দুর পাল্লা

পলাশ মুখোপাধ্যায়

##

যারা বেড়াতে ভালোবাসেন ঘুরনচণ্ডীর ডায়েরি তাদের জন্যই। কিন্তু যারা পরিকল্পনা করে দুমাস আগে থেকে টিকিট কেটে সব কিছু গুছিয়ে বের হন, এই পাতা তাদের জন্য নয়। কাঁধে ঝোলা তুলে, বাকি সব ভুলে দিকশুণ্যপুরের পথে পা বাড়াতে চান যারা তাদেরই নানা অদেখা অজানা এলাকার হদিশ দেবে ঘুরনচণ্ডীর ডায়েরি। কোন নামি বা তথাকথিত চেনা পর্যটন স্থলের ঠিকানা এখানে মেলার সম্ভাবনা কম। এবারে আমাদের গন্তব্য চাঁচাই এবং পাল্লা।

সকাল সকাল হাওড়া থেকে বর্ধমান কর্ড লাইনের ট্রেনে চড়ে বসলাম। আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম বর্ধমানের চাঁচাই এবং পাল্লার কথা। দামোদরের তীরে এমন নির্জন – সুন্দর পরিবেশ নাকি সচরাচর মেলা ভার। যাওয়ার আগে গুগল্‌ ম্যাপ থেকে এলাকা সম্পর্কে কিছুটা ধারনা নিয়ে নিয়েছিলাম। যাই হোক প্রায় দু’ঘন্টা ট্রেন সফরের পর বর্ধমান লোকাল নামিয়ে দিল চাঁচাই স্টেশনে। না, আমরা যারা কলকাতা বা আশেপাশের মানুষ তাদের দেখা রেলষ্টেশনের সঙ্গে এই এলাকার ষ্টেশনগুলির কোন মিল নেই। সবুজ মাঠের মাঝে অতিনির্জন একটি ষ্টেশন। ট্রেনের আনাগোনা ছাড়া জনমনিষ্যি নেই বললেই চলে। বেশ পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম ষ্টেশনটিকে দেখেই ভালো লেগে গেল।

ষ্টেশন থেকে বেরিয়েই ছোট্ট একটা বাজার, গ্রামের দিকে জাওয়ার রাস্তাও সে দিকেই। আমি কিন্তু রেললাইন ধরেই হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় আধকিলোমিটার বর্ধমানের দিকে লাইন ধরে হাঁটার পর এল ডিভিসি খাল। আশেপাশে লোকালয় নেই। তাই সবুজে মোড়া এই এলাকাটি বড় নির্জন, পাশাপাশি বেশ সুন্দরও। গাছগাছালি থাকায় ছায়া সুনিবিড় খালের ধারে একটু বসতে মন চাইবেই। আমিও দু’দণ্ড জিরিয়ে নিলাম একটা কাঁঠাল গাছের তলায়।

খালের ধার ধরে একটু এগোলেই চোখে পড়বে ছোট্ট একটা ব্যারেজ। তার আশে পাশে প্রচুর ফলের গাছ লাগানো। সেই ফলের বাগানেও ঘুরতে চাইল মন। বারণ করবার মত আশেপাশে কাউকে দেখলাম না। বেশ খানিকক্ষণ কাঠবেড়ালির দুষ্টুমি দেখা, পাখপাখালির কুহু কুজন শোনার পর ফের খাল বরাবর হাঁটা শুরু করলাম। স্থানীয় কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল এই খাল সোজা গিয়েছে দামোদরে। পথেই চোখে পড়ল ভারি সুন্দর ছোট্ট একটি সেতু, খাল পারাপারের জন্য। খাল পেরিয়ে ওপারে গিয়ে ফের শুরু হল হন্টন।

মাটির এ পথ ধরে হাঁটতে কিন্তু দারুণ ভালো লাগছিল। তবে এটাও জানিয়ে রাখা দরকার এই পথে লাখ টাকা দিলেও কোন যানবাহন মিলবে না। হাঁটতে হাঁটতেই চলে এলাম পাল্লা ডিভিসি কলোনিতে। এখানে দামোদর থেকে আসা একটি খালকেই চারটি ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ঐ চারটি খাল সেচের জন্য জল পৌঁছে দিতে এখান থেকেই রওনা দিয়েছে দূরে বহুদূরে। খাল থেকে যদি জল ছাড়া হয় তবে তা দেখতে বেশ ভালো লাগবে। মরা খালগুলিও তখন পূর্ণযৌবনা হয়ে ওঠে। সাদা ফেনিল জলরাশি এক অপূর্ব দৃশ্যের জন্ম দেয়।

আর একটু বাঁদিকে এগোলেই চোখে পড়বে সুবিশাল দামোদর। বালুময় দামোদরের প্রশস্ত নদীগর্ভে জল সামান্যই। কিন্তু সেখানেই তো আসল মজা। সেই হাটু ভেজা জলে পা ভেজাতে নেমে কখন যে ফেলে আসা শৈশবে ফিরে গিয়েছি খেয়ালই নেই। অগভীর এলাকা দেখে নদী পেরিয়ে চলে গেলাম ওপারের কাশবনে। সে এক দারুণ অনুভূতি। কি যে ভালো লাগছিল, তা অবর্ণনীয়। ওপারটিও বেশ মনোরম, কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর ফের এপারে চলে এলাম।

এপারে ফিরে এসে নদীর বুকে বাঁধা নৌকাগুলির একটির উপরে বেশ জুত করে বসা গেল। না এখানেও বারণ করবার মত তেমন কেউ নেই। দূরে দামোদরের বুক থেকে বালি তুলে লরি ভর্তি করা হচ্ছে। সঙ্গে আনা বাদাম চানাচুরের স্বাদ নিতে নিতে নৌকায় বসে তাই দেখলাম খানিক সময়। স্থানীয় এক মাঝির সঙ্গে ভাব জমিয়ে সামান্য নৌকা চালানোর প্রশিক্ষণও নেওয়া গেল এই বেলায়। নৌকা উল্টালেও ডুবে যাওয়ার ভয় নেই, এমন সুযোগ সচরাচর আসে নাকি? মাঝির কাছ থেকেই জানা গেল দু’একটা বাংলা ছবির শুটিংও নাকি এখানে হয়েছে।

রোদের তেজটা নরম হয়ে আসতেই মালুম হল এবার ফেরার সময় হয়ে আসছে। নদী ছেড়ে পাশের সবজি ক্ষেতে উকি মারতেই নজরে এল বাগান সতেজ পটল, লাউ, চালকুমড়ো, ঢেঁড়স, লঙ্কা আরও কত কি। শহুরে চোখে এমন সুন্দর সতেজ সবজি পড়তেই বেশ লোভাতুর হয়ে উঠল মন। বলাই বাহুল্য, দামও বেশ কম। তবে আমি আর অত দূর থেকে সবজি বয়ে আনার ঝক্কি নিলাম না। হাঁটতে হাঁটতে ফের চলে এলাম চার খালের উৎপত্তিস্থলে। বিকেল হয়ে যাওয়ায় এখন দুচারটি দোকানপাট খুলেছে চোখে পড়ল। গরম চপ ভাজার গন্ধ নাকে আসতেই হঠাৎ খিদেটাও কেমন যেন সরব হয়ে উঠল। সামান্য মুড়ি সহযোগে পেঁয়াজি এবং বেগুনি নিয়ে এলাম মূল খালটির ধারে। সবুজ ঘাসে ছাওয়া পাড় দেখে মুড়ি নিয়ে বসেই পড়লাম। পড়ন্ত আলোয় সবুজ মখমলি ঘাসে বসে মুড়ি চপের মজা নিতে নিতে মনে হল, এমন ভালো বোধহয় আর কখনো লাগে নি।

এবার ফেরার পালা। না ফেরার সময় অতটা হাঁটার দরকার নেই, সেটা আমি খোঁজ নিয়ে নিয়েছি। কাছেই পাল্লা রোড ষ্টেশন। পিচ ঢালা পথ ধরে গ্রাম্য পরিবেশের গন্ধ মেখে ধীরে ধীরে চলে এলাম পাল্লা রোড স্টেশনে। এদিককার ট্রেনে খুব ভিড় হয়না। তাই জানালার ধারে না হলেও ট্রেনে উঠে কোন একটা জায়গা মিলে যায়ই। আমিও তেমন একটা ফাঁকা জায়গা দেখে এলিয়ে দিলাম শরীরটা। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ভারি হয়ে এল দু’চোখের পাতাও। ঘণ্টাদুয়েক নিশ্চিন্ত নিদ্রা।

শেষ বেলায় দু একটা কথা একটু জানিয়ে রাখি। যেহেতু খুব বড় বা নামি এলাকা নয় তাই এই অঞ্চলে কোন ভাতের হোটেল বা বড় রেস্টুরেন্ট মিলবে না। সুতরাং খাওয়া দাওয়া নিয়ে খুব বাছবিচার করবার সুযোগ নেই। হাল্কা কিছু খাবার সঙ্গে রাখাই ভালো। জলে নামতে হলে রাবারের চটি বা জুতোই ভালো, খালি পায়ে জলে নামা সমীচীন নয়। ছাতা এবং জলের বোতল অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন। কর্ড লাইন লোকাল হাওড়া ছাড়াও বালি বা ডানকুনি থেকেও মিলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight + nine =