ইচ্ছে হলেই ইছামতী

পলাশ মুখোপাধ্যায়  

আমরা যারা কলকাতার আশেপাশে থাকি তাদের জন্য একটু দম ফেলবার জায়গা খুব প্রয়োজন। কোলাহল, দূষণ, হট্টগোল ছাড়িয়ে মাঝে মধ্যে একটু সবুজ প্রকৃতির মাঝে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারলেই যেন গদ্যে ভরা জীবনে আসে ছন্দের ছোঁয়া। সেটাই আবার কাজে ফেরার জন্য জিয়নকাঠি হয়ে ওঠে আমার মত ঘুরণচণ্ডীদের কাছে। কদিনের ঠাসা কাজের ফাঁকে সেদিন বেরিয়েই পড়লাম জয় মা বলে। বেশি দূরে যাওয়ার সময় নেই, তাই ঘরের কাছেই যেতে হবে; কি আর করা, উঠে বসলাম বনগাঁ লোকালে। উদ্দেশ্য ইছামতীর ধারে একটু সবুজের চাদরে মোড়া নিস্তরঙ্গ জীবনে ছোট্ট একটু ঢেউ তোলা।

প্রথমে একটু ছক কষে নিতে হয়েছে। কারণ আমি স্বল্প সময়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় যাব ঠিক করেছি। সকালে বেরিয়ে যখন ট্রেন ধরেছি তখন পূবের আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। ভিড়ের জন্য বনগাঁ লাইনের ট্রেনের দুর্নাম থাকলেও সকালের দিকে স্রোতের প্রতিকুলে অবশ্য ভিড় তেমন নেই। একটা জায়গাও মিলে গেল। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌঁছলাম হাবড়া। আমি নামব এখানেই। হাবড়া থেকে এবার বাস ধরবার পালা, গাইঘাটার দু কিলোমিটার আগে পড়ে জলেশ্বর মোড়। সেখানে নেমে এবার টোটো ভরসা। চারিদিকে সবুজের বেড়ার মাঝে দিগন্ত বিস্তৃত হলুদের বিস্তার। শর্সে ক্ষেতের এই ছবিটা সকাল সকাল মনটা বেজায় ভাল করে দিল।

আমার প্রথম গন্তব্য উত্তর ২৪ পরগণার  জলেশ্বরের প্রাচীন শিব মন্দির। জলেশ্বর বাজার লাগোয়া এই মন্দির একটু উঁচু ঢিপির উপরে তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরে যাওয়ার আগে প্রাতরাশের পাট চুকিয়ে নিতে চাইলাম। পাশেই একটি মিষ্টির দোকানে বিনা তেলের পরোটা এবং তরকারি মিলে গেল বেশ সস্তায়। নলেন গুড়ের রসগোল্লার স্বাদও দারুণ। পেট পুজো শেষ, এবারে মন্দির দর্শনের পালা। মন্দিরের পাশেই অনেকটা জায়গা সবুজ ঘাসে ছাওয়া, সেখানে শীতকালে পিকনিক করা যায়। মেলার সময় এই চত্বর অবশ্য এমন ফাঁকা থাকে না।

এই মন্দিরকে ঘিরেই সারা বছর বহু মানুষের আনাগোনা হয় গাইঘাটায়। সেন বংশের রাজত্বকালে দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে শিব পুজোর প্রচলন শুরু হয় এই এলাকায়। তখন একটি বিগ্রহ পুজো হতো। মন্দিরটি ছিল টিনের ছাউনি ও দেওয়ালে ছিল কাদা ইটের গাঁথনি। পরে গোবরডাঙার জমিদার রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শিব মন্দিরের জন্য ৬০ বিঘে জমি দান করেছিলেন। প্রাচীন মূল বিগ্রহটি অবশ্য এখন বছরের নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন ছাড়া দেখা যায় না। মন্দিরের পাশেই রয়েছে চার একর ৪০ শতক জমির উপরে একটি পুকুর, যা পরিচিত ‘শিব পুকুর’ নামে। বছরভর পুকুরের নিচে রাখা থাকে বিগ্রহটি। প্রতি বছর চৈত্র মাসের তৃতীয় সোমবার শিব পুকুর থেকে বিগ্রহ তুলে পরের দিন ওই বিগ্রহ নিয়ে সন্ন্যাসীরা পায়ে হেঁটে হালিশহরে গিয়ে বিগ্রহকে গঙ্গায় স্নান করান। ফিরে স্থানীয় আটটি গ্রামের ভক্তদের বাড়িতে পূজিত হন দেবতা। ১ বৈশাখ বিগ্রহকে ফের শিব পুকুরে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। মূল একটি শিব মন্দির ছাড়াও এখানে রয়েছে শিবের প্রতীক্ষা মন্দির ও একটি কালী মন্দির।

জলেশ্বর থেকে এবার যাব চৌবেড়িয়া, অটো বা বাস যায়, বাসে গেলে নগরউখড়া থেকে যেতে হয়। বনগাঁ মহকুমার চৌবেড়িয়া গ্রামের মিত্র বাড়িতে ১৮২৯ সালের ১০ এপ্রিল জন্ম হয় ‘নীলদর্পণ’ নাটকের স্রষ্টা দীনবন্ধু মিত্রের। ওই বাড়িতে বসেই লেখা হয়েছিল নীলদর্পণ নাটকের কিছুটা অংশ। নাট্যকারের ছেলেবেলাও কেটেছে বাড়িটিতে। দীনবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের পাঠশালায়। যদিও বাল্যশিক্ষা শেষ করে তিনি বাবা কালাচাঁদ মিত্রের সঙ্গে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু নানা সময়ে ফিরেও এসেছিলেন দেশের ভিটেয়। কবি ঈশ্বর গুপ্ত, সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মানুষের পা পড়েছিল এখানে।

তবে দীনবন্ধু মিত্রের বাড়ির দশা খুবই খারাপ। যে অংশে তিনি থাকতেন সেই অংশটি প্রায় ভেঙে পড়েছে। সামনে লেখকের একটি আবক্ষ মুর্তি ছাড়া বোঝার উপায়ও নেই। আশেপাশে থাকেন মিত্র বংশের অন্যান্য শরিকেরা, তাদের সঙ্গে কথা বলেই জানা গেল এই বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তারাও নাকি বহু চেষ্টা করেছেন। কিন্তু লাল ফিতের ফাঁসে আটকে এখনও সেই সব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। আধঘন্টা থেকে আবার বাস ধরলাম চৌবেড়িয়া থেকে। গন্তব্য গোপাল নগর।

গোপালনগরের শ্রীপল্লি বারাকপুর গ্রামের এই বাড়িটিকে ঘিরে এলাকার বাসিন্দাদের গর্বের শেষ নেই। কেননা, এখানেই জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বারাকপুর গ্রামের ওই বাড়িতেই বিভূতিভূষণের ছোটবেলা থেকে সাহিত্য-জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে। এখানে থাকাকালীনই তিনি লিখেছিলেন পথের পাঁচালি, ইছামতীর মতো কালজয়ী সব উপন্যাস। বাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্মৃতিরেখা’। তবে, ওই নামকরণ হয় বিভূতিভূষণের মৃত্যুর পরে। গোপালনগর হরিপদ ইনস্টিটিউশনে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছিলেন সাহিত্যিক।

বিভূতিভূষণের বাড়ির কাছেই ইছামতী নদীর ধারে তৈরি হয়েছিল ‘বিভূতিভূষণ স্মৃতিঘাট’। শোনা যায় ওই স্মৃতিঘাটের কাছেই ইছামতীতে সাহিত্যিক স্নান করতে আসতেন। ২০০০ সালে স্মৃতিঘাটে সাহিত্যিকের একটি বড় মূর্তি বসানো হয়েছিল। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা নষ্ট হতে চলেছে।

স্মৃতি ঘাটের পাশে একটি ঝুলন্ত সেতু ওই এলাকার আকর্ষণ বাড়িয়েছে। এই অঞ্চলে এমন ঝুলন্ত সেতু বড় একটা দেখা যায় না। আমিও সেতুর উপরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভালই লাগছিল, অনেকেই দেখলাম সেলফি তুলতেও ব্যস্ত। সবুজ পরিবেশে সেতুর ওপারে গ্রামের দিকে যেতেও মন্দ লাগে না। খানিক ক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে  গোপাল নগর থেকে এবার বনগাঁর দিকে। বাস যাচ্ছে চাকদা রোডের উপর দিয়ে।

বনগাঁ পৌছলাম যখন তখন প্রায় আড়াইটে বাজে। পেট জানান দিচ্ছে দুপুরের খাবারের সময় চলে যাচ্ছে। থানার মোড়ে একটা হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজন সারা হল। সামান্য দূরেই ইছামতীর সেতু। বনগাঁয় অবশ্য ইছামতীর দুটি সেতু। নদীর পাড় ধরে সৌন্দর্যায়ণের কাজ শুরু হয়েছে। এবার আবার একটা টোটো ধরে চললাম ছয়ঘরিয়ার দিকে।

ষোড়শ শতকে ছয় ঘর জমিদারের গ্রাম ছয়ঘরিয়া। এই ছয় জমিদারদের মধ্যে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার অন্যতম। এই বংশের সন্তান প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, পুরাতত্ববিদ, সাহিত্যক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা বহরমপুরের আইনজীবী ছিলেন, রাখালদাসের জন্মও হয় বহরমপুরেই। ১৯০৩ সালের পরে বাবা মায়ের মৃত্যুর পর এখানেই দেশের বাড়িতে বেশ কিছুকাল ছিলেন। পরে কলকাতায় পড়তে চলে যান। এখানে মাঝে মধ্যেই আসতেন। মহেঞ্জোদারো সভ্যতার সুপ্রাচীন ধংসাবশেষ আবিষ্কার তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। কুষান সম্রাট কণিষ্ক সম্পর্কে তিনি যে সব তথ্য আবিষ্কার করেন তা প্রামান্য বলে বিবেচিত হয়েছে। বাংলায় পাল রাজবংশ সম্পর্কিত বহু তথ্য তিনি আবিষ্কার করেন। পাহাড়পুরে খননকার্যের পরিচালক ছিলেন তিনি। মুদ্রাসম্বন্ধীয় বিষয়ে বাংলাতে প্রথম গ্রন্থ রচনা তার অন্যতম কৃতিত্ব। ইতিহাস এবং সাহিত্য মিলিয়ে একাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থের রচয়িতা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রাচীন বনেদি বাড়িটিতে এখনও দূর্গাপুজা হয়। সে সময় নাকি গমগম করে নির্জন শান্ত বাড়িটি। এখান থেকে আমি যাব সীমান্ত দেখতে।

                                    

পেট্রাপোল হল দক্ষিণবঙ্গের প্রধান স্থলবন্দর। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পেট্রাপোল সীমান্ত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ রক্ষার অন্যতম প্রধান পথও। সীমান্তের ওপারে রয়েছে বাংলাদেশের বেনাপোল। এমনিতেই ঘরের কাছে বিদেশ দেখার আলাদা উত্তেজনা রয়েইছে। তাই পেট্রাপোলে গেলে অন্যরকম অনুভূতি হয়। এই প্রসঙ্গে বলি, এদিকে এলে সঙ্গে একটা সচিত্র পরিচয়পত্র রাখবেন, লাগতেও পারে।

পেট্রাপোলে সম্প্রতি আরও একটা আকর্ষণ যুক্ত হয়েছে। দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর যৌথ কুচকাওয়াজ। অনেকেই ভারত পাকিস্থান ওয়াঘা সীমান্তে এই যৌথ কুচকাওয়াজ দেখেছেন। এখানেও বিএসএফ এবং বিজিবি-র এই যৌথ কুচকাওয়াজটা দেখতে মন্দ লাগে না। জিরো পয়েন্টে দু দেশের মাঝে বসে সেই কুচকাওয়াজ দেখা অন্য এক অনুভূতি আনে। ঠিক সাড়ে চারটেয় শুরু হয় এই কুচকাওয়াজ।

                                           

 

এখানেই শেষ নয়। এখানে এলে একবার যেতেই হবে মনসা মন্দির দেখতে। কি ভাবছেন? আমি এত ধার্মিক হলাম কবে থেকে? আসলে ধর্মের জন্য বা পুজোর জন্য যারা যাবেন তারা যেতেই পারেন। আমার আসল উদ্দেশ্য হল এই মন্দিরটি একেবারে বাংলাদেশের সীমানা লাগোয়া। মন্দিরের পিছনে ফুট পঞ্চাশেকের একটা জলাভূমি পেরলেই বাংলাদেশের মাটি। ওদেশের মানুষ, ওদেশের রক্ষী স্পষ্ট দেখা যায়। দেখলাম অনেকগুলি শিশু খেলা করছে মহা উৎসাহে, হইচই করে। বাংলা ভাষায় তাদের চিৎকার কানে যেতেই থমকে গেলাম, দেশ আলাদা কিন্তু ওদের দেখে তো কিছুই বুঝলাম না।

সন্ধে নেমে এসেছে, এবার ফেরার পালা। যেতে হবে অনেকটা পথ। পেট্রাপোল থেকে ফের টোটোয় চেপে এবার সোজা বনগাঁ ষ্টেশন, প্রায় আধ ঘন্টার পথ। স্টেশনে দাঁড়িয়ে ট্রেন। চপ মুড়ি নিয়ে উঠে গেলাম ট্রেনে, ফাঁকা ট্রেনে পছন্দ মত জায়গা পেতেও অসুবিধা হল না। জানলা দিয়ে ক্রমশ সরে যাচ্ছে গাছপালা। মনে মনে ভাবছিলাম, একদিনের এই ছোট্ট সফরে মন্দির, সাহিত্য, প্রকৃতি, পুরাতত্ব, সীমান্তের উত্তেজনা বহু কিছুই ছিল একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে। ভাললাগার আবেশ নিয়ে ফের ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছিলাম আবার সেই চেনা গদ্যময় জীবনের ছায়াপথে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 3 =