সরণ শূন্য

শারদীয়া ভট্টাচার্য,  গোবরডাঙ্গা, উত্তর ২৪ পরগণা  

 

এভাবে যে ধাক্কা খাবে তা ঘূণাক্ষরেও ভাবেনি ও। এই ক’টামাসে ও কি না করেছিল! তার প্রতিদান যে এমনটা হবে তা দুঃস্বপ্নেও আসেনি।

দেবল যখন বিলুদার কাছে মানে বিল্বমঙ্গলের কাছে কথাগুলো সোজাসুজি শুনলো তখন ওর বাক হরে গিয়েছিল। এই রোলটা পাওয়ার জন্য দেবল নিজের নাড়ি ছিঁড়তেও দ্বিধা করেনি।

কাঠকাঠ করে কথাগুলো বলেছিল বিলুদা। প্রথম যেদিন বিলুদার কাছে এল, সেদিনের বিলুদার সাথে আজকের বিলুদার কত ফারাক। একেবারে দুটো আলাদা মানুষ যেন। কিন্তু বিলুদার আজকের কথাগুলোকে কোনোভাবে ডিফেন্ড করার মতো যুক্তি বা ভাষা ছিল না ওর কাছে।

শেক্সপিরীয় নাটকের মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করাটা দেবলের যেন স্বপ্ন-লক্ষ্য-মোক্ষ ছিল। তাই যেদিন শুনল নাটকের দল “ওথেলো” করবে, সেদিন থেকে মনেপ্রাণে ও যেন ডেসডিমনার স্বামী, যুদ্ধক্ষেত্রের সেনাপতি কৃষ্ণাঙ্গ  মানুষটাই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাথায় আকাশ ভাঙলো রক্তিম দা ওদের দল ‘নাট্যরূপী’র কর্ণধার তথা পরিচালক।  বলল, দেবল নাকি ওথেলো নয়, একটা মাঝারি মানের চরিত্রেই ওকে মানাবে বেশি ভাল। কাস্টিং  অলরেডি ফাইনাল।

রাগে দুঃখে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল দেবল। রক্তিম দা’র যুক্তিগুলো শোনার বা বোঝার ক্ষমতা যেন ওর লোপ পেয়ে গিয়েছিল।  সেই ছোটোবেলা থেকে ‘নাট্যরূপী’তে আছে ও। রিহার্সাল দিয়ে বা শো করে রাতদুপুরে বাড়ি ফেরা, বা দলের কাজের জন্য পড়ায় ফাঁকি দিয়ে বাবার কাছে কম মার তো খায়নি ও। শুধু নাটককে আর নাট্যরূপীকে ভালবেসে যেন জাপটে থেকেছে এতদিন। এই দল করেই নাকি ওর জীবনে কিস্যু হবে না- একথা বলে তিন বছরের সম্পর্কের পর ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল দিশানী। তাও দেবল না্ট্যরূপীকে ছাড়েনি। ছাড়েনি রক্তিমদার ছায়াও।

আর আজ ওর স্বপ্নের কথা জেনেও রক্তিমদা সেটুকু পূরণকরতে পারল না! আগে নিজেই বহুবার বলেছে, ‘পাগল একটা। শেক্সপিয়র কি তোর শ্বশুর? আমরাও শেক্সপিয়র নামাব রে। তুইই সেক্সনায়ক হবি।’ বলে  চোখ মটকে হা হা করে হেসেছে। আর আজ ওথেলো হবে কিনা দলে মোটে ছমাস আসা শুভ!

‘ছিঃ! শাল্লা দলবাজ’ নিজের মনেই বলে জোরে একবার মাটিতে থুতু ফেলল দেবল বাড়ি আসার পথে।

রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়েছিল। অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিল রক্তিমের ফাঁপা কথাগুলো- ‘তোর জন্যে যেটা রেখেছি, সেটা ফাটিয়ে কর দিকি। কোথায় লাগবে ওথেলোর অভিনয়…’ পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল রক্তিম।

-‘রক্তিমদা তুমি কিন্তু বরাবর বলেছো শেক্সপীয়র নামালে…’

-‘আরে থাম্‌ তো।’ হঠাৎ তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে রক্তিম। ‘বেশি ঘ্যানাস না। বলেছি বলেছি। তোকে যা মানাবে তাই তো দেব নাকি? অভিনয় শেখ আগে, তারপর ওথেলো হওয়ার স্বপ্ন দেখিস।’ রক্তিমের এমন অভব্য মূর্তি কোনওদিন দেখেনি দেবল।

¤ ¤ ¤

 

ভোরের দিকে বেশ তন্দ্রা এসে গেলেও বাজে স্বপ্নে ঘুমটা গেল ভেঙে। সাথে সাথেই ভাবনাগুলো আবার জড়ো হল মাথার মধ্যে। দুম করে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল ও।

ভোর ছটায় দেবলকে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিল ‘নাটুকে’র পরিচালক বিল্বমঙ্গল।

-‘বিলুদা একটু কথা ছিল। মানে ইয়ে…’

-‘আয় আয় বোস…’ কিছু একটা আঁচ করে ওকে ভেতরে ডাকল বিল্ব।

-‘আমাকে তোমাদের দলে নেবে গো?’ মাথা গোঁজ করে বলেছিল একরোখা দেবল।

কেন এমন প্রস্তাব সেটা ও কিছুতেই বলতে চায়নি। বিল্বমঙ্গলও ঘাঁটায়নি বেশি। বরং এতদঞ্চলের সেরা নাট্যদলের পুরোনো হোল্টাইমারকে লুফে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের বলে মনে করেছিল। কারণ বিল্বমঙ্গল জানত ‘নাটুকে’ কোনোদিনই নাট্যরূপীর ধারেকাছে যেতে পারবে না।  তো সেই দলের দেবলের মত একজনকে পেলে ওদের স্টেটাস বাড়বে বৈ কমবে না। কারণ-ফারণ আস্তে আস্তে ফাঁস তো হবেই।

দেবলের এই হঠকারী সিদ্ধান্তে রক্তিম স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। ওকে বোঝাতেও চেষ্টা করেছিল অনেক। কিন্তু দেবল কোনো কথাই শোনেনি।

¤ ¤ ¤

-‘বিলুদা এখন কিন্তু বিদেশি নাটক নামছে খুব।’

-‘হুম্‌। দাঁড়ারে। আর একটা নিজেদের স্ক্রিপ্ট নামাই। তা নাট্যরূপী নামাচ্ছে নাকি?’ বিল্ব বেসিক্যালি নাটকটা বোঝেই না ঠিকমত। ওই শখে দল করা।

-‘ইয়ে…মানে…ভেবেছিল…ওথেলো।’ বলবে কি বলবে না ভেতরের কথা ভেবে বলেই ফেলল দেবল। ‘একটু রেডি হয়ে ডিস্‌ক্লোস করব…’ বলেছিল রক্তিম, মনে মনে ভাবল দেবল।

-‘হুম্‌। বিল্ব হাসল একটু।’

ইতিমধ্যে ‘নাটুকে’ একটা ছোট নাটক মঞ্চস্থ করলেও জমেনি। উঠতি দলটায় একদম প্রাণ পাচ্ছে না দেবল। কিন্তু জেদ আর রাগ এখনো ওকে গ্রাস করে আছে।

বিল্বমঙ্গল একগুঁয়ে দেবলের কাছ থেকে ধীরে ধীরে জেনে নিল কিভাবে সরকারী গ্র্যান্ট পেয়েছে নাট্যরূপী। কিংবা কিভাবে আজ সে প্রথম সারিতে।

-‘তোমাকে কথা দিচ্ছি বিলুদা, তোমার দলকে আমি তুলবই। তুমি আমার কথাটা মনে রেখো কিন্তু।’

¤ ¤ ¤

সেদিন বিল্বদার অনুপস্থিতিতে বিলুদার ডান হাত তনুজের কথায় চমকে উঠেছিল ও।

-‘কি বলছিস তুই? সামনে লীয়র এর শো? আমি জানিনা? ইম্পসিবল! আমিই তো প্রথম…’

-‘হুম্‌। তো?’ কথা শেষ করতে না দিয়েই ছোট্ট করে বলেছিল তনুজ।

আসলে এম.এ. পরীক্ষার জন্য বেশ কিছুদিন দলে আসেনি দেবল।

তড়িৎগতিতে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করেতেই হাতটা চেপে ধরল তনুজ, ‘দাদা ব্যস্ত। ওবেলা দলের ঘরে আসিস।’ দেবলের স্বরের গাম্ভীর্যে কি একটা যেন আটকে দিল দেবলকে।

-‘বিলুদা তুমি এভাবে বলছ কেন?’ বিকেলে দলের ঘরে এসে বিল্বমঙ্গলের কথায় বলল দেবল।

-‘ভুল কিছু বলেছি কি? একটু ভেবে দেখ তুই।  তনুজকে লিডিং কাস্টে না রেখে আমি তো আরেকটা দেবল তৈরি করতে পারিনা।’ ঠাণ্ডা গলায় বলল বিল্বমঙ্গল।

-‘কিন্তু তুমি তো আমাকে টোটালি বাদ…’

-‘সরি রে। তোকে আমি আমার দলের স্বার্থে ইউজ করেছি। রিয়েলি সরি।’ দেবলের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলতে লা্গল বিল্ব।  ‘অ্যান্ড অফ কোর্স থ্যাঙ্কস ফর ইওর হেল্প। ‘নাটুকে’ সামনেই অনুদান পাচ্ছে। আমাদের লীয়রটা লঞ্চ করবে নেক্সট মান্থে, শুনেছিস তো?’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বেশ বড় করে সিগারেটে একটা টান দিয়ে রিং ছাড়তে লাগল, যেন উত্তরের অপেক্ষা করছে।  তারপর নিজেই বলতে শুরু করল, ‘তোর সাথে দলের যাই হয়ে থাক, তোর নাট্যজীবনের আঁতুড়ঘর ওটা, তুই ছেড়ে চলে এলি। ওয়েল! দ্যাট্‌স্‌ ইয়োর চয়েস। কিন্তু নিজের আক্রোশ মেটাতে আমার কাছে এসে দলের সিক্রেট্‌স্‌ ফাঁস করলি। এরপর আর তোকে কি করে…’

আরো কত কি বলে যাচ্ছিল বিলুদা, কানে ঢুকছে না দেবলের।

কি একটা মনে পড়ায় বিল্বমঙ্গল ধড়মড়িয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল, ‘যাওয়ার সময় তনুজকে বলে যাস। ও ভেতরে আছে। আমাকে একটু বেরোতে হবে। আসিস মাঝেমাঝে।’

দেবল একলাটি দাঁড়িয়ে থাকে দেওয়ালে হেলান দিয়ে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 − 7 =