ঝটিকা সফর ঝাড়গ্রামে
পলাশ মুখোপাধ্যায়
##
বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। বেশ একটু হিংসাই জাগাচ্ছে নীল আকাশে ছন্নছাড়া সাদা মেঘের দল। এমন আবহে ঘরে মন টেকে এমন মানুষ মেলা ভার। আর আমাদের মত ঘুরণচণ্ডী হলে তো কোন কথাই নেই। তাহলে কথা বাড়িয়ে লাভ কি? বেরিয়ে পড়া যাক। আচ্ছা, পুজোয় একটা বা দুটোদিন কি ছুটি মিলিতে পারে? তহলে এবার আমরা একটু দূরে যাব। না, না কলকাতা থেকে মাত্র ঘন্টা আড়াই। দিনের দিন গিয়েও ফিরে আসা যায়। আর হাতে যদি আর একটা দিন মেলে তবে তো সোনায় সোহাগা।
বেরলাম খুব ভোরে, হাওড়া ষ্টেশনে পৌঁছে সকাল সাতটা নাগাদ ট্রেন। ইস্পাত এক্সপ্রেস। টিকিট কেটে বেশ পছন্দসই একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসা গেল। যারা কলকাতা থেকে একটু দূরে থাকেন তারা এরপরেও সাড়ে আটটা নাগাদ একটা ভালো ট্রেন আছে লালমাটি এক্সপ্রেস, সেটিতেও যেতে পারেন। কোথায় যাচ্ছি সেটা এখনও বলিনি তো? এবার বলি আমরা যাচ্ছি ঝাড়গ্রাম। তবে আমাদের গন্তব্য ঠিক ঝাড়গ্রাম শহর বা আশেপাশের এলাকা নয়। সেগুলি তো অনেকেরই চেনা, জানা হয়তো বা ঘোরাও। আমরা যাব নয়াগ্রামের রামেশ্বর শিব মন্দির। মন্দির শুনে একটু ভ্রু কোঁচকালেন মনে হচ্ছে। না মশাই, শুধু একটা মন্দির দেখতে এতটা পথ পাড়ি দিচ্ছি এমন ভক্তি অন্তত আমার নেই। রামেশ্বর শিব মন্দির এবং তার কাছে থাকা তপোবন তার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য টেনেছে আমাকে। দেখতে দেখতে এসে গেল ঝাড়গ্রাম ষ্টেশন।
ষ্টেশনে নেমে এবার গন্তব্য গোপীবল্লভপুর। যদি পকেটে রেস্ত থাকে তবে গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন। তাতে মানিব্যাগের ওজন একধাপে অনেকটা কমে গেলেও ঘোরাঘুরিটা আরামদায়ক এবং মসৃণ হবে। আর হ্যা, যদি বাউল মনের মানুষ হন তবে অতশত না ভেবে কিছু একটু মুখে দিয়ে সোজা উঠে পড়ুন গোপীবল্লভপুরের বাসে। ঘন্টা খানেকের রাস্তা। গোপীবল্লভপুর থেকে রামেশ্বর মন্দির যাওয়ার ভাড়া গাড়ি পাওয়া যায়। দরদাম করে উঠে পড়াই ভাল, কারণ তপোবন যেতে গেলে গাড়ি একটা ভাড়া করে নিতে হবে। গোপীবল্লভপুর থেকে রামেশ্বর মন্দির আধ ঘন্টা থেকে চল্লিশ মিনিটের রাস্তা। কাছাকাছি যেতেই নজর পড়ল রূপসী সুবর্ণরেখার দিকে। সোনালী বালির বুক চিরে রূপোলী জলধারা। তার উপরে রোদ পড়ে কেমন চিকচিক করছে দেখেই মনটা ভাল হয়ে গেল।
রামেশ্বর শিব মন্দির চত্বরে এসে তাই আগে ছুটলাম সুবর্ণরেখার দিকে। নদীর ধারে এসে একটা আতা গাছের ছায়ায় একটু বসতেই এতটা পথের ক্লান্তি যেন নিমেষে দূর হয়ে গেল। পুজোর মরসুম তো, দূর গ্রামের দিক থেকে ভেসে আসছে কোন ভক্তিগীতির সুর। আমি ভক্তিগীতি ভালবাসি এমনটা কেউ দাবী করতে পারবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু পরিবেশের গুনে সেই অচেনা আবছা গানের সুরটা মনে গেঁথে গেল।
দুরে ফেয়ার ওয়েদার ব্রিজ দিয়ে যাতায়াত করছে গাড়ি, মানুষ, গরু বাছুর। বিশাল নদীর বুকে বালি তোলার লরিও চোখে পড়ল বেশ কয়েকটা।উঠে পা রাখলাম নদীর বুকে। ঝিরি ঝিরি ঠান্ডা জলে পা রাখতেই মনে হল এখানে আসার জন্য বুঝি আরও কষ্ট সহ্য করা যায়। খানিকক্ষণ সে সুখ নিয়ে এবার মন্দিরের পথে।
নয়াগ্রামের দেউলবাড়ে সুবর্ণরেখা নদীর তীর লাগোয়া ৫ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে মাকড়া পাথরে তৈরি এই প্রাচীন রামেশ্বর শিব মন্দির। মন্দিরের গর্ভগৃহে একসঙ্গে রয়েছে বারোটি শিবলিঙ্গ। উৎকল শৈলির এই মন্দির ঘিরে অবশ্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জনশ্রুতি। কারো মতে এই মন্দিরটি ত্রেতাযুগের। বনবাসকালে সীতার শিবচতুর্দ্দশীর ব্রত উদযাপনের জন্য রামচন্দ্রের অনুরোধে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা মন্দিরটি তৈরি করেন।
আবার কেউ কেউ এই মন্দিরটিকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সমসাময়িক বলে মনে করেন। মন্দিরটির আদলও অনেকটা পুরীর মন্দিরের মতই। নির্জন এলাকায় একটু উঁচু ঢিবির পরে এই মন্দিরের পরিবেশটি কিন্তু চমৎকার। উৎসবের মরসুম ছাড়া জনসমাগম সেভাবে হয় না। তাই কোলাহলহীন ছায়া ঘেরা এই মন্দির চত্বরে বসে থাকতেও মন্দ লাগে না।
মন্দির চত্বরে পর্যটকদের জন্য সুদৃশ্য বাগান ও শিশুদের খেলার পার্ক তৈরি করা হয়েছে। সুবর্ণরেখার তীরে তৈরি হয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ারও। তবে আমার কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক পছন্দসই মনে হয়নি। এমন সুন্দর পরিবেশ স্বাভাবিক সবুজ সৌন্দর্যই যেন বেশি মানানসই বলে আমার মনে হয়েছে। বরং এই সাজানো পার্ক বা বাগান এলাকার সুস্থ-স্বাভাবিক রূপকেই খানিকটা নষ্ট করবে বলে ধরনা আমার।
যাই হোক এবার আমার তপোবনে যাওয়ার পালা। এখান থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে গভীর জঙ্গলে তপোবন। রামেশ্বর শিব মন্দির থেকে তপোবন যাওয়ার রাস্তাটি কিন্তু ভারি মনোরম। সবুজ বনের মধ্যে দিয়ে লাল মাটির রাস্তা। প্রকৃতির এই কমনিয়তাচোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিল বটে, কিন্তু কেমন যেন ভয় ভয়ও করছিল। নিস্তব্ধ, গহন জঙ্গলের এই পথে হঠাত কোন বন্যজন্তু এলে আমি কিন্তু অসহায়। না, তেমন কিছু অবশ্য ঘটেনি। নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেলাম তপোবনে।
বইয়ে পড়া প্রাচীন বা পুরানের তপোবনের মতই সুন্দর এই তপোবনটিও। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস এখানেই ছিল বাল্মিকী মুনির আশ্রম। রাম কর্তৃক নির্বাসিত সীতা নাকি এখানেই এসে ছিলেন। এমনকি সীতার দুই সন্তান লব-কুশেরও জন্ম হয়েছে এখানেই। রয়েছে বাল্মিকী মুনির সমাধি। লব কুশ মন্দির। এক সাধুবাবা এখনও থাকেন এখানে, তার দাবী তিনি বাল্মিকী মুনির বংশধর।
তবে এই ধর্মীয় ব্যাপার স্যাপার বাদ দিলে কিন্তু আশ্রম চত্বর বা আশেপাশের এলাকা এক কথায় দারুণ। কাছে পিঠে লোকালয় নেই। তাই নির্জনতার মাঝে নাম না জানা পাখির ডাক এখানকার অলংকার। আশ্রমের পাশ দিয়ে বইছে ছবির মত সুন্দর একটি নদী। ছোট্ট একটি সাঁকোর মাধ্যমে এই নদী পেরিয়ে পৌছতে হয় আশ্রমে। রয়েছে আম জাম কাঁঠালের মত ফলের গাছও। আর আছে ছোট্ট একটি ঝরনা। যদিও এটিকে ঝরনা বলা যায় কিনা তা আপনাকেই ভেবে দেখতে হবে।
দুপুর গড়িয়ে সময় প্রায় বিকেল ছুঁইছুঁই। এবার ফেরার পালা। এখান থেকে ফের গোপীবল্লভপুর। সেখানে পৌঁছে মনে হল এবার কিছু না খেলেই নয়। এতক্ষণ নানা লোভনীয় মনের খাবার মেলায় পেট সেভাবে বিদ্রোহ করেনি। এবার তাই মোটামুটি একটা হোটেল দেখে খেয়ে নেওয়ার পালা।
খেতেই খেতেই স্থানীয়দের মুখে শুনলাম এলাকার ঐতিহ্যশালী গোপীনাথ মন্দিরের কথা। ফেরার আগে চট করে একবার সেই মন্দিরটাও দেখে নেওয়া গেল। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মাঝে সাবেকি মন্দির মন্দ নয়। সময় কম থাকায় উঠে পড়তে হল ঝাড়গ্রামের বাসে। পৌনে ছটা নাগাদ যখন ঝাড়গ্রাম ষ্টেশনে পৌছলাম ঠিক তখনই প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে লালমাটি এক্সপ্রেস। খুব ভিড় নয়, উঠে একটা জায়গা বেছে বসতেই বুজে এল চোখ। স্বপ্নে এল ফেলে আসা সেই সবুজ বনানী।