একটি হাসপাতাল ও মুখ্যমন্ত্রী

পলাশ মুখোপাধ্যায়

##

পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণ বা কামদুনির সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে গোবরডাঙ্গার? আপাত দৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, না। কিন্তু একটি বিষয়ে ভীষণ মিল গোবরডাঙ্গার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে ওই দুটি ঘটনাকে। দুটি ক্ষেত্রেই একটা বড় আন্দোলন এবং বিক্ষোভের মুখ দেখেছিল বাংলা। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর একটি অমুখ্যমন্ত্রীসুলভ মন্তব্যে ধিকি ধিকি জ্বলা আগুনে পড়েছিল ঘি। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে বাস্তবে রূপ দিতে কম কসুর করেনি পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু পরে তা বুমেরাং হয়েই ফিরে আসে। গোবরডাঙ্গা হাসপাতালের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা যেন একই রকম, অত্যন্ত নিরীহ একটা দাবি বা আলোচনা। সেটাকে নিয়ে ফল্গুসম চাহিদা থাকলেও কোথাও কোন উত্তেজনার চিহ্ন মাত্র ছিল না। কিন্তু নিজস্ব প্রথা মেনে মুখ্যমন্ত্রীর করা একটা অদ্ভুত, দায়িত্ব জ্ঞানহীন মন্তব্য প্রায়ান্ধকারে থাকা গোবরডাঙ্গা হাসপাতালকে উত্তেজনার শিখরে দাঁড় করিয়ে দিল।

একটি হাসপাতাল ও মুখ্যমন্ত্রী

ঘটনার সূত্রপাত গত ৩১ মে। ব্যারাকপুরের প্রশাসনিক বৈঠকে বন্ধ থাকা গোবরডাঙ্গা হাসপাতাল ফের চালু করার আর্জি জানিয়েছিলেন পৌরসভার চেয়ারম্যান সুভাষ দত্ত। সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন স্থানীয় বিধায়ক পুলিন বিহারী রায়ও। কিন্তু প্রকাশ্য সভাতেই সুভাষবাবুর উচ্চারণভঙ্গিকে নকল করে ব্যাঙ্গ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি জানিয়ে দেন গোবরডাঙ্গায় হাসপাতাল হবেনা। তাঁদের প্রয়োজন হলে ৩০ কিলোমিটার দূরের বনগাঁ হাসপাতালে যেতে হবে। না হলে ৫০ কিলোমিটার দূরে কল্যানীতে এইমস হচ্ছে সেখানেও যাওয়া যেতে পারে। প্রকাশ্যসভায় সর্বজনশ্রদ্ধেয় চেয়ারম্যানকে ব্যঙ্গ করাটা গোবরডাঙ্গার মানুষ ভালোভাবে নেননি। ভালো ভাবে নেননি রাজ্যের প্রধান অভিভাবক তথা একজন মুখ্যমন্ত্রীর হাসপাতালের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা দাবি এমন ভাবে নাকচ করে দেওয়াটাকেও। আর এই বিষয়টাই সব শ্রেণীর মানুষকে একটা গণ আন্দোলনের ছাতার তলায় দাঁড় করিয়ে দিল।

১৯৪৩ সালে গোবরডাঙ্গা টাউনহলে সূচনা হয় এই হাসপাতালের, তখন নাম ছিল ফেমিনিন এমারজেন্সি রিলিফ হাসপাতাল। দেশ স্বাধীন হলে গৈপুরে মিত্র ও বসু পরিবার হাসপাতাল স্থাপনের জন্য জমি দেয়। সেই জমিতে ১৯৫৭ সালে এটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসাবে পথ চলা শুরু করেছিল, ২০০১ সালে রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের হাত থেকে এই গ্রামীণ হাসপাতালের দায়িত্ব নেয় উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ। তার পর থেকেই ধীরে ধীরে হাসপাতালটির অবস্থা খারাপ হতে থাকে। অবশেষে ২০১৪ সালে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের তরফ থেকে নোটিস দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, হাসপাতালে শুধুমাত্র আউটডোরে কিছু পরিষেবা চালু থাকবে। রোগী ভর্তি-সহ অন্যান্য সব পরিষেবাও বন্ধ থাকবে। এরপরেই গোবরডাঙা একাধিক রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন প্রতিবাদ জানায় ও সরকারি মহলে ডেপুটেশন দেয়। কিন্তু লাভ হয়নি। চল্লিশ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটি চালু হলে গোবরডাঙ্গা পুর এলাকা এবং বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েত এলাকার লক্ষাধিক মানুষ উপকৃত হবেন।

চলে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক সংগঠনের ডাকে মিটিং মিছিল। শেষমেস এই হাসপাতালকে বাঁচাতে গণতন্ত্রের শেষ হাতিয়ার বনধের রাস্তাও বেছে নেন গোবরডাঙ্গাবাসী৷ ‘গোবরডাঙ্গা পৌর উন্নয়ন পরিষদের’ ডাকে ১৪ জুন বনধ পালন করে গোবরডাঙ্গা৷ এমন সর্বাত্মক বনধ গোবরডাঙ্গাবাসী কেন গোটা বাংলাও বোধহয় সাম্প্রতিক কালে দেখেনি। ১২ ঘন্টা গোটা গোবরডাঙ্গাই যেন স্তব্ধ ছিল। ট্রেন চলেছে কিন্তু গোবরডাঙ্গা রেল স্টেশন ফাঁকা, স্কুল, ব্যাঙ্ক, দোকানপাট সব ছিল বন্ধ। ভ্যান রিক্সা চালকেরাও এদিন পথে নামেননি। মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পাহাড়েও বনধ হচ্ছে, কিন্তু সেখানে মোর্চা সমর্থকদের পথে নামতে হয়েছে, বলপ্রয়োগ করতে হয়েছে, হিংসার আশ্রয় নিতে হয়েছে বনধ সফল করতে। কিন্তু গোবরডাঙ্গায় অরাজনৈতিক সংগঠনের ডাকা এই বনধে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছেন সব শ্রেণীর মানুষ।

একটু আগে পার্কস্ট্রিট গণধর্ষণ কাণ্ডের কথা বলছিলাম। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছিলেন কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু সে কথায় সায় না দেওয়ায় বদলি জুটেছিল এক মহিলা আইপিএস অফিসারের কপালে। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়, মুখ্যমন্ত্রীকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন পুরপ্রধান। তা নিয়েই যত গোল। এর পরে আবার গোবরডাঙ্গায় এত সফল একটা বনধ পালন। যথারীতি রাজরোষে পড়ে পদ খোয়াতে হয়েছে প্রাক্তন পুরপ্রধান সুভাষ দত্তকে। প্রাক্তন শিক্ষক আপাদমস্তক ভদ্র বিনয়ী সুভাষবাবুর প্রতি দলের এই ব্যবহারে ক্ষুব্ধ দুঃখিত দলেরই একাংশ। ক্ষোভে ফুঁসছেন গোবরডাঙ্গার মানুষজনও।

এ প্রসঙ্গে একটা বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। সেটা হল তাঁর এই উক্তির পরেই কিন্তু হাসপাতালের জন্য আন্দোলনটা সর্বজনীন হয়েছে। বামেরা তো এখন ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে। হাসপাতালের এই হালের জন্য সর্বত ভাবে দায়ী তারাই। হাসপাতালের উন্নতির জন্য পৌর উন্নয়ন পরিষদ আন্দোলন করে আসছে ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে। জন্মসূত্রে গোবরডাঙ্গার ছেলে হিসেবে সেই আন্দোলনের সাক্ষী আমি নিজে। কিন্তু অরাজনৈতিক এই সংগঠনের পক্ষে একটা আন্দোলনকে বৃহত্তর রূপ দেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন। আপাত শান্ত, সংস্কৃতি প্রবন গোবরডাঙ্গার সর্বস্তরের মানুষ কিন্তু এবার সোচ্চার হয়েছেন। আন্দোলনে সামিল হতে পা ফেলেছেন ঘরের বাইরে। আধুনিক প্রজন্ম সোশ্যাল নেটওয়ার্কে প্রতিবাদের ঝড় বইয়ে দিয়েছে। অনেকদিন বাদে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ধারাবাহিক শিরোনামে গোবরডাঙ্গা। এসবই সম্ভব হয়েছে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর জন্য। আচ্ছা আপনিই বলুন, হাসপাতাল না দিলেও এই যে গোবরডাঙ্গার মানুষকে জাগিয়ে তোলা, এক করা, ডয়িংরূম থেকে আন্দোলনে সামিল করা এ জন্য কি মুখ্যমন্ত্রীর একটুও ধন্যবাদ প্রাপ্য নয়?

আর হাসপাতাল? এইমস তো হচ্ছেই… এখন থেকেই গোবরডাঙ্গার মানুষ কল্যানীতে ছোটা অভ্যেস করুন। নিয়মিত পঞ্চাশ-পঞ্চাশ একশো কিলোমিটার ছোটাছুটি করলে এমনিই শরীর স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। মুখ্যমন্ত্রী আবার মেডিক্যালটাও খারাপ বোঝেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten − four =