মেচায় মজেছে মন

সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পলাশ মুখোপাধ্যায়

বাঁকুড়ার একটি ছোট্ট জনপদ বেলিয়াতোড়। বালিতট বা বেলেতট থেকে বেলেতোড় বা বেলিয়াতোড় কথাটির জন্ম বলে স্থানীয় শিল্প সাহিত্য রসিকদের অনুমান। তিন জেলার মধ্যবর্তী স্থানে ঘন শাল মহুয়ার অরন্যে ঘেরা ছোট্ট পল্লী হিসেবে আত্মপ্রকাশ, আজকের নাগরিক কাঠামোয় বাড়বাড়ন্ত বেলিয়াতোড়ের। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে শীর্ণকায়া শালী নদী। আরও বিশদে বললে, একদিকে গন্ধেশ্বরী, দারকেশ্বর বিধৌত বাঁকুড়া শহর। অন্যদিকে দামোদর শালী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বেলিয়াতোরের ভৌগলিক অবস্থান। কুড়ি কিলোমিটার দূরে দুর্গাপুর শিল্পনগরী। কলকাতা থেকে যেতে হলে দুর্গাপুর হয়ে গেলেই সুবিধে। আমি কলকাতা থেকে ট্রেনে দুর্গাপুর হয়ে বেলিয়াতোড় পৌঁছলাম। আমার সঙ্গী সুকুমারদা এবং চিত্রগ্রাহক রূপেশ খান এলেন বাঁকুড়া থেকে।

গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাচীন ছোট্ট ভূখণ্ডটির স্বাতন্ত্রতা বা নিজস্বতা রয়েছে তার আনাচে কানাচে। নিজস্ব গণ্ডীর ছোট্ট ভূগোলের জঠরে জন্ম নেয় বহু বর্ণময় ও গৌরবময় ইতিহাস। প্রতিটি জায়গার স্থান নাম মাহাত্ম্যে নিজস্ব স্বকীয়তা গড়ে ওঠে ব্যক্তিত্বের বিকাশে, প্রাতিষ্ঠানিক কিম্বা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে। বাঙলার বহু জনপদ তার ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে মিষ্টান্ন শিল্পের একক নাম মাহাত্ম্যে। বেলিয়াতোড় তেমনই এক জনপদ। এখানকার মেচা সন্দেশের নাম শুনে জিভে জল আসে না এমন মানুষ মেলা ভার। স্বাদে অনুভবে আজও মেচা সন্দেশ মোহ বিস্তার করে আছে খাদ্যরসিক মহলে। বাংলা তথা জাতীয় স্তরের মিষ্টি মহলেও অনন্য স্থান দখল করেছে মেচা।
মেচা সন্দেশের জনক কে? গোটা বেলিয়াতোড় তোলপাড় করলেও এই প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব মেলা দুষ্কর। অন্ততঃ দুশো বছরের কম নয় মেচার জন্ম ইতিহাস, অনুমান মেচা প্রস্তুতকারকদের। প্রাচীন কয়েকজন নামী মেচা প্রস্তুতকারক গত হয়েছেন কয়েক বছর হল। সম্প্রতি মারা গিয়েছেন চন্দ্রলোক সুইটস্‌ এর কর্ণধার চন্দ্রশেখর দাস মোদক। হিরা হোক বা নারায়নী সুইটস্‌, মেচা সন্দেশের নানা কারখানা ঘুরেও পাওয়া গেল না আদি ইতিহাস। তবে বাঙালির নস্টালজিক ভাবনার খোলস থেকে বেরিয়ে এল, ইংরেজ আমলেও নাকি এখানকার এই বিশেষ মিষ্টি প্রসিদ্ধ ছিল।

আদিতে মাত্র দু-তিনটি খাবার দোকান ছিল বেলিয়াতোড় মোড়ে। বিশ্রামস্থল হিসেবে স্বীকৃতি মিললেও তখনও চটির মর্যাদা লাভ করেনি। খাবারের দোকান ঘরগুলি ছিল চালা ঘরের। লাল মাটির রাস্তার দুপাশে ছিল সারিবদ্ধ গাছ। বুটের বেসন মেখে ডালডা বা তেলে চানা ভাজা হত। তার পর সেই ভাজা চানাকে ঢেঁকিতে কুটে চিনির পাক করে লাড্ডু আকারে চিনির ঘন রসে চুবিয়ে ফেলা হত পাটাতন বা বাঁশের প্রশস্ত চালুনিতে। একটূ শক্ত হওয়ার পর থালা, বড় রেকাবী বা কাঠের বারকোশে সাজিয়ে রাখা হত দোকানে। বেসনের মণ্ডের সঙ্গে ছানা, ক্ষীর মেশানো হত স্বাদ বাড়ানোর জন্য। কেউ কেউ আবার কর্পূর, এলাচ গুঁড়োও দিতেন। ধীরে ধীরে বিশুদ্ধ ঘি, ছানা কিম্বা চাঁছির দিন শেষ হয়ে গেল সবার অজান্তেই। সময়, শ্রম, যান্ত্রিকতা, কাঁচা মাল, জ্বালানি যোগানে নেমে এল সঙ্কট। নিত্যদিন তেল, বেসন, ডালডা, চিনির দাম বেড়ে চলায় মেচা হারাল তার সাবেকি চরিত্র। কৌলীন্য হারিয়ে বহুল বিপননের তাগিদে এখন বুটের বদলে ছোলার বেসন, কিম্বা ঘি-ডালডার বদলে রিফাইন তেল জায়গা করে নিয়েছে।

মেচা সন্দেশ বিক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম প্রবীন মাধব দে’র মুখ থেকে শোনা গেল অতীতের কথা। ষ্টেশনে সিনেমাতলায় ছিল মাধব বাবুর দোকান।সারা দিনে দুবার দুটি ছোট ট্রেন যাতায়াত করত বিডিআর রেলপথে। আত্মীয় বাড়ি যাতায়াত কিম্বা অনুষ্ঠান বাড়ির জন্য, সকলেরই প্রথম পছন্দ ছিল বেলিয়াতোড়ের মেচা। এছাড়াও পালকি নামিয়ে অথবা গরুর গাড়ি থামিয়ে মেচা চলে যেত দূর-বহুদূর।

তবে দিন বদলের রীতি মেনে বদল ঘটেছে মেচারও। উন্নত প্রযুক্তি এবং আধুনিক মনস্কতায় মেচার গায়েও লেগেছে নতুন যুগের পরশ। চুয়াত্তর বছরের মাধববাবু অবসর নিয়েছেন। তাঁর ছেলে পিন্টু হাল আমলের মেচা বিক্রেতা। গোটা একটা কারখানা খুলে ফেলেছেন রেলস্টেশন লাগোয়া বাড়িতে। ভিয়েনশালা থুড়ি ওয়ার্কশপে বসেছে অত্যাধুনিক মেশিন। ফি দিন তিন কুইন্ট্যাল মেচা সন্দেশ বানানো হয় এই কারখানায়। আশেপাশের জেলার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে মেচা এ রাজ্য তো বটেই ঝাড়খণ্ড, বিহারেও পৌঁছে যাচ্ছে স্বাদ সুনাম সঙ্গে নিয়ে।

কথা হচ্ছিল হাল আমলের মেচা বিক্রেতা বাপ্পা, হরিদাস কিম্বা পিন্টুর সঙ্গে। তারা প্রত্যেকেই মেচার কৌলীন্য এবং বিপণনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সরকারী উদ্যোগের পক্ষে সওয়াল করলেন। পাশাপাশি বেলিয়াতোড়ের মেচার নিজস্বতা রক্ষার জন্য পেটেন্ট চালুরও দাবী জানালেন তারা।

এত কথা হল, অথচ খাওয়া হবে না তা কি হয়? স্পেশ্যাল মেচা বেশ কয়েকটি মুখে পুরে এবার রওনা দিলাম রায় পাড়ার দিকে। কৈলাসতলায় ডানদিকে ঘুরতেই নজরে পড়বে বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য মহাপুরুষের বাস্তুভিটে। এই মহান যশস্বীর নাম বসন্ত রঞ্জন রায় বিদ্ববল্লভ। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ এর পুঁথি আবিস্কার করেছিলেন কাকিল্যা গ্রাম থেকে। যদিও এ বাড়ির মালিকানা বদল হয়েছে দীর্ঘদিন আগেই তবুবেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নমস্য সেই ব্যাক্তির পরশ পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম।

সামান্য দূরে অপর এক মনিষীর বাড়ি। বিশালায়তন সাবেকী ইমারৎ। ১৮৮৭-র ১১ এপ্রিল অখ্যাত পল্লীর এই সুবিশাল বাড়িতে জন্মেছিলেন বিশ্ববন্দিত শিল্পী যামিনী রায়। যামিনী রায়ের শিল্পী জীবন, কর্মকৃতি আজ বেলিয়াতোড়ের ইতিহাসকে করেছে আরও সমৃদ্ধ। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই বাড়িরও প্রায় ভগ্নদশা।

বেলা গড়াল নিজস্ব নিয়মে। এবার ফেরার পালা। সহযোগী সুকুমারদা ও রূপেশ বাঁকুড়ার পথে পা বাড়ালেন, বেশি দূর নয় মাত্র ২৩ কিলোমিটার। আমি ফের দুর্গাপুর হয়েই ফিরলাম। বেলিয়াতোড় থেকে বাসে দুর্গাপুর ষ্টেশন আধ ঘন্টার পথ। সেখান থেকে কলকাতাগামী যে কোন ট্রেনে ফিরে আসা যেতেই পারে। এছাড়াও দুর্গাপুরের সিটি সেন্টার থেকে সন্ধে সাড়ে ছটা পর্যন্ত দশ মিনিট পরপর কলকাতাগামী বাস ছাড়ে। সেই বাসেও কলকাতা সহজগম্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 − five =