কাঁচা পাতার গন্ধ

 জুরি বরুয়া

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ:  বাসুদেব দাস

 

বিস্তীর্ণতা মানুষকে কী দেয় ?

একটি বিশাল হৃদয়,কিছু নিখুঁত আন্তরিকতা, আর …? আর ও অনেক কিছু –কেবল প্রেম নয়—প্রেমের মধ্যদিয়ে জীবনকে ছুঁয়ে দেখার সমস্ত সমাধানই বিস্তীর্ণতা দান করে। আর সবুজ বিস্তীর্ণতা ?    তাতেকী থাকে ? তাতে থাকে নূপুরের শব্দ,কোমল পাতাগুলির স্পর্শ—উর্মিলার হতাশা জয় করা মাদলের শব্দ—যেন কেবল নিশ্বাস আর নিশ্বাস—বাংলোর ছায়াগুলি চুষে নিতে নাপারা নিশ্বাস। নিশ্বাসের কথাগুলি থাক। সেসবের দ্রষ্টব্য আলাদা। সেগুলির আবেদন এবং আতিশয্য ও ভিন্ন।

যতদূর দেখা যায় সবুজ ছাড়া আমি আর কিছুই দেখতে পেলাম না। অম্লানের বাইকের ঘর্ঘর শব্দ এক সময় নাই হয়ে গেল। রাগ আর অস্বস্তিতে সে পাকা থেকেরার রঙ লাভ করল। আমি কিছুই বললাম না—কিছু একটা বললেই তার সমস্ত শরীরটা শিঊরে উঠবে—সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

—তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি আশেপাশে কিছু পাওয়া যায় নাকি দেখে আসছি।

আমি আস্তে করে মাথা নাড়লাম। অম্লান মানুষটি সত্যিই খুব ব্যস্ত। তার মধ্যেও সময় করে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। কী দেখাতে এনেছে তা সঠিকভাবে সে নিজেও জানে না। কিন্তু আমি বারবার তার একটি নতুন রূপ দেখেছি। পুরুষের নতুন রূপগুলিতে রহস্য আছে। আবেদন ভরা রহস্য। সব সময় সেই রহস্যগুলি ভেদ না হলেও দেখতে থাকা ব্যক্তি ধরতে পারে সেগুলির উৎস এবং উচ্চাত্মিকা। অম্লান ও তার বিপরীত নয়।

বাতাসে কাঁচা পাতার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল। শিরীষ গাছগুলি যেন তা উপভোগ করছিল। প্রকৃতির এর চেয়ে বেশি আকর্ষণ আর কী হতে পারে!

অসম কোম্পানি গঠিত হওয়ার সময় এ কথা কেউ ভেবেছিল কিনা -এই যে সবুজ-এই সবের আকর্ষণেই একদিন শুরু হবে এই নতুন বসতি? আরম্ভ হবে শিরীষ গাছের ছায়াভরা এই অন্তরংগ কোলাহল ? আমিও যে কী!ওটা ছিল ব্যবসা-এক অর্থে ছায়াভরা অর্থনীতি। সেখানে আবেদনের স্থান কোথায় ? তবু তাকিয়ে থাকলে মনে হয় সিংফৌর সঙ্গে রবার্ট ব্রুসকে পরিচিত করে মণিরাম দেওয়ান একটা যুগের সৃষ্টি করেছিল। অসম কোম্পানির নয়জন শেয়ার অধিকারীর একজন ছিলেন মণিরাম দেওয়ান। দেওয়ান নাকি সেই সময়ের ইউরোপিয়ান অফিসারের চেয়েও বেশি বেতন পেতেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক সমীকরণেরশর্ত স্থানীয় ব্যবসায়ীর উত্থানকে নিজের অনুকূল বলে ভাবে নি। তাই আরম্ভ হয়েছিল সংঘাত। এক ইতিহাস স্বীকৃ্ত সংঘাত!

বাতাসে ভেসে আসা এক ঝাঁক সুরকে কলঘরের শব্দ নাড়া দিয়ে গেল। আমার এমন মনে হল সামনের পুরো বাগানটা হঠাৎ কেঁপে উঠল।

বাংলোতে প্রবেশ করে আমার সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল। বৈঠকখানা ঘরের চারপাশেই তো দেখছি আমি। এতগুলি প্রতিবিম্ব। প্রতিটি দেওয়ালে ছোট বড় অনেক আয়না। মেহগিনি কাঠের অহংকারী আসবাব।বাঘের ছালের পাশে পুরোনো বন্দুকের গর্ব্বভরা স্থবিরতা। কিন্তু কেন জানি ক্লান্ত অনুভব করা সত্ত্বেও এই চেয়ারে আমার বসতে ইচ্ছা করল না। নিজের সঙ্গে কেমন যেন মানাচ্ছিল না।

অম্লান দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সে একবার ও আমাকে ডাকল না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। এই আভিজাত্যের সঙ্গে আজন্ম পরিচিত অম্লানের সহজ সরল রূপটির প্রতি আমার ঈর্ষা জাগল। সে এইসবের সঙ্গে মেলে না।বোধহয় সেইজন্যই সে ঘরের কথা কারোকে বলতে চায় না। এবার জোর না করলে সে হয়তো আমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসত না।

সামনের টেবিল ভর্তি করে আমার সামনে অনেক রকম খাদ্যসামগ্রী সাজিয়ে রাখা হল। আমার নিজেকে আলাদিনের প্রদীপের সামনে বসে আছি বলে মনে হল। আভিজাত্য মানুষকে অনেক কিছু দান করে। কখনও কখনও মনে হয় প্রাচুর্যের অহঙ্কা্রই হল আভিজাত্য। কিন্তু প্রাচুর্যবিহীনভাবেও এই যে পুরোনো আভিজাত্যকে জোর করে টেনে ধরে রাখা হয় -তাতে লুকিয়ে থাকে এক পৌরাণিক আলিঙ্গন। এই আলিঙ্গন অন্য কিছু নয়—নিজের নামের চারপাশে এক দল মন্ত্রমুগ্ধ নিপীড়নকে দেখার। ‘দেখ—আমি তোমাদের সামনে শেষ সমাধান’—এভাবে যেন অপেক্ষা করে থাকে আভিজাত্যের দৈব নেশা।বৈঠকখানা ঘরে গুড়গুড়িটা দেখে আমারও সেই রকম অনুভব হল। বোধহয় অম্লান কোথাও সেই আভিজাত্য থেকে পালাতে চায়। বোধহয় পুরোনো এই বাংলোর অতীতের ঐতিহ্যে সে নিশ্বাসহীনতায় ভোগে। ছটফট করতে করতে সে পুনরায় নিজের ভেতরে ঢুকে যায়।

মাঝে মধ্যে আমারমনে হয় নগ্নতায় যে সৌন্দর্য থাকে সে রকম আর কোথাও থাকে না। সেই সৌন্দর্য নির্ভর করে কার সামনে তুমি নগ্ন হতে চাইছ -তোমার প্রিয়জন? যাকে তুমি কোনোকিছুর দ্বারাই বেঁধে রাখতে চাওনি ? যে তোমার সামনে বিশুদ্ধ এবং যার সামনে তুমি স্বাধীন। এই যে আমার কাছে শুয়ে পড়ে মানুষটা -শিশুর মতো তার চোখ—সরে আসতে চাইলেই পুনরায় বুকের কাছে চলে আসতে চায় –এই শান্ত মানুষটিকে দেখলে কেউ কি কল্পনা করতে পারবে যে –ও মাঝে মধ্যে ক্রোধের রাজা হয়ে উঠে। সামান্য চুলে হাত বুলালেই লম্বা শ্বাস নিয়ে পুনরায় আমাকে খামচে ধরে। নেশায় থাকলেই বলে ,মাকে মনে পড়ছে অ’মিতা।

মাঝে মধ্যে তোমাকে কেমন যেন বুঝতে পারি না অম্লান। প্লিজ ওভাবে বল না-অন্ততঃ তুমি বল না-নাহলে কার কাছে আমি রাগ করব-জেদ করব।

জানালা দিয়ে সবুজের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমি অম্লানের কথা ভাবি। জানি না সে কি বলতে চেয়েও আমাকে বলতে পারে  না। জানি না কিসের এত ভয়—হারানোর ভয়! হারানোর জন্য মানুষের কী থাকে ? মানুষ নিজেই নিজেকে হারাতে পারে—তার বাইরে বাকি সবটাই মোহ। শুধু মোহ,প্রেম নয়। প্রেম হারায় না—প্রেম বুকে খোদিত হয়ে থেকে যায়।

–মেমসাহেব, স্নান করে নিন। বড় সাহেব আসার সময় হয়ে গেছে।

মেয়েটি একবার হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার চেহারা কারও সংগে মিলে। কার সঙ্গে ? উর্মিলা-হ্যাঁ,উর্মিলার সঙ্গে ওর চেহারার মিল রয়ছে। সেই যে ওর মা আমাদের বাড়িতে উর্মিলাকে রেখে এসেছিল।

উর্মিলা আমারই বয়সের ছিল। মা চলে যাবার পরে ও খুব কেঁদেছিল। একদিন ও নিজেই বলছিল-আমাদের বাড়িতে খাবার নেই,তাই মা রেখে গেছে। পাতা তোলার বয়স হলেই একদিন এসে নিয়ে যাবে। খুব অল্প দিনের মধ্যেই উর্মিলা আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিল। তার সখ ছিল। পুজোর সময় মা তাকে পয়সা দিত। উর্মিলা চূড়ি,বিন্দি,নেইল পালিশ কিনতে খুব ভালোবাসত। আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে আশ্চর্যজনক ভাবে উর্মিলা আমাকে নিজের অধিকার কেড়ে নিতে শিখিয়েছিল। শৈশব থেকেই খুব নিরীহ ছিলাম। অন্যেরা যা বলত তাই নির্বিচারে শুনতাম। দাদার সঙ্গে মার্বেল খেলায় জিতলে দাদা কখন ও কখন ও আমার প্রাপ্য মার্বেল দিতে চাইত না।উর্মিলা বলেছিল ওটা আমার প্রাপ্য-আজ খেল,কাল কী হবে? কল থেকে জল আনতে গেলে আমাকে ছোট বলে সবাই ‘দাঁড়াও মা’বলে নিজে এগিয়ে যেত। উর্মিলা আমাকে শিখিয়েছিল ‘ওটা অনিয়ম’।

উর্মিলা আমার শৈশবের নিরীহতাকে শক্তিশালী করেতুলেছিল।বাবা একদিন গিয়ে উর্মিলাকে রেখে এসেছিল। ওকে নিয়ে যাবার জন্য কোনোদিনই ওর মা আসত না।বোধহয় নিয়ে যেতে চাইত না। নাগিনীজানের কোনো এক বাগিচার একজন সামান্য মজদুরের মেয়ে আমাকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল।

এই সবুজগুলি বলতে পারবে কি উর্মিলা কোথায় আছে? সে কি এখন ও আগের মতো শক্তিশালী রয়েছে? পাতা তোলার জন্য আকুল হয়ে উঠা তারমিহি আংগুলগুলি সেই বাদামি রঙে্র নেলপালিশ কি এখন ও রয়েছে? আমার চারপাশে এক ঝাঁক প্রশ্ন এসে ভিড় করল। বাথরুমে ঢুকে আমি শাওয়ার খুলে দিই।

তুমি কাকে সমর্থন কর?

মানে?

মানে বাগানে এসেছ যখন,কিছু রাজনীতির কথা বলা যাক। তাতে আবার সুদূর দিল্লি থেকে এসেছ। কাকে সমর্থন কর-পুঁজিবাদ না মার্ক্সবাদ? ভবিষ্যতের বৌমাকে এই সমস্ত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হবে আমি কোনোদিন ভাবিনি। তবু বললাম-ব্যক্তিগতভাবে আমি মার্ক্সবাদের সমর্থক।কিন্তু প্রকৃ্ত সত্য হল আমরা পুঁজিবাদে জন্মেছি এবং অক্টোপাসের মতো আমাদের সবকিছু পুঁজিবাদের দখলে। এক অর্থে মালিকীস্বত্ব।

অনির্বাণ চৌধুরী আমার দিকে একদৃষ্টে তাকালেন। আসল কথা কি জান-রোমান্টিকতায় ডুবে থেক না। উদাহরণ নাও-আমাদের বাগিচার।পুরো ব্যবসাটাই পুঁজিবাদ-বাগিচা থেকে চা পাতা পর্যন্ত-কিন্তু লেবার লাইন-দ্য ব্লেক টাউন,দে আর নাথিং বাট এ রিফ্লেকশন অফ মার্ক্সবাদ।

আমি কিছুই বললাম না। খাবার টেবিলে গম্ভীর কথার আলোচনা দিয়ে কীভাবে ধীরে ধীরে খেতে হয় সেই কায়দায় আমি এখন ও অভ্যস্থ হয়ে উঠতে পারিনি।

-নব ঔপনিবেশতার ভেতরে কোনো বেঙ্গলী অথবা অসমিয়া ধনী ব্যবসায়ী বাগিচাগুলি কেনার জন্য ছিল না। মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীরা বাগিচার  স্টক কিনেছিল। তুমি ভেবে দেখ আমাদের নিজেদেরই সম্পদ কীভাবে বহিঃরাজ্যের মানুষেরা কিনে নিয়েছিল। কেন? পুঁজির অভাব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বার্মার ওপর দিয়ে হওয়া জাপানি আক্রমণের জন্য পূর্ব অসমের ইংরেজ ব্যবসায়ীরা বাড়ি ফিরেছিল। বাগানের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল আর্মি নতুবা অ্যারিস্টকেট পরিবারের লোকেদের হাতে। কিন্তু ১৯৬২ সনে সেই যে চিনা আক্রমন হল তারপর থেকেই ইউরোপিয়ান ষ্টকে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হল। ১৯৬৭ সন পর্যন্ত আশি শতাংশ এন্ড্রিও উলের ষ্টক ছিল ইউরোপিয়ানদের। ৫১ শতাংশ ষ্টক ভারতীয়দের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। কিন্তু ৪৯ শতাংশ ষ্টক ব্রিটিশ ব্যাঙ্কে থেকে গিয়েছিল। মারোয়ারিদের কাছে বিক্রি করতে চাওয়া ষ্টক শেষপর্যন্তা ভারত সরকার কিনে নেয়। এখন তার ত্রিশ শতাংশ শেয়ারই পাব্লিক শেয়ার হয়েছে।

তিনি আরও বললেন-একটা কথা জান কি,ব্রিটিশ এবং ডাচ কোম্পানি ব্রুক বণ্ড এবং লিপ্টন ভারতের চা রপ্তানি থেকে চারশ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করে-তার মধ্যে ষাট শতাংশই অসমের চা। তাই যতই মার্ক্মবাদ বা অন্যকিছু ইজম উত্থাপিত ওকে না কেন পুঁজি নাহলে ফ্যাক্টরি চলে না -ফ্যাক্টরি না চললে নতুন চা উৎপাদন হয় না-আর তখনই লেবার লাইনেও হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে।

পরিপক্ক ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিকের মতো অনির্বাণ চৌধুরী কথাগুলি বললেন। সফল ব্যবসায়ী হওয়ার মতো অনেক গুণই রয়েছে তাঁর। আসলে মানুষটা বাকপটু। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণটিই হল ক্ষণিকেরমধ্যে কথার যাদুতে মানুষকে মোহিত করতে পারেন।

উর্মিলার মতো মেয়েটি-ও না-রাধা আমার দিকে তাকিয়ে কেবল হাসল-সে যেন বুঝলে বলবে -ভাবী শ্বশুরের সামনে যুক্তিতর্কে অবতীর্ণ হয়ে আমি এই একটি মাত্র সুযোগ হারাতে চাই নি।আর কেবল সেইজন্যই চুপ করে আছি। যে পুঁজিবাদের তারিফে তিনি আমার সামনে অহঙ্কা্র করছেন,সেই পুঁজিবাদের ওপারে লুকিয়ে থাকা ক্ষমতালোভী ছবিটা আমি আগেই দেখেছি। তিনি কেন তা আড়াল করতে চাইছেন -সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমাদের নিজেদের সম্পদ কেনার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি কেন হয়েছিল? ইতিহাস সাক্ষী আছে।

তাড়াতাড়ি ফিরে আসব বলে বেরিয়ে যাওয়া অম্লান এলো না। প্রকাণ্ড বাংলোটার নীরব অহঙ্কারগুলি শুষে শুষে বৈঠকখানা ঘরের ঘড়িটিও অপেক্ষায় রইল।

সকালে যখন জেগে উঠলাম তখন এক অস্থির কোলাহল বাগিচার সবুজগুলিকে মুঠো করে ধরেছিল। রাধার মুখেও সেরকম এক অস্থিরতা ফুটে উঠল।

–কী হল ?

–ডাইনি বেরিয়েছে।

–কি ?

–ও ছোটবাবু সেখানে গিয়েছে। আপনাকে এখানেই থাকতে বলে গেছে।

মাথাটা আমার গরম হয়ে গেল অম্লানের ওপর এক ধরনের রাগ ও আমার মনে ঘনীভূত হয়ে উঠল। গতকাল থেকে একবার ও আমি ওকে ভালো করে কাছে পাই নি। বাড়ি ফেরার পরে মানুষটা কী আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব হয়ে গেছে।

ডাইনি ?সহজ-সরল,শরীরী মাংসে ভরপুর একজন মানুষ কখন ও ডাইনি হয়?কখন ও তার চোখ লেগে গলির কার ও বাড়িতে কোনো শিশুর মৃত্যু হয়েছে? কারও বাড়ির বৌ বিধবা হয়? কী যে অবাক কাণ্ড!এই পুরো ব্যাপারটায় একবার ও বাগিচার মালিক কথাবলে ন। নিরপেক্ষ হয়ে সুরক্ষিত স্থানে তিনি অপেক্ষা করেন।

–এটা তাদের সমাজ রক্ষার বাঁধন।এসবে কথা বলার অধিকার আমাদের নেই।

–মানে আপনাদের মতো শিক্ষিত ,বৈজ্ঞানিক চিন্তার মানুষ ও ডাইনিকে বিশ্বাস করে?

–প্রশ্ন বিশ্বাস অবিশ্বাসের নয়। প্রশ্ন তাদের চারসীমা। তাদের চারসীমায় তাঁরা স্বাধীন।

–কী আশ্চর্য ধরনের ব্যবসায়ী আপনি? আপনার বাগিচায় এরকম অধিকার ভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে-আপনার ছেলে তারই সন্ধানে সকাল থেকে বাড়িতে নেই-আর আপনি? আপনি চুপ।

–দেখ আমি ব্যবসায়ী—মানব অধিকার কর্মী নয়।আর তোমার এই সমস্ত নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভাল।

–ভালো মন্দের জ্ঞান আপনি যদি নিজের শ্রমিকদের শেখাতেন –তাহলে আজ এই ডাইনির নাম শুনতে হত না।

অনির্বান চৌধুরী আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। সেই চাহনির দ্বারা তিনি বলতে চাওয়া সবকয়টি সাবধানীই আমি শুনতে পেলাম।আভিজাত্য যে মানুষকে অনেক কিছু দেয় সেটাই কেবল সত্য নয়।আভিজাত্য মানুষের কাছ থেকে অনেক কিছু নিয়েও যায়।

সন্ধেবেলা বিধ্বস্ত হয়ে অম্লান বাংলোয় এসে পৌছাল।আমি তখন কাপড়্গুলি গুছিয়ে রাখতে শুরু করেছিলাম। সে আমার দিকে না তাকিয়েই বলল—‘ঐ ঘরটিতে মায়ের শরীরে আগুন ধরেছিল। বাবা বাঁচাতে যান নি। আমরা সবাই চিৎকার করছিলাম। মায়ের দিক থেকে কি ভুল হয়েছিল জান-মা ডাইনি বলে তাড়িয়ে দেওয়া একজন নারীকে মালীর কাজ দিয়েছিল।বাংলোতে প্রতি রাতেই কোলাহল বেড়ে চলছিল। আমরা দিন্দিন নীরব হয়ে পড়ছিলাম। মায়ের জ্বলন্ত শরীরটা আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মাকে বাঁচানো যেত। তার দুদিন আগে বাগিচার ওপারের খালে ডাইনি বলে তাড়িয়ে দেওয়া সেই নারীর ধর্ষিতা মৃতদেহ ভাসছিল।

মাঝে মাঝে এরকম মনে হয় কোথাও কাঁচা পাতার গন্ধের মধ্যে আরও একটি গন্ধ ভেসে বেড়ায়। কিসের আন? পাতা খাওয়া পোকা মারার জন্য ছড়িয়ে দেওয়া ওষুধের গন্ধ। মাঝে মধ্যে এরকম মনে হয় এই মানুষগুলি শিক্ষিত  হলেই সমস্ত কিছু বুঝতে পারবে। কিন্তু বাগিচার কারাগারে এই শিক্ষায় মুক্ত হয়ে থাকতে পারবে কি ওরা? মুক্ত হওয়ার জন্য অদৃশ্য কারাগারের বাইরে বাইরে যাওয়ার সাহস করতে হবে। পুঁজিবাদ কি ওদের সেই সাহস যোগাবে? পুঁজিবাদ শোষণ করে আর পুনরায় রসাল করে -তারপর আবার শোষণ করে। তুমিই বল মিতা, এই সবুজ বিস্তীর্ণতা দান করা জীবনের দাম কেবল কলঘরের ধোঁয়াগুলির ঘূর্ণীয়মান কুণ্ডলীর পাকেই আবদ্ধ নাকি? তুমি ওদের শ্বাস-প্রশ্বাস দেখেছ –ওদের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে ইচ্ছা করে না তোমার? না কি ভয় কর? কে জানে নিশ্বাসের নামে পুনরায় সেই পরাজয়,পুনরায় সেই স্বগতোক্তি,পুনরায় সেই সঙ্কোচনকে পাওয়া। প্রতিটি সঙ্কোচনের যে এক চিৎকার থাকে আর থাকে এক প্রতিবাদীর আভাস। তুমি কোন পথ নেবে? প্রতিবাদের না পলায়নের?

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 − 1 =