বিশিন্দায় বিশ্রাম

পলাশ মুখোপাধ্যায় ##

গুরুজনেরা বলেন সবুজ রং নাকি চোখের আরাম দেয়, সবুজ দেখা নাকি চোখের পক্ষে উপকারী। পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হল আমি যেন সবুজ মহাসাগরের মাঝে। যে দিকে চোখ যায় সে দিকেই বিভিন্ন ধরণের সবুজের সুনামি যেন। এক কথায় মুগ্ধ আমি, এত সুন্দর, এত নিরিবিলি, এত নির্জন একটা জায়গা এভাবে লুকিয়ে আছে জেনে একই সঙ্গে রোমাঞ্চিতও।

বাঁকুড়ার পাহাড় বলতেই আমাদের চোখে ভাসে শুশুনিয়ার নাম, তারপরে বিহারীনাথ। কিন্তু তারা তো বিশাল, বিরাট। আমি আজ যে পাহাড়ের কথা বলব এদের তুলনায় সে বড়ই ছোট, শিশু একেবারে। কিন্তু শিশুই যে আমাদের কাছে বড় আদরের, বড় ভালবাসার, বড় প্রিয় সে কথা অনস্বীকার্য। তাই দূর থেকে বিশিন্দা পাহাড়কে দেখে বড় ভাল লেগে গেল। সবুজ ধানের ক্ষেত, সবুজ শালের বন, তার মাঝে দাঁড়িয়ে ছোট্ট এই পাহাড়, সেও সবুজ।

বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাঁটি ব্লকে অবস্থান এই কচি পাহাড়টির। উচ্চতা? মেরে কেটে দু আড়াশো ফুট। কিন্তু তাতে কি? নিরিবিলিতে যাদের রুচি, তাদের জন্য এ এক স্বর্গ। গঙ্গাজলঘাঁটি বাজার থেকে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে লক্ষণপুরের দিকে। সেই পথ ধরে প্রায় দশ কিলোমিটার ভিতরে গেলে রাজামেলা গ্রাম পেরিয়ে বিশিন্দা পাহাড়ের দেখা মিলবে। মূল রাস্তা ছেড়ে আরও এক কিলোমিটার ভিতরে পাহাড়। সবুজ গাছের ছায়ার ভিতর দিয়ে কংক্রিটের বাঁধানো পথ, সোজা চলে গিয়েছে পাহাড়ের নিচে পর্যন্ত। পৌঁছে দেখা যায় পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি।

সিঁড়ি দেখে অবশ্য আমি কিঞ্চিৎ দমে গেলাম। পাহাড়ে ওঠার জন্য পাথুরে জঙ্গল পথই আমার পছন্দ। সিঁড়ি সেই পাহাড়ের ওঠার উপলব্ধিটাকে আনতে দেয় না বলেই আমার ব্যক্তিগত মত। আসলে এই পাহাড়ে মা নাচনচণ্ডীর বাস। তার মন্দিরও রয়েছে পাহাড়ের গায়ে। তাই অনেকেই এই পাহাড়কে নাচনচণ্ডী পাহাড়ও বলেন। সেই মন্দির পর্যন্ত সিঁড়ি। অবশ্য বয়স্কদের এতে সুবিধাই হবে। ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠতে পারবেন তারা।

খানিকটা উঠেই দেখা গেল দেবতাদের সহাবস্থান। একই সঙ্গে মা নাচনচণ্ডীর পাশাপাশি শিব, হনুমান প্রভৃতি বিভিন্ন দেবতার বাস। নাচনচণ্ডীর আলাদা মন্দির সেভাবে নেই। মা নাকি মুক্ত থাকতেই পছন্দ করেন তাই একটি গাছের নিচে মুক্তস্থানেই চলে মায়ের পুজো। এই জায়গাটিতে অনেকটা সমতল। সেখানে ভক্তদের জন্য বসার ব্যবস্থাও রয়েছে দেখলাম। পাহাড়েই থাকেন মায়ের পূজারী সন্ন্যাসীবাবা। কিন্তু আমার যে অন্য পাহাড় দেখার ইচ্ছে… সে কথা প্রকাশ করতেই পুজারী দেখিয়ে দিলেন পাহাড়ের উপরে ওঠার পায়ে চলা পথ। সেই পথে সিঁড়ি নেই, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গাছ গাছালির পাশ দিয়ে পাথরের ধাপ বেয়ে উঠতে হয়।

এবারে ভাল লাগার পালা। সেই পথ দিয়ে খানিকটা উঠতেই পাহাড় চূড়ায়। চুড়াটিও সামান্য সমতল। সেখান থেকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে দেখা যায় দশ দিক। উঠেই জুড়িয়ে গেল প্রাণ। অনভ্যস্ত পায়ে পাহাড়ে ওঠার ক্লান্তি জুড়ালো সুশীতল হাওয়ায়। আর মনের ক্লান্তি জুড়ালো সামনের দৃশ্যপট। এত সবুজ আর আগে দেখেছি কিনা মনে পড়ছে না। যতদূর চোখ যায় শুধুই সবুজ। সেই সবুজের আবার বিভিন্ন ধরণ। শালের জঙ্গলের এক রকমের গাড় সবুজ, আবার দিগন্তজোড়া ধানক্ষেতের উজ্জ্বল হালকা সবুজ। মাঝে বর্ষা সিক্ত বিভিন্ন গাছপালার ঝকঝকে সবুজ। সব মিলিয়ে সবুজে সবুজ।

একটা বড় পাথরের উপরে বসেছিলাম আমি। সঙ্গে ছিল আমার ছেলে, আমাদের দুজনেরই কি যে ভাল লাগছিল তা ভাষায় প্রকাশ করতে অপারগ। বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকার পর মনে হল এবার মায়া কাটাতেই হবে। সে বড় কঠিন কাজ, বিশিন্দা পাহাড় আমায় বড় ভালবাসায় বেঁধে ফেলেছে এইটুকু সময়েই। কি আর করা ধীরে ধীরে নেমে এলাম নিচে। পাহাড়ের নিচে সম্প্রতি থাকার জন্য দুটি কটেজ বানিয়েছে স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতি। খুব ভাল ব্যবস্থা সে কথা এখনই বলা যাবে না, তবে নতুন তাই পরিচ্ছন্ন এখনও, পাশাপাশি জায়গার গুণেও এখানে থাকার লোভটা সামলানো কঠিন। যারা নিরিবিলি নির্জনে সবুজের আবহে শুধু পাখির ডাককে সঙ্গী করে থাকতে চান বিশিন্দা পাহাড় তাদের জন্য উত্তম জায়গা। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও গেস্টহাউজ কর্তৃপক্ষ করে দেবেন। আমি যখন গিয়েছি তখন অবশ্য এটি চালু হয়নি। তবে সেপ্টেম্বর থেকেই এখানে থাকার সুবিধা মিলবে।

এবারে আসি যাওয়ার কথায়, কলকাতা বা অন্যত্র থেকে বিভিন্ন ভাবেই পৌঁছানো যায় বিশিন্দায়। বাঁকুড়া শহরে পৌঁছে সেখান থেকে বাসে গঙ্গাজলঘাঁটিতে নেমে সেখান থেকে বাস বা ট্রেকারে বিশিন্দা পৌঁছানো যায়। এছাড়া দুর্গাপুর বা রানিগঞ্জ থেকেও একই ভাবে গঙ্গাজলঘাঁটি গিয়ে যাওয়া যেতে পারে। একদিনে গিয়েও ঘুরে আসা যায়। তবে বিশিন্দার আশেপাশে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, সেটা গঙ্গাজলঘাঁটিতেই সারতে হবে। বিশিন্দা থেকে শুশুনিয়ার দূরত্ব খুব বেশি নয় তাই সেটাও চাইলে ঘুরে আসতে পারেন।

One thought on “বিশিন্দায় বিশ্রাম

  • September 1, 2020 at 6:51 am
    Permalink

    মানস ভ্রমণ উপভোগ করলাম।আপনার এই লেখার কল‍্যানে ‘নাচনচন্ডী’ দেবীর নাম জেনে খুব আনন্দ পেয়েছি।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eighteen − one =