই তারাকে ফিরিয়ে এনেছেন তারার পরকীয়া সহ্য করেও। না হলে দেব সমাজে যে মুখ দেখানো যাবে না। সামনে না বললেও পিছনে লোকে বলতে ছাড়বে না, নামেই দেবগুরু। ধরে রাখতে পারলো না রূপসী ভার্যাকে নিজের ঘরে। তাই তো আজো তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এক অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণরেখা রয়েছে, যাকে অতিক্রম করবার চেষ্টা তারা কিংবা দেবগুরু বৃহস্পতি কেউই করেননি। সমাজের চোখে আজো তাঁরা আদর্শ দম্পতি, যাঁরা অনেক বাধা পেরিয়েও এক হয়ে আছেন। কিন্তু একমাত্র তাঁরা দুজনেই জানেন, সেই ফাটলটা জোড়ে সাধ্য নেই কারোর। তবে কর্তব্যে কারুর ত্রুটি নেই।

তবে আজ-ও চন্দ্রালোকিত রাত্রে অলিন্দে বায়ুসেবনের অছিলায় তারার চন্দ্রকে দেখা খুব ভালো করেই বুঝতে পারেন বৃহস্পতি। কিন্তু নিজেকে সংযত রাখলেও তাঁর চোখের তারায় ফুটে ওঠে ক্ষোভ। এ ক্ষোভ অপ্রাপ্তির, এক্ষোভ পরাজয়ের। কেউ না জানুক, দেব গুরু খুব ভালো করে জানেন যে তিনি কোনো দিন তারার হৃদয়ে একাধিপত্য লাভ করতে পারবেন না। সেই স্থান আজও নির্দিষ্ট রয়েছে সুধাকরের জন্য। তাই তো এক ফালি চাঁদ কিংবা পূর্ণচন্দ্র, সব রূপেই চন্দ্রদেব সমান প্রিয় পত্নী তারার কাছে।

কিন্তু তারাকে ঘরে ধরে রাখতে গেলে এ সব অর্থহীন আবেগকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। তাই সব কিছু দেখেও বৃহস্পতি না দেখবার ভান করেন। কিন্তু পুঞ্জীকস্থলা? তাঁকে কি ক্ষমা করবেন স্বামী! বোকা মেয়েটা জানে না যে দেবগুরু বৃহস্পতি সব কিছু মেনে নিতে পারেন, কিন্তু নিজের মর্জির বিপক্ষে যে যাবে, সে সন্তান হোক বা সন্তানসম, তাঁকে তিনি কখনোই ক্ষমা করবেন না, প্রয়োজনে কঠোর হতে তাঁর একটুও আটকায় না।

তার উপর যদি একবার বৃহস্পতি জানতে পারেন যে তারা একথা জ্ঞাত, তাহলে তারাকেও তিনি ছেড়ে কথা কইবেন না। মেয়ে হোক বা স্ত্রী হন, সবই তারা করবে, কিন্তু বৃহস্পতির পছন্দসাপেক্ষে, তাঁর অনুমতি ব্যতীত এ বাড়িতে যে কিছু হওয়ার জো নেই তা হয়তো আজও পুঞ্জীকস্থলা জানে না। সে শুধু তার পালক পিতার আদরটুকুই দেখেছে, তাঁর ভয়াবহ ক্রোধের সম্মুখীন যেন পুঞ্জীকস্থলাকে কখনো হতে না হয়।

কিন্তু আজ সব কিছু না জেনে, বলা ভালো ভাসা ভাসা জেনে এ কি করলো পুঞ্জীকস্থলা? হয়তো দোষ ওর নয়, দোষ তাঁর লালন-পালনের। তাঁর অনুশাসনেই নিশ্চয় কোথাও একটা ফাঁক থেকে গিয়েছে। না হলে আজ একথা মেয়ের মুখ থেকে কেন মা হয়ে তারাকে শুনতে হলো! হ্যা, মেয়ে ছাড়া পুঞ্জীকস্থলাকে কোনোদিন কিছু ভাবেননি তারা। হোক না পালিতা, পুত্রী তো। তাই সেই মেয়েকে বড় করে তুলতে নিজের জীবনকে নিঃশেষে উৎসর্গ করে দিয়েছেন তারা। আর সেই কন্যাই কিনা তাঁর দিকে আঙ্গুল তুললো! আসলে এ বোধহয় স্বামী বর্তমানে অন্য পুরুষের সঙ্গে সমাজ বহির্ভূত নিষিদ্ধ পরকীয়ায় মেতে উঠবার শাস্তি।

(চলবে)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 − 12 =