মিষ্টি মধুর যোগমায়া

পলাশ মুখোপাধ্যায় ##

আকাশের চাঁদটার আজ ভরা যৌবন। সরোবরের জলে তারই পূর্ণ প্রতিবিম্ব। মায়াবী জ্যোৎস্না আলগা আদরে লেপ্টে আছে চারপাশ। নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ আবহে একা পথিক আমি। সরোবরের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক অসহ্য ভাললাগায় ছটফট করে উঠল মন। চাদরের তলা থেকে হাত বার করতেই ছোবল খেলাম। শীতের। কোনও রকমে পকেটে থাকা মোবাইল বার করে দেখি সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাতে কি? এমন রাত সচরাচর তো আসে না। চাদরটা কানের পাশ দিয়ে টেনে এগিয়ে গেলাম সোনাঝুরির বনের মাঝ বরাবর পিচ রাস্তা ধরে। বলা বাহুল্য জনমনিষ্যি নেই। নেই কোনও অবাঞ্ছিত আওয়াজ, অনভিপ্রেত উপস্থিতি। আমার সঙ্গে এখন শুধুই আমি। জল জঙ্গলের মাঝে বিভোর হয়ে সেই জ্যোৎস্না রাতে কতক্ষণ হেঁটেছিলাম খেয়াল নেই। ঘোর ভাঙল মোবাইলের শব্দে। রাতের খাবার হয়ে গিয়েছে, তারই খবর এল।

যোগমায়া সরোবরের সেই রাত নিঝুমের হাঁটাটা সত্যিই মিস করি কলকাতায় মাঝেমধ্যেই। পুরুলিয়ার রঞ্জনডিহি গ্রামের কাছে যোগমায়া সরোবর। কাশিপুর শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। স্থানীয় মানুষ জন এখানে একটু নিরিবিলিতে সময় কাটাতে প্রায়ই আসতেন। এমনিতে আর পাঁচটা সরোবরের সঙ্গে যোগমায়ার খুব একটা তফাৎ নেই। কিন্তু অবস্থান এবং সোনাঝুরির বিস্তার অন্যদের থেকে অনেকটাই আলাদা করে দিয়েছে এই সরোবরকে।

 বেশ কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে শাল, সোনাঝুরি সহ বেশ কিছু গাছের একটা ঘন সবুজ পরিবেশ। তারই ঠিক মধ্যিখানে যোগমায়া সরোবরের অবস্থান। সুন্দরীর মুখে ছোট্ট তিল যেমন তাকে রূপসী করে তোলে, তেমনই জলের মধ্যে জেগে থাকা বেশ কিছু সোনাঝুরি গাছ এই সরোবরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটাই। বিশেষ করে ছবি তুলতে যারা ভালবাসেন তাদের কাছে এই এলাকা স্বর্গ বলা যায়।  যোগমায়া সরোবরকে যখনই দেখবেন নতুন করে পাবেন। ভোরে, সকালে, দুপুরে বিকেলে বা রাতে সব সময়েই ভিন্নরূপে মোহিনী এই সরোবর।

আগেই বলেছি একেবারে নিরিবিলি পরিবেশ। প্রকৃতিপ্রেমীদের এক লহমাতেই পছন্দ হয়ে যাওয়ার কথা। আমারও তাই বেজায় পছন্দ হয়েছিল যোগমায়াকে প্রথমবার দেখেই। সত্যি বড় মনোরম পরিবেশ।  জ্যোৎস্না রাতেই শুধু নয়, সকালে বা পড়ন্ত বিকেলেও একটু হাঁটাহাঁটি করবার জন্য এই জায়গার জুড়ি নেই। পিচ ঢালা মসৃন পথ। পাখপাখালির কুজন। সবুজ আবহ। জীবনের সব চেনা অশান্তিকে দূরে রেখে নিজের জন্য শুধু এমন পথে, এমন পরিবেশেই হাঁটা যায়।

থাকার জন্য সম্প্রতি পঞ্চায়েত সমিতি একটি গেস্ট হাউজ বানিয়েছে। একেবারে সরোবরের ধারেই তার অবস্থান। নৌবিহারের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে গোল বাধিয়েছে ফেসবুক বা ইউটিউব। উৎসাহী কিছু মানুষের পোস্টে অখ্যাত এই জায়গাও এখন আলোচনায় চলে এসেছে। কেউ কেউ তো পুরুলিয়ার সুন্দরবন নাম টাম দিয়ে সে এক সব্বোনেশে কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে। ফলে হঠাৎ করেই যোগমায়ায় মানুষের ঢল নেমেছে। যার ফলে পুরুলিয়ার অন্য জায়গার মত এই জায়গাটিও তার নিজস্বতা হারাতে চলেছে অচিরেই।  সত্যিই যদি যোগমায়ার সৌন্দর্য কেউ উপভোগ করতে চান। নির্জনে সেই পিচ ঢালা পথে হাঁটার মজা নিতে চান তবে দেরি করাটা সমীচীন হবে না। কারণ যে ভাবে সকলে যেতে শুরু করেছেন তাতে এটিরও খুব শীঘ্রই বড়ন্তি বা অযোধ্যার মত কুম্ভমেলায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

যোগমায়া থেকে কয়েক কিলোমিটার এগোলেই জোরথোল গ্রাম। না, পুরুলিয়ার আর পাঁচটা গ্রামের সঙ্গে জোরথোলের কোনও পার্থক্যই নেই। কিন্তু জোরথোলকে আলাদা করে দিয়েছে এই গ্রামের কয়েকটি পরিবার। স্থানীয় মানুষ একে মিষ্টি গ্রাম বলেই জানেন। কারণ এই গ্রামে কয়েকটি পরিবার মিষ্টির কারবারে যুক্ত। ব্যাপারটা যতটা সহজে বললাম, ঠিক ততটা সরল নয়।

কারন জোরথোলে না গেলে বিশ্বাস করা কঠিন এমন প্রত্যন্ত একটি গ্রামে মিষ্টি প্রস্তুতিতে এমন সুবিশাল কর্মযজ্ঞ চলতে পারে। গ্রামে ঢোকার মুখেই দেখা পেলাম মন্ডল পরিবারের। তাদের বাড়িতে ঢুকে আমি তো থ। সত্যিই বলছি কলকাতা থেকে এত দূরে এমন গ্রামে এমন ব্যপক আকারে মিষ্টির কারখানা থাকতে পারে আমার জানা ছিল না। পরপর উনুনে বিশাল কড়াই। কোনটায় রসগোল্লা ফুটছে, কোনওটায় রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। কোনওটায় দুধ গরম করে ছানা তৈরি হচ্ছে। সে এক জব্বর ব্যাপার।

আর একটু এগোতেই তাজ্জব আমি। রসগোল্লা পাকানো হচ্ছে মেশিনে। ছানা ফেলে দেওয়া হচ্ছে, মেশিনে সেই ছানার তাল থেকে ছোট ছোট গুলি বার করে তা সুগোল করে পাকিয়ে রসগোল্লার আকার দিচ্ছে যন্ত্র। সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে ফুটন্ত রসে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কলকাতা থেকে গিয়েছি শুনে খুব খুশি সকলেই। আমাদের খুব যত্ন করে সব ঘুরিয়ে দেখাল মণ্ডল পরিবারের এক সদস্য।

তার সঙ্গেই পিছনে গোয়ালে গিয়ে দেখি কয়েক বিঘা জমি নিয়ে সেই গোয়াল। বিভিন্ন জাতের বিভিন্ন রঙের শ দুয়েক গরু সেখানে। তাদের দেখভালের জন্য রয়েছে বেশ কিছু কর্মী। সব মিলিয়ে প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক কাজ করছে ঐ মিষ্টির কারখানায়।

এবারে চললাম মিষ্টির ভাঁড়ার দেখতে। সন্দেশ জাতীয় মিষ্টি কম, রসের মিষ্টির আধিক্যই চোখে পড়ল। বিশাল বিশাল গামলায় সারি দিয়ে রাখা রয়েছে রসগোল্লা, পান্তুয়া, রাজভোগ, চমচম, কমলাভোগ ইত্যাদি কত রকমের মিষ্টি। আমি ব্লাডসুগারের রোগী, ঐ ঘরে ঢুকে মনে হল আমার সুগার বুঝি মিষ্টি দেখতে দেখতেই বেড়ে যাচ্ছে। দু একটি মিষ্টি চেখেও দেখা হল।

ভাঁড়ারের বাইরে বেরোতেই একজন ফুটন্ত রসগোল্লা কড়াই থেকে তুলে একটি প্লেটে এনে হাজির করলেন। নাহ, এ লোভ সামলানো বেজায় কঠিন। নরম, গরম রসগোল্লা মুখে দিতেই… আহ্‌ স্বর্গীয় সুখানুভূতি।  কথা হচ্ছিল জলধর বাবুর সঙ্গে। তিনিই এই মণ্ডল পরিবারের কর্তা। জানালেন পুরুলিয়ার এই উত্তর অংশে কয়েকশো মিষ্টির দোকানে মিষ্টি সরবরাহ হয় এই জোরথোল গ্রাম থেকেই। শুধু দোকান নয়, প্রায় পঞ্চাশ কিমি ব্যাসার্ধের বিভিন্ন এলাকার নানা অনুষ্ঠান বাড়িতেও মিষ্টি যায় জোরথোল থেকেই। সামান্য কিছু মিষ্টি বাড়ির জন্য কিনে নিয়ে এবার রওনা দিলাম।

যোগমায়ায় থাকার একটাই জায়গা। এখনও অনলাইন বুকিং চালু হয়নি। তবে এমনিতেই ভিড় যেভাবে বাড়ছে তাতে সামাল দেওয়াই কঠিন। শেষ বেলা ফের বলি, যোগমায়া সরোবর সত্যিই অসাধারণ। ভাল লাগাবেই আপনাকে। কিন্তু তার জন্য যোগমায়ার নির্জনতা টিকে থাকতে থাকতে যাওয়াই ভাল।

One thought on “মিষ্টি মধুর যোগমায়া

  • July 6, 2024 at 4:23 pm
    Permalink

    অসাধারণ।
    যেমন সুন্দর ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে যোগোমোয়ার রূপ কে, তার সৌন্দর্য কে সেটা সত্যিই অতুলনীয়। আমি তো ছবি দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেছি। একরকম যেনো আবারও প্রকৃতির প্রেমে পড়ে গেলাম। আমার কাছে এই সরোবরটির কিছু ছবি আছে বিভিন্ন সময়কার, আমি যতবার এই সরোবরের ছবিগুলো দেখি ততবার তার রূপে বিভোর হয়ে যাই। যেনো মনে হয় আমি তার সামনেই বসে আছি, সরোবরের জল ছুঁয়ে আসা শীতল হাওয়া যেনো আমাকেই স্পর্শ করবে বলে বারবার ধেয়ে আসছে আমার পানে।। ❤️

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight + sixteen =