ওপিডি ডিউটি

বিমলেন্দু মণ্ডল, বারুইপুর

 

সাম্ব দাস, বীরভূমের নানুরের বাসিন্দা। বাবা মার একমাত্র সন্তান। স্কুল শিক্ষক বাবার অকাল মৃত্যু হয় ওর দশ বছর বয়সে।

বাবার মৃত্যুর পর ওর মা স্বামীর চাকরিটা পায় অনুকম্পা জনিত কারণে।

পড়াশুনায় মেধাবী সাম্ব  মেডিকেল কলেজের ইন্টার্নশিপ করছে।

সাম্ব আগাগোড়া স্বনির্ভর। টিউশন করে সে তার পড়ার খরচ চালিয়ে এসেছে স্কুল জীবন থেকে।

এখনও তাই  করে। একটা প্রেসে পার্টটাইম কাজ করে। সঙ্গে দুটো টিউশন। তাতে ওর হাতখরচ ভাল ভাবেই চলে যায়।

সাম্ব একটা টিউশন সেরে তাড়াতাড়ি পা চালাল কলেজ স্ট্রিটের

দিকে। সেখানে একটা পাবলিশিং হাউসে প্রুফ রিডার ।

একটু আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও জল জমেছে। সূর্য সেন স্ট্রিট থেকে   ও এম জি রোডের দিকে যখন যাচ্ছিল, তখন  এক বয়স্ক মহিলা সাম্বকে বললেন, বাবা আমাকে একটু রাস্তাটা পার করে দেবে?

নিশ্চয়ই, আসুন আপনি। সাম্ব  ভদ্রমহিলার হাত ধরে যখন প্রায় ওপারে চলে গেছে তখন  একটি প্রাইভেট কার আর একজনকে বাঁচাতে  জোরে ব্রেক কষে সাইডে  চলে এসে ভদ্রমহিলাকে  ধাক্কা দিল।

ভদ্রমহিলা পড়ে গিয়ে মাথায় মাথায় চোট পেলেন। সাম্ব চিৎকার করে বলে, কানা নাকি দেখতে পান না?

গাড়ির গতি অল্প থাকায়  আঘাত গুরুতর হয়নি। পড়ে গিয়ে মথায় আঘাত পায়।

সাম্ব মাথাটা তুলে দেখল রক্ত পড়ছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেওয়া দরকার ।

গাড়ির চালক তাড়াতাড়ি নেমে এলেন।

জোড় হাতে বললেন, ভেরি সরি, আমার  কিছুই করার ছিল না। একজন  আমার গাড়ির সামনে পড়ে। কুড়ি বাইশ বছর বয়সের এক যুবতী।

সাম্ব মহিলাকে বলে একে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে এক্ষুণি। আপনি সাহায্য করুন। লোক জমছে। এখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়া দরকার। চলুন। কেটে পড়ি।

দুজন মিলে গাড়িতে তুলে সোজা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের  ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল।

ভদ্রমহিলাকে ট্রলিতে করে নিয়ে সাম্ব  ওটিতে ঢুকে গেল।

প্রায় ঘন্টাখানেক পর সাম্ব ফিরে এল প্রেসক্রিপসন হাতে।

মেয়েটি বিষন্ন মনে গালে হাত দিয়ে কি যেন ভাবছিলেন গভীর ভাবে।

সাম্ব ওর সামনে দাঁড়িয়ে একটু কাশল। কিন্তু তাতে ওর চিন্তায় ছেদ পড়ল না।

তখন বাধ্য হয়ে সাম্ব ডাকল, এই যে শুনছেন ?

মেয়েটি একটু চমকে উঠে দাঁড়াল।

সাম্ব বলল ভয় পেয়েছিলেন বুঝি?

হু তা একটু চিন্তিত তো ছিলাম।

সাম্ব বলল একটু নয়, খুবই চিন্তিত ছিলেন। যাক ভয়ের কিছু নেই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, উনি ভাল আছেন। আর  এই ঔষুধগুলো প্লিজ কিনে দিয়ে যান।

আমার দেরী হল,  কাজে যেতে হবে।

এই যে শুনুন,  কত দূর যাবেন কাজে?  আমি আপনাকে না হয় পোঁছে দিচ্ছি।

তার দরকার হবে না। আমি কাছেই  যাব। বলে হাঁটতে শুরু করল ।

মেয়েটি ছুটে ওর সামনে এল।  এসে  আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল ।

বলুন,  চলতে চলতেই বলল সাম্ব।

মেয়েটি  ভীতস্বরে জিজ্ঞেস করল,

কোন পুলিশ কেস হবে না তো?

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সাম্ব হেসে

ফেলল। ভয় পাবেন না, কোন ভয় নেই  আপনার। কোন পুলিশ কেস হবে না। আমিও কোন কেসের কথা বলিনি।

আচ্ছা আসি, আপনি ঔষুধ গুলো আর প্রেসক্রিপসনটা ফিমেল ওয়ার্ডে জমা দিন। পারলে কাল একবার  দেখে যাবেন। বাই।

এই বলে হনহনিয়ে চলে গেল সাম্ব।

ঋতিকা ওর চলার পথের দিকে চেয়ে রইল যতক্ষণ  ওকে দেখা গেল।

সাম্ব চোখের বাইরে চলে গেলেও, ফিরে এল ওর মনে। ঋতিকার সারা মন জুড়ে রইল স্বল্প পরিচিত  এই যুবক ।

শুধু কয়েক মিনিটের মধ্যেই কি বিপ্লব ঘটে গেল ওর মনে। যে মন প্রহর গুনছিল  এক অজানা আশঙ্কায়। সেই মন থেকে সব আতঙ্ক মুহুর্তে অবসান হল শুধু হাসি মুখের একটি কথায়।

“ভয় পাবেন না, কোন ভয় নেই আপনার।”

এই কথায় ঋতিকার মনের ভয় গেল ঠিকই, শুরু হল চিন্তা।

এক মহিলা জানতে চায় কটা বাজে ?

প্রশ্ন সচেতন হয় ঋতিকা, এখন  আটটা বাজে।  মানে দুঘন্টা এখানে আছে ও।

ওষুধ  আর প্রেসক্রিপসন ফিমেল ওয়ার্ডের সিস্টার ইন চার্জের হাতে দিল।

ঋতিকা ওগুলো জমা দেবার আগে প্রেসক্রিপসন এর  একটা ফটো নিল মোবাইলে বুদ্ধি করে।

ঋতিকার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরছে কি ভাবে ছেলেটির পরিচয় জানা যায়? ও মোবাইল খুলে প্রেসক্রিপসনে পেসেন্টের নাম দেখল। অনিমা দাস, বয়স 55 বছর। ঠিকানা কোলকাতা -700015 ।

যদি এই মহিলা ছেলেটির মা হন তা হলে নিশ্চয়ই ছেলেটি সকালে অবশ্যই আসবে মায়ের খোঁজ নিতে।

রাতে ভাল ঘুম হল না।  সকালে উঠেই ঋতিকা মেডিকেল কলেজ গেল।

অন ডিউটি নার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলল কাল সন্ধ্যার সময়ে ভর্তি অনিমা দাস কোথায় আছেন যদি বলেন?

রেজিস্টার দেখে সিস্টার বলেন সেকেন্ড ফ্লোর এ ফিমেল ওয়ার্ডের 22 নং বেড।

ঋতিকা বলে, ম্যাডাম একটু দেখা করতে পারি?

এখন তো ভিজিটিং আওয়ার নয়,  যেতে দেবে না।

জানি ম্যাম, তাই তো আপনার সাহায্য চাইছি। আমার  আত্মীয় উনি। খবর পেলাম রাতে পথ দুর্ঘটনার জন্য উনি এখানে ভর্তি হয়েছেন।

ঠিক  আছে, এক জন আয়াকে ডেকে বলে দিলেন, এনাকে একটু সেকেন্ড ফ্লোরে ফিমেল ওয়ার্ডের 22  নং নিয়ে যা।

ভদ্রমহিলা চুপচাপ শুয়ে ছিলেন ।

ঋতিকা জিজ্ঞেস করল কেমন  আছেন ?

ভদ্রমহিলা বলল, আমি তো তোমাকে চিনলাম না ?

কাল আমার গাড়ির সঙ্গেই  আপনার এক্সিডেন্ট হয়। আপনার ছেলে আর আমি  আপনাকে হসপিটালে ভর্তি করি।

আমার ছেলে? কে বলল?

কেন  কাল আপনার হাত ধরে পথ পার করছিল কে সে?

ও, আমি তো ওকে চিনি না মা। ওখানেই দেখা হয় ওর সঙ্গে।

উনি আপনার ছেলে নয় তাহলে?

না।

বেশ,  হয়ত বিকালে উনি আসতে পারেন। আমি বিকালে আবার আসব। আসি এখন।

চারটে থেকে ভিজিটিং আওয়ার শুরু হয়। ঋতিকা শুরুতেই গিয়ে বসল

22 নং বেডের পাশে, ছটা বাজাতে চলল

কিন্তু সেই ছেলেটার  দেখা নেই।

আপনাকে যে ভর্তি করেছেন তিনি তো এলেন না?

ও, আপনি তো তাকে চেনেন না ?

না মা।

আপনার ছুটি কবে হবে?

কাল  আমার ছুটি হবে।

তা কোথায় থাকেন আপনি?

আমি হরিদেবপুরে একটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকি। আমার নাম অমৃতা সরকার। আমি অবসরপ্রাপ্ত  এক শিক্ষিকা। আমার  এক মেয়ে,  ফ্রান্সে থাকে। আসে মাঝে মাঝে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। আমিও যাই কখনও কখনও। বিদেশ থাকতে আমার ভাল লাগে না।

তা কাল আপনি একা একা যেতে পারবেন?

হাঁ একা একাই যেতে পারব। যেতে হয়।  আমার অভ্যাস আছে। একাই ঘুরি সব জায়গাতেই।

একা ঘোরাঘুরি করতে ভয় হয় না?

না ভয় করে না খুব একটা। কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। একা  বের হয়ে ছিলাম বলেই তো তোমাদের মত ছেলে মেয়ের  সঙ্গে পরিচয় হল।

কোন্ ছেলের কথা বলছেন ?

এই হসপিটালের এক ইন্টার্ণ  ডাক্তার।

সেই  আমার কাল থেকে দেখভাল করছে। নাম সাম্ব দাস ।

বা, বেশ ভাল মানুষ উনি।

ওই আমাকে আমার ঘরে দিয়ে আসবে বলছে।

আপনার  মোবাইল আছে?

হাঁ আছে। তবে আমার ব্যাগে আছে?

আপনার ব্যাগ কোথায়?

সাম্ব বলেছে ওর কাছে আছে।

কিন্তু সাম্ব এর কাছে গেল কি করে?

ভর্তি করেছে তো সেই ছেলেটি।

তা তো বলতে পারব না কি করে ও পেল?

ও হয়ত সিস্টারের কাছে জমা দেয়, সিস্টার  ওকে দিয়েছে।

তা হতে পারে।

আন্টি ডাক্তার সাম্ব এলে আমাকে একটা ফোন করতে বলবেন? আমার নম্বর

আপনাকে দিচ্ছি।

ঋতিকা অন ডিউটি নার্সের টেবিলে গিয়ে এক টুকরো কাগজ চাইল।  একজন

অল্পবয়স্ক নার্স মুখ না তুলেই বলল, এখানে কাগজ হবে না।

পাশে বসা অপর নার্সটি বলল দিচ্ছি। বলে এক টুকরো কাগজ দিল  ঋতিকার হাতে।

ও বলল থ্যাংকস ম্যাম। ম্যাম 22নম্বর বেডের পেশেন্টকে কে ভর্তি করেছেন জানা যাবে? উনি আমার আত্মীয়া। একটা এক্সিডেন্টের পর কে ওনাকে এখানে ভর্তি করেন জানি না। তিনি আর আসেনি দেখা করতে।

দেখছি বলে সিস্টার রোগী ভর্তির  রেকর্ড  বুকটা নিয়ে দেখে বললেন, ইন্টার্ন সাম্বের নাম লেখা আছে।

ম্যাম সাম্বের কি আজ ডিউটি আছে?

না সাম্বের আজ ডিউটি শেষ ।

কাল আটটা থেকে দুটো ডিউটি।

থ্যাংকস ম্যাম, বলে ঋতিকা চলে গেল।

ঋতিকা ওর মোবাইল নম্বর অমৃতা আন্টির কাছে  দিয়ে বলল, আমি আপনাকে পৌঁছিয়ে দেব। সাম্ব এলে বলবেন,  আমি ওর দেখা করতে চাই।

আসি এখন।

রাতে ঋতিকা রাতে ঠিক করল, আটটার সময় মেডিকেল কলেজে গিয়ে সাম্বের সঙ্গে দেখা করবে।

আটটার সময়  এনকোয়ারি থেকে জানল, সাম্ব দাস ওপিডি 6নং রুমে রোগী দেখছেন।

6 নং ঘরে গিয়ে দেখে রোগী গিজগিজ করছে। একজন মাত্র ডাক্তার  রোগী দেখছেন। একজন রোগীকে জিজ্ঞেস করল ডাক্তারের নাম কি?

সে বলল, আমি জানি না।

এক বিশৃঙ্খল অবস্হা।

ঋতিকা কিছুক্ষণ  অপেক্ষার পর ঠিক করল এখানে যা অবস্থা এখন সাম্বের  সাথে কথা বলা অসম্ভব।

অপেক্ষা করতে হবে।

অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর ফলে পা ব্যথা শুরু হওয়ার জন্য বসার জায়গার খোঁজে বাইরে এল। এসে অবাক। গোটা এলাকা লোকে লোকারণ্য ।

ও ঠিক করল বাইরে কোথাও অপেক্ষা করবে। বারটার সময় আসবে।

বের হবার জন্য ঋতিকা ভিড় ঠেলে গেটের দিকে যখন যাচ্ছিল, তখন  একজন ওর পথ আটকাল।

বিরক্ত  ঋতিকা বলে, কি হল সরে যান, বলে লোকটির দিকে তাকিয়েই অবাক। আপনি এখানে?

একটু কাজ ছিল। আপনি এখানে কি করছেন?

সব বলছি, বাইরে চলুন আগে।

দুজনে বাইরে এসে একধারে একটা চায়ের ঠেকে বসল ।

আমি আপনাকে কাল থেকে কত খুঁজছি?

কেন? কোন দরকার ছিল ?

বারে আপনি আমাকে বিকালে আসতে বললেন, অথচ আপনি এলেন না?

আমি আসব একথা তো আপনাকে বলিনি।

তা বলেন নি ঠিকই। আমরা দুজনেই ওনাকে ভর্তি করেছি তো।

হাঁ তা ঠিক। আসা উচিত ছিল আমার, কিন্তু জানেন তো পেটের দায় বড়

দায়। আমি ঐ সময়ে কাজ করে কিছু রোজগার করি।

ও, কি করেন আপনি?

এখানো পড়াশুনা শেষ হয়নি।

গ্রাজুয়েশন করছি। আর এর ফাঁকে কিছু রোজগারের চেষ্টা করি হাত খরচের জন্য।

কোথায় থাকেন?

কাছেই একটা হোস্টেলে থাকি।

ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করেছেন?

আজকে যাব ভেবেছি?

আমি কাল গিয়েছিলাম। দেখা হল ওনার সঙ্গে? ওনার  পরিচয় পেলাম।

বেশ,  উনি ভাল আছেন এই খবরটাই আমার কাছে আনন্দের। উনি সুস্থ হয়ে বাড়ি  ফিরে যান এটাই বড় পাওনা আমার কাছে।

ঠিক আছে আমি এবার আসি তাহলে?

আমার নাম  ঋতিকা বোস। আপনার নাম ?

আমার নাম সাম্ব দাস ।

আপনিই ইন্টার্ন ডাক্তার সাম্ব ?

হ্যা আমি সাম্ব। আমার  এখন  ওপিডি ডিউটি।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen − 11 =