সাহিত্যে হাস্যরস
তপন তরফদার, খড়গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ##
পৃথিবীতে মানুষ নামক প্রাণীরাই হাসতে পারে। অন্যরা কেন হাসতে পারেনা, তা খুঁজতে গেলে দেখা যায় মানুষকে হাসার জন্য সব থেকে বেশি স্নায়ু-পেশীর সাহায্য নিতে হয় – এমনকি বিরহ, শোক-সন্তাপের ক্রন্দনের থেকেও বেশি স্নায়ুর ব্যবহার করতে হয় হাসির জন্য।
হাসি সংক্রান্ত শরীরবিদ্যাকে বলে “গেলাটোলজি” (Gelatology)। হাস্য গবেষক রবার্ট প্লোভিনের অভিজ্ঞতায় বলে, মস্তিস্কের বিভিন্ন স্নায়ু, পেশী বিভিন্ন শারীরিক মানসিক ঘটনা ঘটায়। যেমন মাথার করোটির সামনে দিকের অঞ্চলটি থেকে আবেগজনিত ক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। হাসির জন্য প্রয়োজন
কিন্তু মাথার বিবিধ অঞ্চলের সঠিক সংমিশ্রণ। হাসির বিজ্ঞান খুবই পেঁচালো বিষয়। ক্রোধ, আশা -নিরাশা-হতাশা, ভীতি, আনন্দের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার থেকেও ভীষণ কঠিন এই ‘হাসি’ বা ‘হাসানো’।
গবেষক ডার্কস বলছেন – হাসির ‘সাবজেক্ট’দের ই-ই-জি বা ইলেক্ট্রো-ইন-সেফ্যালোগ্রাফ এর সাথে যুক্ত করে হাসিয়ে দেখেছেন, হাসির সংস্পর্শে আসার ৪/১০ সেকেন্ডের মধ্যে হাসির মানুষটির
সেরিব্রাল কর্টেক্স (মস্তিস্কের বৃহত্তম অংশ) এর ভিতর নাড়া দেয় এক বৈদ্যুতিক তরঙ্গ। আমাদের মাথার খুলিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে – অগ্র, মধ্য ও পশ্চাৎ মস্তিস্ক। হাসতে যাওয়ার সময় – ১) মাথার কর্টেক্স এর বাঁ দিকে প্রথমে ঠাট্টার বিষয়টি বিশ্লেষণ করবে, ২) সঙ্গে
সঙ্গেই মাথার “ফ্রন্টাল লোব” বা সন্মুখ করোটিগত স্নায়ু সক্রিয় হবে, ৩) কর্টেক্সের দক্ষিণ অর্ধগোলক পরক্ষণেই ঠাট্টা বা তামাসার বোধগম্যের জন্য প্রয়োজনীয় মননশীল ছাঁকনি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় হাসবে কি হাসবে না। রসটা ঠিক মতো হয়নি বলে হাসে না – না বেরসিক তা ঠিক করে দেয় এই অংশ, ৪) এবার “অক্সিপিটাল লোব” বা পশ্চাৎ করোটি যা ‘দৃষ্টি’ অনুভূতির জন্য দায়ী থাকে – সেও ছড়িয়ে দেয় মস্তিস্ক তরঙ্গে। ৫) সবশেষে মানুষ ‘মোটর সেকশন’ সিগন্যালে সাড়া দেয় হাসি-ঠাট্টায়।
সবাই জানি হাসি পেলে হাসি – রামগড়ুরের ছানাদের হাসতে মানা কেন – স্নায়ুর কেরামতিতে কত ক্যালরি ক্ষয় হয় হাসিতে, তার একটা রূপরেখা পেলাম। কিন্তু কেন হাসি – এসম্পর্কে এখনও পর্যন্ত তিনটি হাস্যতত্ব পাই – ইনকনগ্রুইটি তত্ব – গবেষক থমাস ভিটক বলেন – ভাবি এক হয় আরেক। যখন আমরা রসের গল্পে বা ভাষ্যের সময় প্রত্যাশার বিপরীত দিকে বাঁক নেওয়ার ফলে ভাবনার মুখকে বদলে দেয়। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ের মধ্যে হঠাৎ আমরা – অর্থাৎ যারা হেসে ফেলতে যাচ্ছি – দুটি ভিন্ন ধরণের ভাবনা ও আবেগের ওই দিত্বের প্রকাশ ঘটে হাসিতে।
সুপিরিয়রিটি তত্ব – আমি অন্যের থেকে উন্নত – আমার বুদ্ধি, কাজ-কর্ম অনেক ভাল মানের। অন্যজন পা পিছলে পড়ে গেলে হাসি পায় কারন আমি চিৎপটাং হইনি। ও কিছুই জানে না, বালখিল্য কথায় হেসে উঠি। রিলিফ তত্ব – ডঃ লিজা রোজেনবার্গের ভাষায় – হাস্যরসের উদ্রেক ও তামাশার নির্মাণ আমাদের নিয়ত মানসিক টানাপোড়নে নিয়ে আসে সাময়িক স্বস্তি। টমাস কার্লাইলের মত – Humour is sympathy with seamy side of things. যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ও স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডঃ রবার্ট গ্রোভিন বিশ্বাস করেন পাখির গানের মতোই মানুষের হাসি প্রমাণিত করে একধরণের সামাজিক সংকেত। হাসি মানুষকে সামাজিক করে তোলে। দেখা গেছে মানুষ একা থেকে যে বিষয় নিয়ে নিজের মনেই হাসে – সেই বিষয় নিয়ে সবার সঙ্গে ত্রিশ গুণ বেশি হাসে অর্থাৎ “হাসি সেই লুকিয়ে থাকা ভাষা – যা জাতি, দেশ-কাল নিরপেক্ষ ভাষা, সমবেত ভাষা যে ভাষায় আমরা সবাই আপ্লুত হই। অমলিন হাসির সঙ্গে তির্যক হাসিরও উৎস সন্ধানের জন্য গবেষণা চলছে, চলবে।
(২)
হাসির সাহিত্যের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনায় সামিল না হয়ে হাস্যরস ভিত্তিক কিছু পত্রিকা নিয়ে অতি সংক্ষেপে কয়েকটা কথা জানাতে চাই। বাংলা সাহিত্যে রঙ্গ-ব্যাঙ্গের পত্রিকা অনেক প্রকাশিত ও
প্রচারিত হলেও এই পত্রিকাগুলি সঠিকভাবে পাঠকরা সংরক্ষণ করেনা। পুরানো পত্রিকা – প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মাসিক বসুমতীর মত পত্রিকা বাঁধানো পাওয়া গেলেও ‘যষ্টিমধু’ – ‘শনিবারের চিঠি’ – ‘অচল পত্র’ – ‘মজলিশ’ – ‘বিদূষক’কে পাওয়া যায় না। সংক্ষেপে কিছু পত্রিকার নামোল্লেখ করা যেতে পারে।
‘সম্বাদ রসরাজ’ প্রথম প্রকাশ ২৯এ নভেম্বর ১৮৩৯। হাসির সাপ্তাহিক পত্র ‘পাষণ্ড পীড়ন’ এর প্রথম প্রকাশ ২০শে জুন ১৮৪৬। ‘দুর্জনদমন মহানবমী’ ৯ই ফেব্রুয়ারী ১৮৪৭ সালে প্রথমে মাসিক পরে
পাক্ষিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়ে চার বছর পর বন্ধ হয়ে যায়। ‘আক্কেল গুড়ুম’ ১৮৪৭ সালের ডিসেম্বরে সাপ্তাহিক পত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং চারমাস চলার পরই বন্ধ হয়ে যায়। ‘প্রকৃত মুদগর’ প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ১৮৫৬। ‘সংবাদ পাষণ্ড দলন’ – অর্ধ সাপ্তাহিক নভেম্বর ১৮৫৬য় প্রথম প্রকাশ, ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ এর প্রকাশ শুরু ১৮৬১ সালে।
‘বিদূষক (১)’ এর প্রথম প্রকাশ বাংলা ১২৭৭ সনের অগ্রহায়ণে। সাপ্তাহিক ‘রস-তরঙ্গ’ প্রকাশিত হতে থাকে ১২৭৮ সনের ১০ই আশ্বিন থেকে। ‘হরবোলা ভাঁড়’ মাসিক পত্রিকা প্রথম প্রকাশ পায় ইং ১৮৭৪
সালের জানুয়ারীতে। মাসিক ‘বসন্তক’ পত্রিকা ১২৮০ সনের বসন্ত পঞ্চমীতে শুরু হয়। ‘মজলিস (১)’ এর প্রথম প্রকাশ ১২৯৭ সনের বৈশাখ মাসে। ১৩০৭ সনে প্রকাশিত হয় ‘অবতার’ যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঘাঘরা পরেছেন এমন ছবি এঁকে ব্যাঙ্গ করা হয়। ‘বিদূষক (২)’ এর প্রথম প্রকাশ ১৩২৭ সনের আশ্বিনে। ‘বিদূষক (৩)’ প্রকাশিত হতে শুর করে ৬ই মাঘ ১৩২৯ সন থেকে। ‘মজলিস (২)’ এর প্রথম প্রকাশ ১৩২৯ সনের ২৭শে শ্রাবণ।
দৈনিক ‘ভোট রঙ্গ’ ১৯২৬ সালে প্রথম প্রকাশ পায়। মাসিক ‘রবিবারের লাঠি’ ১৩৩৬ সনের মাঘ মাস হতে প্রকাশিত হয়। ‘হসন্তিকা’ পত্রিকাটি ‘শনিবারের চিঠি’র উতোর হিসেবে প্রকাশিত হয়। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত ‘রং-বেরং’ এর প্রথম প্রকাশ ১৯৩২ সালে।
(৩)
থেকে(*deleteথেকে শব্দ টা) স্বল্প পরিসরে আরও কিছু রস-ব্যাঙ্গ পত্রিকার নাম না লিখে তৎকালীন এক পত্রিকার কথা লিখি যা সেই সময়ে সমাজ ও সাহিত্যিকদের নিয়ে রঙ্গ-ব্যঙ্গ করে জনপ্রিয় হয়েছিল তার নাম “শনিবারের চিঠি”। শনিবারের চিঠি বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য ব্যঙ্গ-রঙ্গরসের মাধ্যমে খোঁচা মারার এক ঐতিহাসিক পত্রিকা। নজরুল ও অমর করে রেখে গেছেন
তার ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় লিখে – “প্রতি ‘শনিবারের চিঠি’তে প্রেয়সী গালি
দেন তুমি হাঁড়ি চাচা”।
সেই সময়ের বিভিন্ন ব্যাক্তিদের ক্ষত-বিক্ষত করত এই পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – শনিবারের চিঠি ‘প্রবাসী’র প্রেসে ছাপা বন্ধ না করলে, আমি প্রবাসীর সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখব না। তারাশঙ্কর
বলেছিলেন – যাঁরা গাল খেয়েছেন তাঁরা জ্বলেন। যাঁরা খাননি তাঁরা নিজেদের দুর্ভাগা মনে করেন।
আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে (১০ শ্রাবণ ১৩৩১, ২৬শে জুলাই ১৯২৪ – শনিবার) চিঠির আকারে খামে পুরে বেরিয়েছিল প্রথম সংখ্যা। দাম এক আনা। ৯১, আপার সার্কুলার রোড, প্রবাসী
প্রেসে মুদ্রিত এবং ১০৫, আপার সার্কুলার রোড থেকে প্রকাশিত। ডবল –ক্রাউন সাইজের ষোল পৃষ্ঠার কাগজ। প্রচ্ছদে সবুজ কালিতে চাবুক হাতে ‘ভীম’।
পত্রিকার মুখবন্ধই জনপ্রিয়তা এনে দেয়। লেখা হল – “….. আমাদের কোন উদ্দেশ্য নেই। এমনকি উদ্দেশ্যহীনতাও উদ্দেশ্য নয়। …. জীবন ও আগ্রহের ক্রমবিকাশের পথ ধরে চলতে চলতে আমাদের যা ভাল মনে হবে আমরা তারই অনুসরণ করব ….। অনেক গোলমালই আমরা বাধাবো কিন্তু অলমতি বিস্মরণে।” অশোক চট্টোপাধ্যায়ের লেখা, যিনি কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে ফিরে এসেছেন, এখানে নতুন কিছু করবেন বলে, শেষ পৃষ্ঠায় লেখা হল – “লেখা চাই না, তবে জানা জরুরী – টাকা, ইত্যাদি পাঠাইবার ঠিকানা………..”।
‘শনিবারের চিঠি’ নিয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখা যায়, আমি রবীন্দ্রনাথের এক উক্তি দিয়ে শেষ করব। ১৩৩৫ সনের “প্রবাসী”তে লিখলেন – “কয়লার খনি বা পানওয়ালীদের কথা অনেকে লিখলেই কি নবযুগ আসে”? পরের সংখ্যায় লিখলেন – “শনিবারের চিঠির লেখকদের সুতীক্ষ্ণ লেখনী, তাঁদের
রচনা নৈপুন্যেরও আমি প্রশংসা করি, কিন্তু এই কারণেই তাঁদের দায়িত্ব অত্যন্ত বেশি; তাঁদের খড়গে প্রখরতা প্রমান করবার উপলক্ষ্যে অনাবশ্যক হিংস্রতা লেশমাত্র প্রকাশ না পেলে তবেই তাঁদের শৌর্যের প্রমান হবে…………”।
রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকাকে ‘ছবিতা’ বলে রবীন্দ্রক্ষমতাকে ব্যঙ্গ করা হয়। “বটুক তুলি দিয়ে ছবি কেনা। কলম দিয়া, কলমের বাঁট দিয়া, আঙুল দিয়া, কনুই দিয়া, পায়ের পাতা দিয়া এবং নিতান্ত
একলা থাকিলে হাঁটু দিয়াও ছবি আঁকিয়া থাকে।” বটুক আসলে রবীন্দ্রনাথ।
শরৎচন্দ্রও ‘শনিবারের’ কোপে পড়েছিলেন। শরৎচন্দ্রের “শেষ প্রশ্ন” উপন্যাসের একটি প্যারডি বেরিয়েছিল ‘শেষ শ্রাদ্ধ’ নামে, লেখক বিনয়কৃষ্ণ সিংহ। সাহিত্যের উপর ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য দিয়ে ‘সংবাদ সাহিত্য’ বিভাগটি সজনীকান্তেরই মস্তিস্কপ্রসূত। বিভাগটি এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে, পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকরা এই অংশটি প্রথমে এক নিঃশ্বাসে শেষ করতেন। তবে এখবরটাও আমাদের জানা দরকার – রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করার জন্য পরবর্তীকালে সজনীকান্তও অনুতপ্ত হয়েছিলেন।
সাহিত্যে রঙ্গরসের প্রয়োজন থাকলেও – বিশেষ সাহিত্যিক হিসাবে সাহিত্যজগতে তাঁর ঠাঁই হয়না। ব্যঙ্গ-রঙ্গরসের লেখক প্রখ্যাত সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় কিন্তু অন্য ধরনের লেখাতেই “সাহিত্য একাডেমি” পেলেন। আসলে হাস্যরসকে চাটনির মতো ব্যবহার করা হয়। খাবারের তালিকায় চাটনি ব্যঞ্জনা আনে, পূর্ণ ব্যঞ্জন হয়না। লেখকরা তাই পূর্ণ সাহিত্যিকের মর্যাদা পেতে ভিন্ন মইয়ের শরণাপন্ন হন। এই বেড়া ভেঙে রস-সাহিত্যেকে মান্যতা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।