সম্পাদকীয়
২০০০ সালের গোড়ার দিক। আমি তখন দুর্গাপুরে। বাংলা টেলিভিশনের খবরে সবে মাত্র জোয়ার এসেছে। একটু অন্য ধরনের খবরের তখন দারুণ চাহিদা। আমাকে প্রায়শই অন্য ধরনের খবরের খোঁজ দিতেন কাজি খায়রুল আনম সিদ্দিকী। তখন তিনি ভূমী রাজস্ব দফতরে উচ্চ পদে কাজ করতেন। আমার প্রাক্তন সহকর্মী তথা সাংবাদিক কাঞ্চনদার বাবা হলেও, মজার কথা, এমন ধরনের খবর তিনি শুধু আমাকেই দিতেন। তার কাছেই প্রথম শুনি হাঁসুলী বাঁকের কথা। এর আগে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলী বাঁকের উপকথা পড়া থাকলেও সত্যি সত্যি যে এই জায়গার অস্তিত্ব আছে তা জানা ছিল না। খায়রুল জেঠুই আমাকে বলেন লাভপুরের কাছেই আছে হাঁসুলী বাঁক। এর পরে কেটে গেছে বছরদুয়েক। আমি বদলী হয়ে গেলাম পাশের জেলা বীরভূমে।
দুই এক মাস যেতেই মনে পড়ল জেঠুর কথা, হাঁসুলী বাঁকের কথা। আমার তৎকালীন সহকর্মী চিত্রগ্রাহক পরিতোষ দাসের বাড়ি লাভপুরের কাছেই, কীর্ণাহারে। পরিতোষকে বলতেই সে এক পায়ে রাজি আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে। আর দেরি করা যায়? বেরিয়ে পড়লাম একদিন, হাঁসুলী বাঁক নিয়ে খবর করব। লাভপুর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় চার কিলোমিটার পথ গেলে হাঁসুলী বাঁক। রাঙা মাটির সে পথ ধরে গন্তব্যে পৌঁছতেই দেখি একটি ইটভাটা রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে। জানা গেল ওই ভাটা দিয়েই যেতে হবে নদীর দিকে। সামান্য এগোতেই বদলে গেল দৃশ্যপট। কুলুকুলু মৃদু শব্দ করে বয়ে যাচ্ছে বক্রেশ্বর নদী। হাঁটু জলে নেমে খেলা করছে স্থানীয় কচিকাঁচার দল। হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড় ধরে এগিয়ে একটা ঢিবির উপর দাঁড়াতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। এইখানটাতে সেই দহ। যেখানে চঞ্চলা কোপাই এসে বক্রেশ্বরে মিলেছে। এত সহজে কিন্তু মিলন হয়নি কোপাই-বক্রেশ্বরের। পরস্পরের কাছে আসতে কমপক্ষে ১৮ বার হাঁসূলীর মতো বাঁক নিতে হয়েছে তাদের। শেষের প্রায় এক কিলোমিটার যাত্রাপথে দুই নদী কখনও কাছে এসেছে, কখনও দূরে সরে গেছে। মনে পড়ল উপন্যাসের কথা, কাহার পাড়ার পাখি আর করালীরও তো এত সহজে মিলন হয়নি।
এবার খবর করার পালা, আমি ভেবে এসেছিলাম হাঁসুলী বাঁকের অস্তিত্বের সঙ্গে সাহিত্যের মিশেলে জমিয়ে একটা স্টোরি করব। কিন্তু এখানে এসে তো মাথায় হাত। নদীর ধার ঘেঁসে দেদার চলছে মাটি কাটা। ইটভাটার জন্য শয়ে শয়ে শ্রমিক কেটে নিচ্ছেন নদী পাড় ও নদী গর্ভের মাটি। এভাবে চললে হাঁসুলী বাঁকের অস্তিত্ব যে বিপন্ন হয়ে পড়বে তা আমার মত আনাড়িরও সহজেই বোধগম্য হল। খবরের অ্যাঙ্গেলটাই ঘুরে গেল। এতক্ষণ যা ছিল থার্ড সেগমেন্টের সফট নিউজ এখন তাই হয়ে গেল ফার্স্ট সেগমেন্টের এক্সক্লুসিভ। অবিলম্বে সেই ছবি নেওয়া হল। নেওয়া হল স্থানীয় প্রশাসন এবং স্থানীয় মানুষজনের প্রতিক্রিয়াও। সেই সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় চ্যানেল ই টিভিতে বেশ কয়েক বার সেই খবর সম্প্রচারিত হল। নিন্দার ঝড় উঠল, বিরোধীরা নিন্দা করলেন, সংস্কৃতি প্রেমীরা হায় হায় করে উঠলেন, প্রশাসন খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিল।
… ফ্ল্যাশব্যাক থেকে এবার বর্তমানে। কেটে গিয়েছে প্রায় ১৫ টা বছর। অতি সম্প্রতি সপরিবারে বীরভূম গিয়ে মনে হল হাঁসুলী বাঁকটা একবার দেখে যাই। স্ত্রী ছেলেকেও এই সুযোগে একবার দেখানো যাবে। ফের পরিতোষকে ফোন, সে তো শুনে আনন্দে আত্মহারা। যাওয়া হল সদলবলে। সেই রাঙা মাটির পথ, দুধারে তালের সারি। বেশ লাগছিল… সামনে আবার সেই ইটভাটা। যেতে হবে আগের মতই তার ভিতর দিয়ে। শুনলাম খবরের কারনে কিছুদিন বন্ধ ছিল বটে তারপর আবার যথারীতি। নদীর দিকে এগোতেই আরও বড় চমক… আগের বারে নদীর দুধারের মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছিল, এবার নদীগর্ভ থেকে তোলা হচ্ছে বালি। গাড়ির পর গাড়ি বালি চলে যাচ্ছে কোথায় কে জানে? মুখ্যমন্ত্রী নাকি অবাধে বা বেআইনি বালি তোলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। আশপাশে দু একজনকে জিজ্ঞাসা করতে তাদের তো চোখ কপালে, বালি তোলায় বারন আছে নাকি? রোজই তো ট্রাক্টর ভরে বালি নিয়ে যাচ্ছে দিনভর। বুঝলাম প্রশাসন তখনও থেকেও ছিল না এখনও থেকেও নেই। সঙ্গী পরিতোষ ক্যামেরা বার করে ছবি তুলছে দেখেও কোন ভাবান্তর হল না বালি তুলছেন যারা তাদের মধ্যে। আসলে প্রত্যন্ত এই এলাকায় এসবের নজরদারি চলাবে কে? সেই সুযোগটাই নিচ্ছে অসাধু বালি মাফিয়ারা। তাদের দৌলতে নদী ইতিমধ্যেই তার স্বাভাবিক গতিপথ হারাতে বসেছে। যে সুতীক্ষ্ণ হংস গ্রীবার মত নদীর বাঁকগুলি ছিল মাটি কেটে নেওয়া আর বালি তোলার ফলে সেই বাঁকগুলি তার মসৃণতা হারিয়েছে। হাঁসুলী বাঁকের সেই স্বাভাবিক সৌন্দর্য মেলা ভার। তাই তো কোপাই-বক্রেশ্বরের মিলনভূমি হাঁসূলীবাঁকের উপকথা আজ ভিন্ন। বাঁশবাদি থেকে বাবাঠাকুরের বাহন আজ আর শিষ দিয়ে ডাকে না। দূরের কাহারপাড়ার বনোয়ারীর উত্তরপুরুষ কয়েকঘর আছে বটে, তবে তাদের ঘরের ছেলেরা আজ কেউ আমেদাবাদ, কেউ মুম্বাইতে কাজ করে। তাদের অবশ্য বাহিরমুখো করেছিল করালীই; কারণ সে-ই প্রথম কাহারপাড়ার প্রথা ভেঙে চন্ননপুর রেল ইয়ার্ডে কাজে গিয়েছিল। তবে হয়ত আজও কাহারপাড়ায় অমলিন আছে মেয়েদের মনের ‘অঙ’! আজও ওরা রঙকে অঙই বলে। আজও কাহার মেয়েদের মনে ‘অঙ’ ধরলে ওরা করালিদের জন্য অপেক্ষা করে দাওয়ায় বসে থাকে। কিন্তু নিজেদের রূপ হারানোর আশঙ্কা নিয়ে সন্তঃপর্ণে বয়ে চলেছে ক্ষীণতোয়া দুই নদী। ধরে নেওয়া যায় বালি মাফিয়ারা হয় তো হাঁসুলী বাঁকের উপকথা পড়েননি, কিন্তু প্রশাসনের শিক্ষিত কর্তারা ?
অসঙ্গতি দেখে বুকে বাজে তো তাই আপনাদের সঙ্গেই একটু ভাগ করে নিলাম। ভাল থাকবেন সকলে। সময় সুযোগ পেলে হাঁসুলী বাঁকটা একবার দেখে আসবেন, কতদিন থাকবে তা তো বলা মুশকিল। আবার কথা হবে পরের সংখ্যায়। দেশ বিদেশের বহু লেখকের নানা লেখা এবারেও এই পত্রিকার মান বাড়িয়েছে। তা দেখে আপনাদের সুচিন্তিত মতামত দেবেন পরবর্তীতে।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
![](http://abekshan.com/wp-content/uploads/2018/05/21102014230122-300x108.gif)