সম্পাদকীয় (জুন সংখ্যা, ২০২০)
২০০৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে, বীরভূমের জেলাশাসক একটি সাংবাদিক বৈঠক করছেন। ভদ্রলোক এমনিতে খুব গম্ভীর আমি তাকে খুব একটা হাসতে দেখিনি। বৈঠক চলাকালীন তার নজর গেল তৎকালীন বীরভূমের বর্তমান কাগজের সাংবাদিক দীপ্তিমান মুখোপাধ্যায়ের দিকে। সব ছেড়ে সরাসরি আক্রমণ দীপ্তিমানকে।“এই যে দীপ্তিমান, এই সব খবর কোথায় পাও? কেন লেখ? কত টাকা পাও এর জন্য? সামান্য কটা টাকার জন্য এইভাবে লিখতে লজ্জা করে না?…” ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রায় দেড় দু মিনিট ধরে লাগাতার আক্রমণ, মাঝে দীপ্তিমান কিছু বলবার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু তা খুব ফলপ্রসূ হয়নি। ঘরভর্তি অন্যান্য প্রশাসনিক কর্তারা, রয়েছেন জেলার তাবড় তাবড় সাংবাদিকেরা। সকলেই চুপ। এতক্ষণ ধরে বিষয়টা আর নেওয়া যাচ্ছিল না, উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে দাঁড়াতে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন জেলাশাসক।শান্ত গলায় বললাম আপনি এভাবে দীপ্তিমানকে বলতে পারেন না। ডি এম প্রশ্ন করলেন “আপনি?” বললাম আমি ই টিভির সাংবাদিক, এই জেলায় সদ্য এসেছি। জেলাশাসক আমায় বললেন, “নতুন এসেছেন, আপনি জানেন দীপ্তিমান কি সব লিখেছে?” গলাটা একই উচ্চতায় রেখে জানালাম “আমি জানতে চাই না, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই দীপ্তিমান যা লিখেছে তা ভুল বা অসত্য, তাহলেও আপনি সেটা এভাবে বলতে পারেন না। জনসমক্ষে টাকার খোঁচা দিয়ে অপমান করতে পারেন না। যদি আপনার মনে হয় এই লেখা ভুল তাহলে আপনি প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ জানাতে পারেন, ওর বিরুদ্ধে ওদের কাগজে রিজয়েন্ডার পাঠাতে পারেন। কিন্তু এই ভাবে একজন সাংবাদিককে অপমান করবার অধিকার আপনার নেই। জেলাশাসক একটু থমকালেন, আমার দিকে প্রায় সেকেন্ড দশেক তাকিয়ে থেকে অন্য বক্তব্যে চলে গেলেন। এর পরেও আমার সঙ্গে বহুবার পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্তাদের বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য হয়েছে, কিন্তু বার বারই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে সাংবাদিকতায় প্রশংসার পাশাপাশি বিরোধিতাও থাকবেই সেটা মেনে নিতেই হবে প্রশাসনকে।
সেদিন ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রীর লাইভ সাংবাদিক বৈঠক দেখতে দেখতে সেদিনের এই সাংবাদিক বৈঠকের কথাটা মনে পড়ে গেল। কারন মুখ্যমন্ত্রী সিএন চ্যানেলের রিপোর্টার মণীশ কীর্তনিয়াকে কিছু বলতেই দিলেন না, তারা তার বিরোধিতা করে বলে। খুব অপমানজনক ভাবে তাকে বলতে দেওয়া হল না। গণতন্ত্রে এটা করা যায় কি? উত্তর না দেওয়াটা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু অপছন্দের সংবাদ মাধ্যমকে প্রশ্নই করতে দেব না, এটা কিসের গনতন্ত্র? কোথাকার গনতন্ত্র? মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী নিজেও একসময় বিরোধী ছিলেন তা এখন বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। প্রত্যাশিত ভাবেই উপস্থিত অন্য সাংবাদিকেরা এর কোনও প্রতিবাদ করেননি।এর তিনটি কারন থাকতে পারে – প্রথমত মুখ্যমন্ত্রীর বেজায় দাপট, কাউকেই পরোয়া করেন না, তাই সকলেই ভয় পান। দ্বিতীয়ত, প্রায় সব সংবাদ মাধ্যমের মালিক এবং উচ্চপদস্থ কর্মীরা মুখ্যমন্ত্রীর করুনাপ্রার্থী, তাই তাদের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তৃতীয়ত স্রেফ মজা পাওয়া, দ্যাখ কেমন লাগে? এই মণীশই এক সময় চ্যানেল টেনের সাংবাদিক ছিল, চ্যানেল টেন মুখ্যমন্ত্রীর সেই সময়ে বড় কাছের চ্যানেল, তাই তখন মণীশের রোয়াব ছিল দেখার মত, সেই মণীশই এখন পরিযায়ী সাংবাদিকের মত সি এনে, তাই তার এই অপ্রস্তুত এবং অপমানিত দশা দেখে অন্যদের কৌতুক বোধ অনিবার্য।
বিষয়টা অনেকটা ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে-র মত। তাই যে মনীশ আগে হেসেছিলেন, তিনিই আজ ঘুঁটে হয়ে পুড়ছেন। সমভাবে আজ যারা হাসলেন তারাও একদিন অনিবার্য ভাবে পুড়বেনই। কলকাতার বা বাংলার সাংবাদিকদের মেরুদণ্ড কি আর মজবুত হবে না! এমনিতেই সাংবাদিকতা এখন সব চেয়ে অসুরক্ষিত অস্বস্তিকর এবং অলাভজনক একটি পেশা। সকলের বঞ্চনার কথা বলে, নিজেদের বঞ্চনা, অত্যাচারিত হওয়ার গল্পকে ক্রমাগত লুকিয়ে রাখার পেশাই হল সাংবাদিকতা। এই পেশাতেই দু মিনিটের নোটিশে কারও কারও চাকরি চলে যায় বিনা প্রতিরোধে; কেউ জানতেও পারেন না। এই পেশাতেই দিনের পর দিন অতি অল্প বেতনেও দশ থেকে বার ঘন্টা পর্যন্ত খাটিয়ে নিংড়ে নেওয়া হয় সঞ্চিত শেষ মেধা এবং শ্রমটুকু। এই পেশাতেই মেধা থাকা স্বত্বেও কেউ কেউ তুচ্ছাতিতুচ্ছ কর্মী হয়েই রয়ে যায় আজীবন। আবার কেউ শুধুমাত্র মালিকপক্ষ বা রাজনৈতিক নেতাদের পদলেহন করে উচ্চপদে আসীন হয় মেধার মাথায় পা রেখে।
তবুও সাংবাদিকতা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ, এমন ঠুনকো বিশ্বাসে ভর করে অসংখ্য তরুণ প্রজন্ম এই পেশায় আসছে। এবং অভিমন্যুর মত চক্রব্যুহে ঢুকে ফেঁসে যাচ্ছে। একবার ঢুকলে আর বেরোবার উপায় নেই যে। উচ্চমেধার ছেলেমেয়েরাও এখন কম আসছে এই পেশায়। অথচ আমাদের সময়েও দেখেছি সেই সময় যারা সাংবাদিকতায় এসেছে তারা প্রত্যেকেই রীতিমত ভাল ছাত্রছাত্রী। তাদের অনেকের মার্কশিট দেখে আমার বেশ লজ্জা বা ঈর্ষা হত। তাদের অনেকেই আজ বিভিন্ন চ্যানেলের উচ্চপদে মূল স্রোতে গা ভাসিয়ে রয়ে গিয়েছেন আবার কেউ কেউ এই অনাচার সইতে না পেরে ছেড়ে দিয়েছেন সাংবাদিকতা।
এখনও সময় আছে, শেষ হয়ে যায়নি সব। সাংবাদিক বা সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরা যদি একজোট না হন, এক অন্যের বিপদে, অপমানে, একজোট হয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়েন তবে আপনাদের জন্যই আরও খারাপ দিন অপেক্ষা করছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলার সংবাদ মাধ্যমের এখন জরাজীর্ণ দশা; সে দশা থেকে মুক্তি পেতে উদ্যোগ নিতে হবে নিজেদেরকেই। না হলে পুড়বার জন্য প্রস্তুত হোন।
ভাল থাকবেন সকলে। ফের কথা হবে পরের সংখ্যায়।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ