নীল পর্দায় স্বপ্ন

                     সুমিত ভট্টাচার্য্য, উত্তরপাড়া, হুগলী ##

দুপুরের ভাতঘুমে স্বপ্ন দেখে ধড়ফড়িয়ে ওঠে। ঘুমের লেশটাও নেই এখন। দেওয়াল ঘড়িতে চারটে চল্লিশ। একটু মোতাঁত নিয়ে হাটা যেতেই পারে। মধ্যবিত্ত বেকারত্বটা ভেতর থেকে নাড়া দেয়। আলনায় টাঙানো জামা গলিয়েই চলল, পায়ে কিটো। মনের মধ্যে অনেক কথা চলে রোজ। একঘেঁয়ে চায়ের দোকান ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে অন্য একটা চায়ের দোকানে কাচের গ্লাসে চায়ের আমেজে উজান। মাসির-চা নামে গুমটিটা মন্দ না। সিগারেটও চলে তবে বিড়ির বিক্রি বেশি। রোজের একই রুটিন থেকে উজান হালকা হয়, তার মতো হদ্দ বেকার হালকা হতে পারলেও চা-মাসির সেই ফুরসত নেই। আবার হাটা, সন্ধ্যে গড়িয়ে চলেছে তখন। রাস্তার ডানদিকে দু-তিনটে কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রয়েছে। আরেকটু এগোলেই কয়েকটা বিরিয়ানির দোকান। খাবারের সুগন্ধেই পেটে ইঁদুর ছুটতে থাকে। বাইকে গুলতানি দিচ্ছে দু’দল আলাদাভাবে ফুটের দু’দিকে। ক্লাবের টিভিতে পুরনো খেলার হাইলাইটস সামনেই এক বড় ফ্লেক্সে ওয়ার্কশপের বিজ্ঞাপন। একটু থমকে দাঁড়ালো। একটা খুব প্রিয় বিষয় তার। খুঁটিয়ে পড়তে পড়তে কি একটা ভাবছিল, তাল কাটলো ডি.জে লাগানো এক গাড়ির চোটে।
   
                                      বেকার হলেও সে যে অকর্মণ্য এমনটা তো লেখা নেই কোথাও, কিন্তু প্রতিদিনের খবর শোনার মতো প্রতিবেশী  ঠিক তাকিয়ে থাকে। পুরনো একটা স্ক্রিপ্ট বের করে চোখ বোলাতে থাকে। হালফ্যাশানের ফোন নয় তার, সেই ছোট্ট ফোনে রিং হয়ে কেটে যায়। আবার রিং হতেই “হ্যালো”…… “আরে আরে ভাই সূর্য কোনদিন থেকে উঠলো?? কে ফোন করেছে….” ওপাশের কিছুক্ষণ কথার পর কোনা ভাঙা টেবিলে ফোনটা রাখলো। “মা কাল একটু সকাল সকাল বের হবো” মা একটু হাসি এনে “ইন্টার্ভিউতে যাচ্ছিস… ভালো করে দিস কিন্তু।” কিছু শোনার আগেই হাত খালি করে আশীর্বাদ করে দেয়। পৃথিবীর সব মায়েরাই এমন হয় বুঝি? মাত্র দুটো স্টেশনই তো যাবে। গন্তব্যে ঠিকানা চিনতে একটু সময় লাগে। “আরে উজান সেই কবে শেষ তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, খেয়ে এসেছিস? ”  অন্যমনস্ক হয়ে দেওয়ালের বইগুলো দেখছিল। বেশীরভাগ সেকেন্ডহ্যান্ড বই। কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে “ওরে ভাই আমার, পেটে কিছু দিয়েছিস?” চমক ভেঙে একটু যেন ইতস্তত ভ্যাবলা মেরে যায়… “হ্যা — না” লঝঝড়ে সিঙ্গল খাটের কোনায় পাঞ্জাবীটা জাস্ট গায়ে দিয়ে “নে অনেক হয়েছে, ফর্মালিটি তোর পকেটে রাখ, ওয়েট, কচুরি আনি” বলেই হাওয়া হয়ে গেলো। একটা কাচের কাপকেই অ্যাশট্রে বানিয়ে দিব্বি সুখটানে আছে মৈনাক, অ্যাশট্রের পাশেই তলস্তয়ের দ্য কোসাকের মাঝের দিকে একটা অংশে পেজমার্কিং এর মতো কিছু করা। পুরনো বইয়ের থেকে চার্লি চ্যাপলিনের বইটাই হাতে নিল। দুপাতা ওল্টাতে যেতেই আবার হুজ্জুতি হাজির ঘেমো গায়ে। “নে, জাস্ট গরম গরম খেয়ে বল নন্দ কচুরি কেমন।” প্রথম কামড় দিতে যাবার আগে বলে ওঠে “এত ব্যস্ত হতে হবে না মৈনাক, আচ্ছা তুই এখানে পেইং গেস্ট হয়ে আছিস কেন?”  এ প্রশ্নটা যে আসবে সেটাই এড়াতে চাইছিল। সামান্য ফ্যাকাসে হয়েও সামলে নেয়। “এই আছি নিজের মতো আর কি চাই!” খানিক সময় নিয়ে ” তারপর বল তোর থিয়েটারি চর্চা চলছে তো?” দুজনের মিল ঠিক এখানেই। “এক কাজ কর বাড়িতে বলে দে আজ এখানে থাকছিস, কাল বা পরশু ফিরবি।” বাহ এ ভারী আজব বললেই যেন হয়ে গেলো আর এভাবে হুট করে যে কল করবে সেও কি থোড়াই জানা ছিল! কিন্তুকিন্তু ভাব টা দেখে মৈনাক একচোট হেসে বলে “আরে আমাদের জামার সাইজ একই চল, আমারটা পরে দিব্বি চালিয়ে দিতে পারবি।” মান্ধাতা ফোন থেকে কাকে কল করে… “জলদি খা, দুপুরের খাবার কলকাতায়..” এবার বিষম খাওয়ার পালা উজানের। মাইরি পিসি সরকার এত ভেল্কি দেখায় না মৈনাক একের পর এক যা দিচ্ছে। তবে শেষতক মৈনাকই জিতল। “মীনার্ভা যাচ্ছি দুজনে”। কচুরি শেষ করে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে আর ভাবছে “মৈনাক পেগলেছে।” ট্রেনে সওয়ার। কোথায় এই মফস্বল আর কোথায় মীনার্ভা! উঠলো বাই তো কটক যাই সে দশাই আরকি। হালকা দুলুনি আর মনের ভেতর সেই নাটুকে মনটা খুঁচিয়ে উঠলো। শহরের ঠেলাগাড়ি, হইহল্লা, ব্যস্ততা এসব নিয়েও ঠিক পৌঁছে গেলো। মীনার্ভা মুখের কাছে বেশ কিছু গাড়ি পার্কিং করা। দেওয়ালের গায়ে হাত দিয়ে কেমন এক অদ্ভুত লেগে ওঠে, কতছর বাদে আবার এখানে! এভাবেই প্রেমিকার গালেও একদিন হাত দিয়েছিল। একটু এগিয়ে বড় চায়ের দোকানে ভাঁড় নিতে গিয়ে হঠাৎ “এই উজান দেখ ইনি মালিনীদি, আমার আগের দলের ডিরেক্টর।” সামনেই খানিক এগিয়ে কুমোরটুলি, এখন সিজিন নয় তবু কাঠামো এক-দুটো পড়ে আছে। থিয়েটারি মন জেগে উঠলো। নিজের স্ক্রিপ্টটা আনতে ভোলেনি উজান। মনদিয়ে শুরু হল স্ক্রিপ্ট শোনা। লেখা অনেকটা গড়াতেই ছিটকে উঠলো মৈনাক। দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে “বন্ধ কর, বন্ধ কর, আমি নিতে পারছি না। আমি নিতে পারছি না……” মাথা ঝুঁকিয়ে বসে পড়লো। বেশ খানিকক্ষণ বাদে হঠাৎ হাসিতে ফেটে পড়লো “কেমন অভিনয়ে ক্যাপা, আছে তো বস? “এহেন মৈনাককে দেখে দুজনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অন্য স্টেজের জন্যে দিন, সময় মালিনীদি’র সোর্সেই চটজলদি হয়। টিকিট বিক্রি থেকে প্রেস ডাকা সবেতেই মালিনীদি। 

                প্রথম দৃশ্য হালকা আলোয় ফুটছে রংমাখা উজান “আমাদের আশেপাশে তীব্র কান্না আর তুমি বিশ্বকে কাব্যি শোনাবে?” সময়তালে আলো আর চরিত্র আসা যাওয়া চলে। পর্বের শেষ দৃশ্যে মৈনাক-উজান মুখোমুখি। “তুমি নিজের পৃথিবী নিজের মতো ভাবতে চাও, বেশ্যাপল্লী গেছো? গিয়ে দেখে এসো কত মা কত বোন কাপড় তোলে, সায়াও খুলতে পারে না বাবুরা এসে কামড়াতে থাকে আগুপিছু সব, ছিড়ে..” দর্শকের দিকে আলো নিয়ে গর্জে ওঠা” দাঁড়াও, শুধু নিজের কথা বলে যাবে? কয় শব্দ পদ্য নিয়ে বাস করেছ হে প্রতিবাদী? বুকের ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে গেলে পদ্যের একেক শব্দ বেড়িয়ে আসে যদি সেই সহবাস না থাকে, জ্ঞান না দিয়ে বেওসা করো। কত বস্তি লাথি খেয়ে মাতালের চড় খেয়ে নিজেকে বাঁচাতে রাস্তায় নামে সেকথা তুমিই সবচেয়ে বেশি জানো। নিজেকে দিয়ে বিচার করো”। মুহুর্তে চারিদিক এলোমেলো ফ্যাকাসে ঝাপসা। শং সাজা এই শরীর প্রতি শব্দে পুড়ে যায়। অসংখ্য মুখ ভেসে ওঠে, বদ্ধ মাতাল এক নারীর শরীর টুকরো টুকরো করে খাচ্ছে। অন্তর্বাস মুখে তুলে নিচ্ছে বুকের মাংস খাবে বলে। তীব্র দহন অনেক অনেক হাততালি, কত প্রশংসা ঝাপসা চোখে একাঙ্ক নাটকের ড্রপসিন পড়ছে ওপাড়ে মালিনীদি অন্য চরিত্রে মুখে রঙ আর মনে হচ্ছে ঠিক সোনাগাছির প্রথম তলার পেট দেখানো বেশ্যা, অথচ ঝাপসা চোখের ভুলে মায়ের মুখ ফুটে উঠছে মৈনাকের। উজ্জ্বল আলোর সাথে আবহ মিলিয়ে অন্যসুর আর থামতে থাকা হাততালি, মাঝরাস্তায় কুকুর তার মড়া বাচ্চাকে মুখে তুলে নিয়ে যায় লোকে দেখে। হার-জিত প্রেমের চলে যাওয়া আর মালিনী দির চরিত্রে সেই সংলাপ “বেজন্মার কোন ব্যথা নেই,কষ্ট নেই, পাপ নেই আর..  তোমার কাব্যিও নেই বাবু, খাট ভাঙা যন্ত্রণার এই শরীর বাসি ফুল গো বাবু, বাসি ফুল। যা ময়লায় ফেলা যায় বা উত্তেজনার পৌরুষ ফেলা যায়,তার বেশি কিই গো বাবু হাহাহাহাহা…” মাথা নামতে থাকে আবহ সুর শেষের দিকে আর উজান সফল স্বামীর ভূমিকায়, অথচ অদ্ভুত ঠিক তার আগের রাতে প্রেমিকার সম্প্রদান হয়ে গেলো,এদিকে মঞ্চে সফল স্বামী হয়ে লোকের প্রশংসা।নিজের শ্রেষ্ঠ ব্যথা উজাড় করে মালিনী দি বেশ্যা সাজে মঞ্চের সব কোণ জুড়ে। প্রকৃত বেশ্যা ছাড়া এমন ফুটিয়ে তোলা অভিনয় কেই বা করতে পারে। হলের শেষ আলো নিভে গেলে পুড়ে যাওয়া সংদেহ নিয়ে ফেরা। বেহাত হয়ে যাওয়া মা-মালিনী থেকে সফল স্বামী বা কমরেড সব ঠিক হয় হাততালিতে। কে কতটা বেশ্যা সাজতে পারলো বা সফল স্বামী বা মিথ্যে মজুরনেতা। নিজেদের ছেলেবেলায় বিকেল বা রাত এত আলো ছিল যে তার উল্টো অন্ধকার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। খুব স্বাভাবিকভাবে হল থেকে বেড়িয়ে যাওয়া। উজান চাকরীর ইন্টার্ভিউয়ে এসেছে এত বড় মিথ্যেকে বাস্তব করতে কি করতে হয়েছে সেই জানে। মনে মনে একটা আন্দাজ ছিলই যে জীবন এরম একটা মোচড় দেবে। এমনকি রিহার্সালের জন্যেও খুব কম সময় মানে জাস্ট এক সপ্তাহ! কী করে এত মেকাপ দিল তা ও জানেনা, বাকি ভেতর জুড়ে অভিনেতা তাদের অস্ত্র শাণিয়ে গেলো! আবার লোকের ভিড়ে সব হারিয়ে যাচ্ছে। ঐতো ঐদিক দিয়েই কলকাতার আভিজাত্য থেকে বেশ্যাঘর পর্যন্ত চেনা যায়। “এক ব্যর্থ জীবনে এত সফল অভিনয়!” মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল উজানের। অন্ধকার আকাশের দিকে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ছলছল চোখে মৈনাক “দেখ আদতে তুই যা বা যেমনই হ, রাস্তার থেকে বাস্তব তুলে এনে যদি হাতে নিয়ে স্টেজ করিস তো অভিনয় ঠিকরে বেরবে। ঠিক বস্তি, মর্গ, কাঁচা খিস্তি বা লাটবেলাট এর মাঝরাতে বেলেল্লাপনা সবই জীবন রে উজান, জীবন..! আর চোখের সামনে এই জীবনের আগুন জ্বললে তুই কি বুকে বাঁধতে পারবি না?” ডানদিকে তাকিয়ে মৈনাক বলেই চলে “জীবন বমি করতে করতে শেষ লালা টুকু যখন নিংড়ে নেবে সেইটাও উজাড় করে দিতে হবে।” আবার খানিক চুপ নেরে ধোঁয়া টেনে “যত হাততালি পড়ে বুকের ভেতর কেমন একটা করে না! যেন কেউ পাড়িয়ে চলে গেলো! “সিগারেট ফিল্টারের কাছাকাছি এসে গেছে উজান মালিনীদি দুজনের চোখে চোখ রেখে ফ্যাকাসে গলায় মৈনাক বলে চলে “যাঁরা হাততালি দেয় সেইসব দর্শকের চেয়ে যে হাততালি দেয় না তাঁর ডুবসাঁতার অনেক বেশি, সেই নাটকের ওজন বুকে চেপে একহাত কান্না নিয়ে বেরয়,যার হাতে কান্না বসে যায় হাততালি দেবে সে কোন অজুহাতে?” একটা তিনচাকার মোটরভ্যান চলে গেলো হুশ করে। চারিদিকে কমবেশি আওয়াজ। হলের বন্ধ টিকিট কাউন্টারের গায়ে হাত দিয়ে বন্ধ হতে থাকা দোকানের দিকে চোখ রেখে উজানের বলে ওঠা “নাই বা পেলাম মীনার্ভা স্টেজ হল তো বটে! আজ কতজন এখান থেকেই টিকিট কিনেছে।” হ্যালোজিনের তিরতির করে জ্বলতে থাকা পোস্টের দিকে চেয়ে মালিনীদি বলে “শোনো গিরিশ মীনার্ভা নজরুল তপন তাতে যায় আসে না উজান, সব হলের সব মঞ্চেই অভিনেতার বুকের উজাড় করা রক্ত বমি না খেতে পাওয়া দেহবেচা বা এলিট হয়ে ওঠা লেগে আছে। নি:সঙ্গ সম্রাট পড়েছ শিশির ভাদুড়িকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা? পড়োনি তো? পড়ে দেখো আমাদের নিশ্বাসে প্রশ্বাসে কত ক্ষয়ে যাওয়া মিশে থাকে। সিগারেটের ফিল্টার ফেলার সাথে মৈনাক বলে ওঠে “আবার শোয়ের জন্যে তৈরি হই সকলে। এবারে হাতে সময় থাকবে আর দলে কিছু নতুন সদস্য আসবে। অন্য এক সংসারের মতো। এই উজান তুই কেরানিগিরির চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছিস না? কাকিমাকে বলে দে স্বপ্ন দেখার চাকরীটা তুই পেয়ে গেছিস’’।

2 thoughts on “নীল পর্দায় স্বপ্ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twenty − one =