এসো কবিতা পড়ি

সুব্রত বিশ্বাস ,বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগণা  ##

সম্প্রতি কলকাতায় অনুষ্ঠিত কয়েকটি কবিতা পড়ার অনুষ্ঠানে জনৈক কবিতা-লেখক বা বলা যায় একজন ভিড়ের-কবি হিসাবে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়। অনুষ্ঠান গুলোর আয়োজক মূলত কোনও না কোনও পত্রিকাগোষ্ঠী। উপলক্ষ্য— হয় কোনও তরুণ কবির কবিতার বই প্রকাশ অথবা পত্রিকার বিশেষ কোনও সংখ্যার প্রকাশ। প্রত্যেকটা আয়োজনই শহরের কোনও না কোনও স্বনামধন্য অডিটোরিয়ামে। তবে বিখ্যাত ঐ স্থান গুলোতে কাব্য, শিল্পের পূর্বকালীন তথাকথিত ঐতিহ্যের বিশাল ও ব্যাপক ইতিহাস আছে। পরিচিত কোনও বন্ধুকে যদি বলা যায় গতকাল অমুক গৃহে কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম, নিঃসন্দেহে সমীহ আদায় হতে বাধ্য। এর কারন লুকিয়ে আছে ঐ পূর্বতন ধারাবাহিক কালচার-পীঠ মাহাত্ম্যে।

         যাক সে কথা, আসল কথায় আসা যাক— প্রথমত, বেশ অবাক লাগল প্রায় পরপর প্রত্যেক কবিতা পড়ার অনুষ্ঠানে অতিথি-আসন অলংকৃত করছেন হাতে গোনা তিন চারজন বিশিষ্ট, যাঁরা ইতিমধ্যে কবি। প্রত্যেকটা কবিতা-পড়ার আয়োজনে একই আমন্ত্রিত অতিথি দেখে হঠাৎ করে মনে হতে পারে, এনারা কি বাংলা কবিতা পর্ষদের নির্ধারিত প্রতিনিধি  ! আমার মতো পূর্ব-ঐতিহ্য-বোধ-ক্ষীণ স্বরচিত কবিতা পড়ার সুযোগ পাওয়া মানুষের তা-ই মনে হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, কবিতা-লেখকদের একটা পরিবেশ- প্রেমী ইমেজ সুস্পষ্ট হলো। কারন প্রত্যেক কবিতা পড়ুয়াই খাতা,ডায়েরি কিছুই সঙ্গে আনেন নি—- এমনকি প্রকাশিত কোনও সংকলন ও নয়। প্রত্যেকে মঞ্চে উঠছেন আর হাতে ধরে থাকা মোবাইল ফোন থেকেই দিব্যি কবিতা পড়ছেন। তবে কি এবার কাগজের দাম পড়ার সম্ভাবনা থাকছে, নাকি কাগজ উৎপাদনে যে সবুজ ধংস হয়, তার কিছুটা অন্তত বিহিত হলো ! 

       তৃতীয় যে প্রসঙ্গে একটু না বললেই নয়, তা হলো—   কোনও কবিতা লিখিয়ে যখন পড়ছেন, তখন সামনে বসে থাকারা মোবাইল টেপা থেকে শুরু করে পরস্পরের সঙ্গে এমন খোসগল্পমত্ত থাকেন যে আয়োজকদের পক্ষ থেকে চিৎকার করে বকতে হয়। এটা যদি চলতেই থাকে, তবে অনুষ্ঠান তো ফাঁকা মাঠে ময়দানে করা দরকার। চতুর্থত, আয়োজকদের আসল উদ্দেশ্য বোঝা বেশ মুশকিল—- ফেসবুক বা অন্য কোনও মাধ্যমে যেমন কবিতা পড়ুয়াদের ডাকা হয়, তেমনি পত্রেও ডাকা হয় নিশ্চয়ই; কিন্তু একটা সহজ প্রশ্ন সেক্ষেত্রে থেকেই যায়, এতো গড় ডাকাডাকি, এতো গড়ে পড়ে যাওয়া কেন ! আর শুধু তাই নয়, স্বরচিত কবিতা পড়ার অনুষ্ঠানে মাঝে মাধ্যেই ‘বাচিক শিল্পী ‘ বিশেষিত নারী পুরুষ মঞ্চে উঠে উত্থান-পতন ময় এক শ্রুতি নাট্য পরিবেশন করেন। যা আয়োজকদের মজার লাগলেও কবিতা- লিখিয়েদের সভায় এই ড্রামাটিক রিলিফ কেন রাখা হয় বুঝতে পারিনি। 

      পঞ্চমত, বেশ কিছু কবিতা লিখিয়ে নিজের কবিতা পড়ার আগে রীতিমতো একটি তাৎপর্য পূর্ণ ভূমিকা পরিবেশন করেন যা উপস্থিত সক্কলের কাছেই বিরক্তির উদ্রেক করে তা বোঝা যায়। এমনই একটা অনুষ্ঠানে দেখা গেল, অনুষ্ঠানের মূল হোতা বেশ রেগেমেগে এক কবিতা লিখিয়েকে বলছেন,  ‘ কথা বাড়াবেন না, কবিতাটা পড়ুন।’ আপাত দর্শনে যা সকল কবিতা নির্মাতাদের কাছেই অপমানের। ষষ্ঠত, আর একটা গভীর দুঃখের কথা বলি, কবিতা লিখিয়েরা কিন্তু কখনওই মাত্র একটা কবিতা পড়ে মঞ্চ থেকে নামতে চান না।কেননা মাত্র একটা কবিতা দিয়ে কবিকে চেনা বা বোঝা স্পষ্ট হয় না বলেই কবিতা লিখিয়েদের দৃঢ় ধারণা। অথচ আয়োজকরা মাত্র দুঘণ্টার কবিতা-পড়ার অনুষ্ঠানে নেমন্তন্ন করে বসেন শতাধিক কবিতা লিখিয়েকে। ফলে সঞ্চালক ঘন ঘন মনে করিয়ে দিতে থাকেন, ‘অনুগ্রহ করে কবিরা প্রত্যেকে একটি করে কবিতা পড়বেন।’ কখনও দেখি, ‘কবিতার লাইন বারো থেকে ষোলোর মধ্যে রাখুন’ বলেও ঘোষণা চলছে। সম্প্রতি দেখলাম, উদ্যোক্তারা আমন্ত্রণ পত্রে লিখে দিয়েছেন— ‘ প্রত্যেক কবির জন্য সময় বরাদ্দ, মাত্র তিন মিনিট।’ আমর মনে হয় কবিতা লিখিয়েদের একটা আন্দোলন আসতে চলছে—– আমাদের কবিতা পড়তে ডাকলে কিছুটা স্বাধীনতা দিতে হবে। 

         তবে হ্যাঁ,  কবিতা লিখিয়ে বলে যাঁরা মঞ্চে ওঠেন এবং বেশ কয়েকটি পড়ার আকাঙ্খা নিয়েই উঠেও, একটি পড়ে মনঃপীড়া নিয়ে মঞ্চ থেকে নামেন—- তাদের অনেকেই প্রেমের চিঠি লিখে নিয়ে চলে আসেন। কেউ বা চরম নারীবাদী, গত দু তিনটে অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকটি কবিতা শোনা গেল যার শুরুটা প্রায় এই কথাটা দিয়ে, ‘ আমি এক সাধারণ মেয়ে।’ অতএব বাকি কবিতাটা আপনাদের আন্তরিক আন্দাজে আছে। এমনই সাম্প্রতিক আর একটি অনুষ্ঠানে জনৈক কবিতা লিখিয়ে মঞ্চে উঠে ঘোষণা করলেন, তিনি ইংরেজি কবিতা লেখেন।আমি তো ভয়ে চুপ, দেখলাম এমন হোচট খেয়ে খেয়ে পড়ছেন, প্রশ্ন জাগলো কার লেখা  ?

    যা হোক, কবিতা পড়ার আয়োজনে বাংলা এখন একটুও পিছিয়ে যাচ্ছে না।বই প্রকাশ থেকে পত্রিকা প্রকাশ সবই সদর্প। কিন্তু কবিতা লিখিয়েদের স্বরচিত লেখার পাঠ অনুষ্ঠান এখনও যেন কিছুটা এলোমেলো, আবেগ তাড়িত। আবেগ থাকুক লেখায়, সাধনায় কিন্তু অনুষ্ঠানে কিছুটা হলেও সংযম থাকলে সমৃদ্ধি কম হয় না। আর আয়োজকরা বড্ড গড় মূল্যায়নে মেতেছেন, কবিদের পরিসর দিন সৃজন ভালবেসে,কবির সম্মান প্রাপ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 − eleven =