দুধ পিঠের গাছ: স্বপ্নপূরণের ইতিহাস

একটি সিনেমা বানাতে অর্থ যুগিয়েছেন গোটা গ্রামের মানুষ, ছবিটির শুটিং হয়েছে গোটা গ্রামজুড়েই। ছবিতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে অংশ নিয়েছেন গ্রামভর মানুষজন। নাহ, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমনটা আগে ঘটেছে বলে চলচ্চিত্রবিদেরা কেউ মনে করতে পারেননি। ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে বেশ কিছু কাজ এর আগে ভারতে হয়েছে। বাংলাও ব্যতিক্রম নয়। ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে বাংলায় খবরের কাগজ প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কিছু নাটক এবং চলচ্চিত্র ক্রাউড ফান্ডিং এর সাহায্যে তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে বাংলাতেই। কিন্তু গোটা গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে ছবি বানাচ্ছেন, বিশ্বের ইতিহাসেও এমন উদাহরণ অতি বিরল। ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে এমন ভাবে ছবি তৈরি করে ইতিহাসে নিজেদের নাম তুলে ফেলেছেন নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রামের মানুষজন। সিনেমা নিয়ে যারা খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছে উজ্জ্বল বসুর “দুধ পিঠের গাছ” ছবিটির নির্মান কাহিনী জানা বিষয়। কিন্তু সেই গ্রামবাসীদের অভিজ্ঞতা কেমন? কি ভেবে এমন একটা কাজে এগিয়ে এলেন প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষজন? দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলি কিসের ভরসায় তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগারের অর্থ একটা ছবি তৈরিতে লাগিয়ে দিলেন? এসব উত্তর দিতে পারেন খোদ আড়ংঘাটার মানুষেরাই। অবেক্ষণের পাঠকদের তাই নিজেদের অভিজ্ঞতা কথা জানাতে কলম ধরেছেন সেই গ্রামেরই মানুষ তথা এই ছবির অন্যতম প্রযোজক রাজীব মজুমদার।  

রাজীব মজুমদার, আড়ংঘাটা, নদীয়া ##

রাজীবের কলমে –

উজ্জ্বল বসু আমাদের গ্রামেরই ছেলে। ছোট থেকেই ওকে দেখেছি।  ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের একদিন উজ্জ্বলের সাথে কথা হয়। বলল দাদা একটা ছবি বানাবো গ্রামের মানুষের টাকায়। শুনে তো অবাক আমি, এমনও হতে পারে? উজ্জ্বলই বোঝাল কেমন করে তা সম্ভব। আমিও ভাবলাম নতুন কিছু একটা হবে, আমাদের গ্রামের ছোটরা অভিনয় করবে, এই গ্রামের নাম সকলে জানবে, ব্যাপারটা হলে মন্দ হয় না। তারপর থেকে শুরু। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ওর ট্রেনিং শুরু  হল। আমরাও শুরু করলাম মানুষের কাছে যাওয়া, বোঝানো।

পরিচালক উজ্জ্বল বসু এবং শিশু শিল্পীরা

চাঁদা তুলতে থাকলাম। কৃষক, রিকসাওয়ালা, চায়ের দোকানদার সকলেই এগিয়ে এলেন। শিক্ষক, সরকারি চাকুরিজীবী সব শুনে চাঁদা দিতে লাগলেন সকলেই। সাথে চলতে থাকল উজ্জ্বলের সাথে লোকেশন দেখতে যাওয়া বিভিন্ন জায়গায়। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তখন। আমাদের গ্রামের টাকায় ছবি হবে, আমিও একজন প্রযোজক হব এটার! তারপর কতদিন আমার বাড়িতে বসে আলোচনা চঞ্চল, কাজল, সজলদা সহ অনেকে মিলে।

 ধীরে ধীরে নভেম্বর মাস এল। হালকা শীত শীত ভাব। আমার ছোট স্কুটি নিয়ে দুজন যাচ্ছি একের পর এক মানুষের কাছে, চাঁদার জন্য। কেউ কেউ এমনও ছিলেন যারা প্রথমে  বিষয়টি গুরুত্বই দিলেন না। পরে আমাদের এত কর্মকাণ্ড দেখে উৎসাহিত হয়ে নিজেরাই ডেকে অনুদান দিলেন। বললেন “আড়ংঘাটায় ছবি তৈরি করছ, গ্রামের মানুষ প্রযোজক হবে, আমিও অংশগ্রহণ করলাম।” খবরের কাগজে এল আড়ংঘাটার নাম, ক্রাউড ফান্ডিং ছবির কথা। আমরাও যে যার কাজ ফেলে আরও দ্বিগুন উৎসাহে এগোতে লাগলাম। মানুষের সাড়াও চওড়া হতে লাগল। একদিন কলকাতা থেকে বরুনদা, শান্তুনুদা, সুদীপদা, সমরদা  এলেন আমাদের গ্রামে। ওদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গেলাম। ওরা সব দেখে আমাদের  ছবি তৈরি নিয়ে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলে গেলেন। কি কি করতে হবে। আমাদের বাড়ি বসে সেই সব আলোচনা চলল। ওরা ফিরবেন রাতের ট্রেনে কলকাতা। স্টেশনে গেলাম তুলতে। প্ল্যাটফর্মে বসে ভাবছি আর কয়েকদিন পর আমাদের গ্রামে ছবির শুটিং হবে। নিজের চোখে দেখবো। ওরা আমাদের স্বপ্নগুলোকে জাগিয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠে চলে গেলেন। একরাশ  প্রত্যাশা নিয়ে ফিরে এলাম  আমরা।

কয়েকদিন বাদে উজ্জ্বল আবার এল, বাচ্চাদের নিয়ে মাঠে বসল, ক্লাস নিল(এরকম মাসে দু থেকে তিনবার বসত)। তারপর সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়লাম কোনও একজন হয়তো সময় দিয়েছে দেখা করবার জন্য। তার কাছে গিয়ে কাজ মিটিয়ে ফিরলাম। এভাবেই  চলছিল, ডিসেম্বর মাসের ১৮ তারিখ সবাই এলেন কলকাতা থেকে। এবার শুটিং শুরু হবে।

 প্রথম দিন সাজো সাজো রব। ক্যামেরার সামনে আমি ফুল মালা নিয়ে, আমাদের ছবির কাজ শুরু হল। ১২ দিন মত চলল শুটিং। আমার তো নাওয়া খাওয়ার সময় নেই, ভোর বেলা ওঠা। ইউনিটের সবার খাবার ব্যবস্থা করা করতে হবে।  কোনও কোনও দিন  কেউ কেউ খাবার দিয়েছেন। কেউ আবার টিফিনের খরচ দিতেন। যখন যেমন দরকার পড়েছে, শুটিং এর জন্য নিজের জমি বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন সকলেই। গ্রাম জুড়ে আট থেকে আশির সে এক অনাস্বাদিত উৎসাহ। টানা ১৮ দিন ধরে চলল শুটিং এর কাজ।  

গ্রামেই চলছে শুটিং

এই সময় কালে এমন দুজন মানুষের সান্নিধ্যে এসেছিলাম যাদের সাথে দেখা করার ইচ্ছেটা বহুদিনের, অনির্বান মাইতি এবং শুভেন্দু মাইতি। যারা আমাদের এগিয়ে যেতে রসদ যুগিয়েছেন। এভাবেই শেষ হলো শুটিং। কিন্তু না, তারপর শুরু হল আসল লড়াই। ছবির শেষ কাজটা করতে হবে, এখনও অনেকগুলি টাকার দরকার, কলকাতায় উজ্জ্বলের পরিচিত কিছু মানুষ এগিয়ে এলেন। সর্বশেষে এগিয়ে এলেন বীরভূমের শ্যাম সখা দাদা। সকলের দেওয়া অর্থে ধীরে ধীরে তৈরি হল দুধ পিঠের গাছ। আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন।  

ছবির প্রিমিয়ার হচ্ছে আড়ংঘাটার মাঠে

যাই হোক মাঝে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর ছবি রিলিজ হবে ঠিক হল। এবং তার প্রিমিয়ার শো হবে আড়ংঘাটার মাটিতে। এ এক অনন্য অনুভূতির দিন।  সন্ধেবেলায় গ্রামের মাঠে শুরু হল ছবি। মাঠে অগণিত প্রযোজক বসে ছবি দেখছেন। ছবি শেষ হল।  কিছু ক্ষণ সব চুপ, তার পরই দর্শকের করতালিমুখর হয়ে উঠল আড়ংঘাটার বড় মাঠ। স্বপ্নপূরণের অজানা স্বাদ নিয়ে সবাই একে একে ফিরে যাচ্ছেন বাড়ির পথে। মুখে হাসি, চোখে জল, আনন্দের।  

 মাঠে তখনও অনির্বান মাইতি, উজ্জ্বল বসু, শান্তুনু বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র, চঞ্চল, সজলদা, অপু, গোবিন্দদা, সমরদা, আমি, কাজল সহ আরও অনেকেই দাঁড়িয়ে আছি। নিজেদের মধ্যে কথা বলছি, পরের দিন ২১ শে অক্টোবর  ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে কলকাতায়।  কি যে আনন্দ হচ্ছে আমাদের। শেষে ওরা ফিরে গেলেন রাতে। ওদের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে কলকাতার দিকে, মিলিয়ে যাচ্ছে গাড়ির আলো। কিন্তু মনে হচ্ছিল আরও একটা আলোর রেখা পূবের আকাশে উঠে আসছে।

One thought on “দুধ পিঠের গাছ: স্বপ্নপূরণের ইতিহাস

  • November 4, 2020 at 7:16 pm
    Permalink

    খুব ভালো লাগল জেনে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine − 1 =