সম্পাদকীয়, ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বছরের শুরুতেই হাতে একটা খেলনা ধরিয়ে দেওয়া হল। বন্দেভারত এক্সপ্রেস। আমরাও সেই খেলনা পেয়ে সব ভুলে মেতে উঠলাম তা নিয়ে। মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া সকলকে দিয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে এমন একটা আলোড়ন তোলা হল যে আপনি আমি সেই সুনামিতে ভেসে গেলাম। একদল প্রচার করতে শুরু করল এটা নাকি ভারতের সেরা ট্রেন, বাংলার মানুষ এই ট্রেন পেয়ে গর্বিত, পুলকিত, মুখরিত, উচ্ছ্বসিত ইত্যাদি আরও কত কি? আর এক দলের দাবী এটা একেবারেই রাজনৈতিক চমক ছাড়া আর কিছুই নয়, নিছক একটা ট্রেন মাত্র। এত শোরগোলের কিছু হয়নি। এরই মাঝে ট্রেনের কাঁচে দুদিন ঢিল ছুঁড়ে আরও উত্তেজনা বাড়িয়ে দিল একদল। সব মিলিয়ে নিটফল একটাই, সকলে মিলে বছরের শেষে এবং শুরুতে সব ভুলে মেতে রইল একটা ট্রেন নিয়েই।

বন্দেভারত এক্সপ্রেসে আমি নিজে চেপেছি। কলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি যাতায়াত করেছি। ট্রেনটি ভাল নিঃসন্দেহে, কিন্তু এত উত্তেজনার মত কিছু আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়নি। সময়ের কথা যদি ধরা যায় তাহলে ওই একই রুটে এতদিন শতাব্দী এক্সপ্রেস চলত প্রায় একই সময়ে। প্রথম দিকে দেখা গিয়েছিল শতাব্দীর চেয়ে মাত্র পঁচিশ মিনিট কম সময় নেবে বন্দেভারত। ভারতের সব চেয়ে দ্রুতগামী সেমি হাইস্পিড ট্রেনের এই গতি দেখে অনেকেই এই নিয়ে হইচই শুরু করলে রেল বন্দেভারতের সময় সামান্য কমায়, শতাব্দীর সময় কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। বর্ধমানে শতাব্দীর নতুন স্টপেজ দেওয়া হয়। এই সব করে সেই ফারাকটা প্রায় এক ঘন্টা করা হয়। যারা বন্দে ভারতের এসি চেয়ারকারে গিয়েছেন তারা জানেন, শতাব্দীর চেয়ারকারের সঙ্গে সামান্য একটা দুটো বিষয় ছাড়া এর খুব একটা কিছু পার্থক্য নেই। খাওয়া দাওয়াও সমান। তবে এক্সিকিউটিভ চেয়ারকারে উঠলে তার ব্যবস্থা ভালই বন্দেভারতে। ৩৬০ ডিগ্রি ঘোরানো চেয়ার, ভাল খাওয়া দাওয়া, আরামদায়ক বসার আয়োজন সব মিলিয়ে এটা একটু ভাল শতাব্দীর এক্সিকিউটিভ চেয়ারকার থেকে। কিন্তু তার জন্য যে ভাড়া আপনাকে গুনতে হবে তা প্রায় বিমানভাড়ার কাছাকাছি। তাই বিমানে যেখানে মিনিট চল্লিশে চলে যাওয়া যাচ্ছে, সেখানে প্রায় একই ভাড়া দিয়ে সাড়ে সাত ঘণ্টার যাত্রা করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে একটু মতান্তর তো রয়েইছে।

কিন্তু এসব আলোচনা নিতান্তই তুচ্ছ যেখানে মানুষের মধ্যে পাহাড় প্রমাণ আবেগ উন্মাদনা চারিত করে দেওয়া হয়েছে সুকৌশলে। এটা বোঝা যায় বন্দেভারতে এক্সপ্রেসের কাছাকাছি গেলে। আর কোনও ট্রেনের সঙ্গে এত মানুষ প্রতিদিন সেলফি তুলেছে কিনা তা এখনই রেলের গবেষণার বিষয়। এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে নতুন ট্রেন তো মাঝে মধ্যেই দেওয়া হয়, এটা করে লাভ কি হল? প্রথমেই বলি বিজেপি সরকারের একটা সুস্পষ্ট বিজ্ঞাপনী নীতি আছে। এটা মোদির নিজস্ব স্টাইলও বলতে পারেন। ভারতের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি এখনও পর্যন্ত নিজে কোনও সাংবাদিক বৈঠক করেননি তিনি প্রতিনিয়ত সংবাদ মাধ্যমকে ব্যবহার করেই তার জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। যে কোনও কাজেই তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লক্ষণীয় ভাবে মিডিয়া কভারেজের ব্যবস্থা করা হয়। মোদি পাহাড়ের গুহায় একান্তে ধ্যান করতেই যান অথবা মায়ের সঙ্গে নিভৃতে সময় কাটাতে। ঠিক সময়ে ঠিক ছবিটা তোলার সুযোগ কিন্তু মিডিয়া পেয়েই যায়। যে মানুষ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতেই পছন্দ করেন না, তার এমন ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবিগুলি তোলার ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমের কৃতিত্ব বেশি না সেই হাইপ্রোফাইল মানুষের ইচ্ছা বেশি তা নিয়ে প্রশ্ন জাগেই।

আপনি আমি যখন বন্দেভারত নিয়ে খেলা করছি, তখন কি জানেন আমাদের অগোচরে বিশ্ব বাজারে ক্রমশ অশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। এক সময় এই  অশোধিত তেল ব্যারেল পিছু প্রায় ১৪০ ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। যার দোহাই দিয়েই সরকার পেট্রোল ডিজেলের দামে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিল। এখন কিন্তু এই দর নেমে এসেছে ৮০ ডলারেরও নিচে, কই এখন তো কেন্দ্র স্পিকটি নট। গত আট মাসেরও বেশি সময় ধরেই তেলের দর স্থির। সরকারের যুক্তি, আগে হওয়া লোকসান পুষিয়ে নিচ্ছে তারা, কিন্তু কতদিন? তার কোনও সুস্থ উত্তর মেলে না। আসলে খেলা হচ্ছেই। আমরা খেলছি ট্রেন নিয়ে, সরকার খেলছে আমাদের নিয়ে।

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten + 2 =