বিদায়

মোনালিসা পাহাড়ী, দাঁতন, পশ্চিম মেদিনীপুর

 

নিঝুম রাতের জমাট আঁধারে ব‍্যালকনিতে চুপচাপ বসে আছেন সৌমাল‍্য বাসু। প্রায়শই এভাবে বসেন। তবে আজ যেন মনটা অন‍্যান‍্য দিনের থেকে একটু বেশি উতলা। আই.এ.এস অফিসারের দায়িত্ব নিখুঁত ভাবে সামলে উঠতেই দিন কাবার। জীবনের ওঠানামা নিয়ে একাকী আলোচনা করার মতো একমাত্র এই রাতটুকুই সম্বল। চোখের পাতায় অজস্র স্মৃতির ভিড়। ছয় বছর আগের সেই দিনটাকে আজও যেন চোখ বুজলেই ছুঁতে পারেন।

 

এম.এ পাশ করে বি.এড করেছেন সদ‍্য। জোরকদমে পড়াশোনা ও করছেন। মনের মধ্যে রঙিন স্বপ্নের উপচে পড়া ভিড় রিমিতাকে নিয়ে। রিমিতা তাঁর সহপাঠী। এম.এ , বি.এড একসঙ্গেই করেছে। বড় বাড়ির মেয়ে। শহুরে আভিজাত‍্য‍তে মানুষ। তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনোর সময় প্রায়  দু বছর ধরে চেষ্টা করেছিল সৌমাল্যর সঙ্গে আলাপ করার জন্য। সৌমাল্যকে বন্ধুরা সমু বলে ডাকে। সমু গ্রামের ছেলে হলেও পড়াশুনাতে তুখোড়। ভালো গান গায়, আর খুব ভালো নাটক করে। নাটকটাকে সমু প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। পড়াশুনো চলাকালীন একটা ভালো নাট্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিল। নিয়মিত নাটক করত। হাততালি ও পেত। ভেবেছিল কোনোরকম এসএসসি বা সেট পরীক্ষায় পাশ করে একটা চাকরি পেয়ে গেলে অভিনয়টা নিয়ে একটু সিরিয়াস হবে।

 

বি. এড পড়াকালীন রিমিতা সমুকে প্রায় বলতো নাটক ছেড়ে শুধু মাত্র চাকরি পাওয়ার জন্যে পড়াশুনো করতে। সমু বলত ‘চাকরি আমি ঠিক পাবো। এত ভালো করে প্রিপারেশন নিচ্ছি। চাকরি ঠিকই পেয়ে যাবো, তুমি দেখো ।’

রিমিতা বলতো-‘বাড়িতে কিন্তু আমাকে বিয়ের জন্য খুব জোর দিচ্ছে। প্রফেসররা আমার বাড়ির সামনে লাইন দিচ্ছে রোজ রোজ। ‘

 

বি.এড শেষ হতেই একটা এস এস সি পরীক্ষা হলো। সমুর পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছিল। রিটিনে পাশ করে ইন্টারভিউতে ডাক পেল। জোরকদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে। একদিন এক ভদ্রলোক বাড়ি এসে বল্লেন-‘তোমার রেজাল্ট তো খুব ভালো।কিন্তু জানোই তো  আজকাল টাকা না দিলে চাকরি পাওয়া যায় না।তাই বলছি তুমি মাত্র দু’লাখ টাকা দিয়ে দাও। দিলেই চাকরি বাঁধা। না দিলে কিন্তু বাবা কোনরকম ভাবেই চাকরিটা তুমি পাবে না।’

সমু মনে মনে খুব রেগে গেল। ভাবলো চাকরি হলে এমনি হবে, না হলে পয়সা দিয়ে চাকরি করবো না।

সমু যখন মাত্র দু’বছরের তখন বাবা মারা যান। বাবার চাকরিটা মা পেয়েছিলেন বলে কোনরকমে সংসারটা টিকে গেছে।কয়েক বছর হলো মা রিটায়ার্ড হয়ে গেছেন। পেনশনের টাকা আর সমুর টিউশনের টাকা দিয়ে সমু্র পড়াশোনা চলেছে। এখন সে দু’লক্ষ টাকা পাবেটাই বা কোথায়!

 

ভাইভাও আশানুরূপ হলো। মনে মনে ভাবলো টাকা না দিলেও চাকরিটা সে পাবেই। এদিকে রিমিতা বারবার চাপ দিয়েছিল তার বাবার কাছ থেকে টাকাটা ধার করে লোকটিকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সমু কিছুতেই রাজি হয়নি। তাই রিমিতা রেগে বলেছে ‘চাকরিটা না পেলে কিন্তু আমার হাতে আর কিছুই করার থাকবে না। বাড়ির মতে বিয়েটা কিন্তু আমি আর আটকাতে পারবো না। ‘

সমু হেসে বলেছে-‘তুমি যদি আমায় সত্যিকারের ভালোবাসো তাহলে কখনোই আমায় ছেড়ে চলে যেতে পারবে না।’

অবশেষে রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল সমুর চাকরিটা হয়নি। অবসাদ সমুকে ঘিরে ধরলো। এদিকে বাড়ির পছন্দ করা পাত্রকে রিমিতা বিয়ে করে নিল।সমুর এমন অবস্থা চোখের সামনে দেখে হঠাৎ একদিন মাও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সে সব দিনের কথা আজও মনে পড়লে সমুর হাত পা কাঁপতে থাকে।অনেক কষ্ট করে মাকে সারিয়ে তুললো। দাঁতে দাঁত চেপে জীবনের সব অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করতে শুরু করলো।

প্রায় বছর দুএক লড়াই করার পর আই.এ.এস পরীক্ষায় কোয়ালিফাই ক‍রলো। মা অনেকবার বিয়ের কথা বলেছেন। কিন্তু বিয়ের ব‍্যপারে কেমন যেন একটা শূন্যতা গ্রাস করে রেখেছে তাকে। মাকে সে বলেছে এখন সে বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। আসলে রিমিতাকে সে এখনও ভুলে যেতে পারেনি। ভুলতে পারেনি তার প্রত‍্যাখ‍্যান।

নিঝুম রাতে একাকী এই ব‍্যালকনিতে তারাদের দিকে তাকিয়ে তার রাত কেটে যায়।

কিন্তু আজকে মনের ঝড় বেড়েছে কারণ আজ হঠাৎই রিমিতা হাজির তার অফিসে। উস্কোখুস্কো চেহারা। বেশ রোগা হয়ে গেছে। কোলে ফুটফুটে একটি মেয়ে বছর দেড়েকের। সমুকে দেখেই তার হাতটা ধরে ক্ষমা চাইতে থাকে বারবার। সমু অপ্রস্তুত হয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়। রিমিতা জানায় বরের সঙ্গে তার কোনো দিনই মনের মিল হয়নি। সে আসলে সব দিনই মনে মনে সমুকে ভালোবেসে এসেছে। তাই বরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। অনিচ্ছাকৃত ভুলে এই ছোট্ট মেয়েটি পৃথিবীতে চলে এসেছে। এখন সে শুধুমাত্র সমুকে বিয়ে করতে চায়। সমু না চাইলে সে তার সন্তানকে নতুন সংসারে নিয়ে আসবে না। বাবা মায়ের কাছে রেখে আসবে।

সমু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই রিমিতাকে সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো! এমন স্বার্থপর মেয়ের জন্য সে আজ পর্যন্ত মনের মধ্যে ভালোবাসার কুঁড়েঘর সাজিয়ে রেখেছে! মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিল সে। নিজের সুখের জন্য নিজের সন্তানকেও জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলতে চায়! আর রিমিতাকে জানালো সে অন্য একজনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু রিমিতা কিছুতেই মানবার মেয়ে নয়। সে সবকিছু ভালোভাবে খোঁজ খবর নিয়েই এসেছে। অনেক বোঝানোর পর শেষ পর্যন্ত তীব্র ধমকে তাকে ফেরত পাঠালো।

আজ এই ঘুম না আসা রাতে মনের মধ্যে তীব্র ঝড় আর দুচোখে অঝোর বন‍্যায় চিরদিনের মতো রিমিতাকে বিদায় দিল সে। মনে মনে ভাবলো মাকে পরের দিনই মেয়ে দেখার কথা বলবে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − six =