পার্বণ-সংবাদ
শ্যামলী গুহরায়
একটা অদ্ভুতুড়ে ব্যাখ্যা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা প্রকাশ না
করে থাকতে পারছি না। তবে নিশ্চিত জানি আমার সাথে অনেকেই সহমত হবেন না। না হলেও
প্রকাশে কার্পণ্য করা যাবে না, কারণ জানি রাজনীতি ছাড়া মত প্রকাশে বিশেষ কোন
বাধা আসবে না। যাই হোক, এবার আসল কথায় আসি–
আমার
বর্তমান অবস্থান কানাডা দেশে কন্যা-জামাতা আলয়ে। তাই কন্যার বিবাহের সপ্তম বর্ষে
এসে এই প্রথম ‘জামাই ষষ্ঠী’ নামক বিশেষ পার্বণটি পালন করার সুযোগ পাওয়া
যাচ্ছে। ছোটবেলায় বেশ কিছু বছর যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। আমাদের বাপের বাড়িতে এই
পার্বণটি বেশ বড় করে অনুষ্ঠিত হত। জামাইরা ছাড়াও বাড়ির পুত্র কন্যারা সকলেই নতুন
বস্ত্র পরিধান করত। সে এক দারুণ আনন্দানুষ্ঠান। আমার সেজ জেঠিমা সকাল
থেকে আমাদের সকল ভাই বোনেদের গায়ে দূর্বা বাঁশের কড়ুল, ধান, ফুল, করমচা দিয়ে বাঁধা মুঠো দিয়ে শান্তি জল ও
পাখার বাতাস করে ষষ্ঠী পুজো করতেন। সেদিন ভাইবোনেরা সকলেই একটু বিশেষ মনোযোগের
কেন্দ্রে থাকতাম।এই সব ব্যাপারের জন্যই হয়ত কখনো জামাই ষষ্ঠী বিষয়টিকে নিয়ে কোন
নেতিবাচক ভাবনা আসেনি। প্রায় প্রৌঢ়ত্বে এসে এই অনুষ্ঠান ঘিরে নানা মুনির নানা মত
অভিজ্ঞতায় সংযোজিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমগুলিতে এই অনুষ্ঠান সম্বন্ধে বহু বিরাগ
মিশ্রিত অভিমতও দর্শিত হচ্ছে। নারীবাদ-পুরুষবাদ নামক বিতর্কিত আলোচনাও জুড়ে যাচ্ছে
ষষ্ঠী পুজোর অঙ্গে।
কিন্তু
আমার হঠাৎই একটু অন্যরকম চিন্তা হচ্ছে। অনেকেই আজকাল বলেন, জামাই ষষ্ঠী হলে মেয়ে ষষ্ঠী হবে না কেন? মেয়েরা যে সমাজে
অবহেলিত তার প্রমাণ হল এ-জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে মেয়েদের কোন প্রাধান্যই দেওয়া হয়
না। ঠিক কবে বাঙালিদের মধ্যে জামাই ষষ্ঠী ব্যাপারটির প্রচলন হয়েছিল, তা আমার জানা নেই। তবে
ধারণা থেকে বলতে পারি মাতৃদেবীর পূজার কারণেই ষষ্ঠী দেবীর পূজার প্রচলন হয়। মা
ষষ্ঠীর পুজো করার আসল কারণ সন্তান প্রাপ্তির আশা। কেউ কেউ বলেছেন শাস্ত্র মতে
ষষ্ঠী পূজার এই অনুষ্ঠানটি জামাই বাবাজীরা হাইজ্যাক করে নিয়েছেন, আসলে এটি মেয়েদেরই
অনুষ্ঠান। ঠিক এই জায়গাটিতেই আমারও সহমত হতে ইচ্ছে করছে। প্রাচীন বঙ্গে মেয়েরা
পর্দানসীন ছিলেন। একা একা তারা কোথাও যেতেনও না বা যেতে পারতেনও না। তাই অবশ্যই
স্বামীর সাহচর্য দরকার হতো। মেয়ের সন্তান কামনায় মায়েরা ষষ্ঠী দেবীর পূজা করতেন। মেয়েকে
কাছে পাওয়ার জন্য জামাইকেও আদর আপ্যায়ন করা হত। বাংলায় একটা প্রবাদ
আছে, ‘যম, জামাই, ভাগনা তিন নয় আপনা’, অর্থাৎ এরা কেউই
নিজের বংশ ছাড়া অপর কাউকে যত্ন করবে না। যম তো স্বতন্ত্রই। তবে নিজের মেয়ের যত্ন-আত্তির
বিষয়টাকে পাকা করে নেওয়ার জন্যই এই জামাই আদরের আয়োজন। তাহলে জামাই ষষ্ঠীর
কেন্দ্রে যার আদর সে কিন্তু আসলে কন্যাই। তাই আমার মনে হয় মেয়ে ষষ্ঠীর এই মূল
বিষয়টাকে মাথায় রাখলে মেয়েদের জন্য অকারণ দুঃখবোধ কমে যাবে।
এই
প্রসঙ্গে আরও একটা পার্বণের কথাও মনে এলো–ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরেও
নানা নেতিবাচক মনোভাব অনেকেই পোষণ করেন। চূড়ান্ত নারীবাদী যাঁরা তারা বলেন, ‘ভাই-ফোঁটা হলে ‘বোন- ফোঁটা’ কেন হবে না?
অনেক জায়গায় আজকাল ‘বোন-ফোঁটা’ চালুও
হয়ে গেছে। শাস্ত্র মতে ভ্রাতা ভগ্নীর রক্ষাকর্তা। যমের দুয়ারে কাঁটা দিয়ে ভাইয়ের
দীর্ঘায়ু কামনা করার মধ্যে আসলে কিন্তু নিজের নিরাপত্তাকে শক্ত করা। এই পার্বণটিরও
দীর্ঘ ইতিহাস আছে। যম তাঁর বোন যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়ে অমর হয়েছিলেন। কৃষ্ণ ও
নরকাসুর নামের দৈত্যকে বধ করতে যাওয়ার আগে সুভদ্রার হাতে ফোঁটা নিয়ে যান। এই সব
পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, নারীর রক্ষক হিসেবে তার ভ্রাতার একটি
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। সেক্ষেত্রে ভ্রাতার মঙ্গল কামনা মেয়েদের জন্য একসময়
যথেষ্ট প্রয়োজনীয় বলেই মনে করা হতো। আজকালকার চিন্তাধারা বা জীবনযাত্রার
পরিপ্রেক্ষিতে এই পার্বণগুলি সংঘটিত হয় না। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা পদ্ধতিকেই বহন
করে নিয়ে চলা হচ্ছে। আর এই অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে পরিবারে যে একটি শুভ ও পবিত্র
আবহের সৃষ্টি হয় তা নিশ্চয় সকলেই মানবেন। বিশেষ করে ক্রমশ যৌথ পরিবার থেকে
বিচ্ছিন্নতার ফলে যে একক পরিবারের সৃষ্টি তাতে পারিবারিক সদস্যদের
মধ্যে
সম্পর্কের উষ্ণতা নিমজ্জমান। বরং এই অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে পরিবারের সকলের মধ্যে
যে উষ্ণ আবেগ বা প্রেম সঞ্চারিত হয় তা নিঃসন্দেহে গ্রহণীয়।
মূল কথা
আমি যা বলতে চাইছিলাম সেটা হলো–জামাই ষষ্ঠী বা ভাইফোঁটা জাতীয় পার্বণগুলিতে
মেয়েদের অবহেলা ও অপমান করে দূরে ঠেলে দেওয়ার ভাবনাটা ভ্রান্তিমূলক কারণ কেন্দ্রে
কিন্তু মেয়েদের নিরাপত্তাই সূচিত হচ্ছে। দিন বদলেছে, মেয়েদের পারিবারিক বা সামাজিক অবস্থানও
নিঃসন্দেহে বদলেছে কিন্তু সে পরিপ্রেক্ষিতে তো অনুষ্ঠান বা পার্বণগুলি নির্ণিত
হয়নি এটা তো প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা একটা ধারারই পুনঃপ্রবর্তন। প্রসঙ্গত
রাখীবন্ধন অনুষ্ঠানটিও উল্লেখযোগ্য। নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে সুন্দর ও
সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যেই এই পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলির আয়োজন বলে আমার মনে হয়, (সম্পর্কে সেখানে
দাম্পত্য বা ভ্রাতৃত্ব যাই হোক না কেন)। উদ্দেশ্যটা সৎই ছিল, এখন যেহেতু সেখানে কিছু পাঁক এসে জমা হয়েছে
তাই মানুষের মনেও নেতিবাচক চিন্তার আগমন ঘটেছে। তবে এই সূত্রে আরও কিছু কথা মনে
হচ্ছে, তা হলো— প্রাচীন পার্বণগুলি তাদের ঐতিহ্য বা
ধারা বজায় রাখার জন্য পরিবর্তিত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক অবস্থায়ও স্বকীয়তা
রক্ষার চেষ্টা করে চলেছে। এ যুগে বাবা মা বা শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে মেয়ে জামাই বা
পুত্র পুত্রবধূদের যোগাযোগের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে, দূরত্ব কমে গেছে। উপর্যুপরি কন্যা বা পুত্রের
অবস্থানগত পরিবর্তনও অনেক হয়েছে। তাই এই পার্বণ বা অনুষ্ঠানগুলিকে ছুতো করে
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কের মাধুর্য গড়ে তোলাই মূল উদ্দেশ্য। এখন মেয়েরা আর
পর্দানসীন বা অবলা নয়। ভাইরা এখন আর বোনেদের রক্ষাকর্তা রূপে চিহ্নিত নয়। বরং অনেক
ক্ষেত্রেই বিষয়টা উল্টে গেছে। সর্বক্ষেত্রে স্বামীরা এখন আর স্ত্রীদের ভরণপোষণ বা
সন্ততি জন্মানোর ব্যাপারে একছত্র অভিমত গ্রহণকারীও নয়। তাহলে সময় বদলানোর সঙ্গে
সঙ্গে পার্বণগুলিকেও একটু উল্টে পাল্টে নিলে বা কন্যাদের অবস্থানকে গুরুত্ব দিলে
মন্দ কি? তাই ছেলের বাড়িতেও যদি শ্বশুর শাশুড়িরা বৌমা ষষ্ঠীর
আয়োজন করেন আর ভাইরাও যদি বোনেদের হাতে রাখী পরান তাহলে মনে হয় অনুষ্ঠানের ছুতো
নিয়ে পরিবারের সদস্যরা আরো কাছাকাছি আসতে পারেন। আর পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যে
অভিমানী কন্যারাও নিজেদের মূল্যবোধ সম্বন্ধে সচেতন হতে পারে। পুরুষবাদ-নারীবাদ
নিয়ে বিতর্কের কিছু কিছু সমাধান এই আনুষ্ঠানিক পর্বের হাত ধরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত
হতে পারে বলে আমার ধারণা।
Eto sundor bhabe likhecho ..er pichone anek ananlysis ache bojha jache. Amar khub bhalo laglo. Asha kori tomar ei lekha ta sabar kache pouchabe.